নাদেরা বেগম (২রা আগস্ট, ১৯২৯-১২ই এপ্রিল, ২০১৩) মহান বাংলা ভাষা আন্দোলনের একজন অন্যতম সংগঠক এবং কর্মী ছিলেন। বাংলাদেশে মুসলিম মহিলাদের বাম ধারার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত করার জন্য তিনি অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন।

নাদেরা বেগম
জন্ম২ আগস্ট, ১৯২৯
মৃত্যু১২ এপ্রিল, ২০১৩
জাতীয়তাবাংলাদেশি
নাগরিকত্ব বাংলাদেশ
পেশাশিক্ষকতা,বামপন্থী রাজনীতি
পরিচিতির কারণভাষা আন্দোলন
দাম্পত্য সঙ্গীগোলাম কিবরিয়া

জন্ম সম্পাদনা

ভাষা কন্যা নাদেরা বেগম ১৯২৯ সালের ২রা আগস্ট একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা খান বাহাদুর আবদুল হালিম চৌধুরী এবং মা আফিয়া বেগম। বাবা-মায়ের ১৪ সন্তানের মধ্যে তিনি তৃতীয়। প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ ও জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী তার বড় ভাই এবং শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরী তার মেজো ভাই। কিংবদন্তি নাট্য অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদার তার ছোট বোন।[১]

শিক্ষা ও চাকরি জীবন সম্পাদনা

বরিশাল সদর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৪৪ সালে মুসলিম মেয়েদের মধ্যে প্রথম বিভাগে প্রথম হয়ে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৪৮ সালে লেডি ব্রাবোর্ন কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। সাবেক অর্থসচিব ও মহা-হিসাবনিরীক্ষক গোলাম কিবরিয়ার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর তিনি গোলাম কিবরিয়ার চাকরি সূত্রে করাচি, মস্কো ইত্যাদি বিভিন্ন স্থানে বসবাস করেন। পরবর্তীতে দেশে ফিরে আবারো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে অধ্যাপনা শুরু করেন।[২]

রাজনৈতিক জীবন সম্পাদনা

বড় ভাই কবীর চৌধুরী এবং মেজো ভাই মুনীর চৌধুরী দুজনেই বাম ধারার রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। অত্যন্ত রক্ষণশীল পরিবারে বেড়ে উঠেও বড় ভাইদের সহায়তায় পড়াশুনা শেষ করতে পারেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ করার সময়েই তিনি জড়িয়ে পড়েন বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে। মুনীর চৌধুরী'র অনুপ্রেরণায় কমিউনিস্ট ছাত্রী সংস্থা গঠনের কাজ শুরু করেন।[৩]

১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির আন্দোলনে তিনি অংশগ্রহণ করেন। বিশ্যবিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তখন সরকারের নির্দেশে ২৭ জন ছাত্র-ছাত্রীকে বহিস্কার ঘোষণা করে। যাদের মধ্যে একমাত্র মেয়ে হিসেবে নাদেরা বেগমের নাম ছিলো। পুলিশ তার নামে হুলিয়া জারি করলে আত্মগোপনে চলে যান তিনি। এ অবস্থায় তিনি পালিয়ে পিকেটিং-মিটিং-মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছেন। পরবর্তীতে গ্রেপ্তার হলে ১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত ঢাকা আর রংপুর জেলে দুই বছর কারাভোগ করেন তিনি।[৪]

ভাষা আন্দোলনে ভূমিকা সম্পাদনা

তিনি ছিলেন ভাষা আন্দোলনের সূচনালগ্নের অন্যতম সংগঠক। ১৯৪৮ সালের ১৬ই মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলতলায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে অনুষ্ঠিত সভাতে তিনি অংশগ্রহণ করেন। উক্ত সভায় পুলিশি অ্যাকশনে তিনি আহত হন। পাকিস্তান সরকার বাংলা ভাষাকে আরবি, রোমান ইত্যাদি বিভিন্ন হরফে লেখার সিদ্ধান্ত নিতে চাইলে বিভিন্ন কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করে এর তীব্র প্রতিবাদ জানান তিনি। ভাষা আন্দোলনের সূচনালগ্নে তার প্রচেষ্টায় কামরুন্নেসা স্কুল, বাংলাবাজার স্কুল, ইডেন মহিলা কলেজ সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেয়ে তিনি নারীদেরকে উদ্বুদ্ধ করতেন। পরবর্তীতে এসব নারীরা ভাষা আন্দলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি আন্ডার গ্রাউন্ডে থেকে সার্বিক সহযোগিতা করেছেন। পরবর্তীতে অন্যান্য ভাষা সংগ্রামীদের স্মৃতি-চারণায় সেগুলো উঠে আসে। ভাষাসৈনিক ড. হালিমা খাতুন বলেন, ‘নাদেরা বেগম তখন আন্দোলনের কিংবদন্তি নায়িকা। অনেকবার জেল খেটেছেন। ১০ই ফেব্রুয়ারি রাতে আমি নাদেরা বেগমের কাছ থেকে চিঠি লিখিয়ে আনি। মেয়েরা পরদিন সকালে আমতলার সভায় অংশগ্রহণ করেন। তার চিঠির ভাষা ছিল এমন বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র হচ্ছে এটাকে প্রতিহত করার জন্য আন্দোলন চালিয়ে যাও।’[৫]

মৃত্যু সম্পাদনা

২০১৩ সালের ১২ই এপ্রিল উত্তরায় তার নিজের বাসায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর।[৬][৭]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. চলে গেলেন ভাষা সৈনিক নাদেরা বেগম[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  2. "নাদেরা বেগম"। ৩ ডিসেম্বর ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩ মার্চ ২০১৫ 
  3. "কিংবদন্তির নাদেরা বেগম"। ২০১৩-১২-২৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৫-০৩-০৩ 
  4. "ভাষাসৈনিক নাদেরা বেগম"। ৫ মার্চ ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩ মার্চ ২০১৫ 
  5. ভাষাসৈনিক নাদেরা বেগম-সুপা সাদিয়া[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  6. "নাদেরা বেগম আর নেই"। ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩ মার্চ ২০১৫ 
  7. "ভাষা আন্দোলনের নেত্রী নাদেরা বেগম আর নেই"। ৪ মার্চ ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩ মার্চ ২০১৫ 

বহি:সংযোগ সম্পাদনা