নব বিশ্বব্যবস্থা (ষড়যন্ত্র তত্ত্ব)

নব বিশ্বব্যবস্থা একটি প্রচলিত ষড়যন্ত্র তত্ত্ব যাতে একটি গোপনভাবে উত্থিত একক বিশ্ব সরকারের কল্পনা করা হয়েছে। এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বের মূল ভাবনা হলো বৈশ্বিক পরিকল্পনাসহ এক গোপন ক্ষমতাধর অভিজাত শ্রেণি বিশ্ব আধিপত্যের জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তারা স্বৈরাচারী একক বিশ্ব সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জাতি-রাষ্ট্রগুলির স্থান দখল করবে। উদ্দেশ্য হলো সার্বিক প্রোপাগান্ডা চালু করা যার মূল ভাবধারা 'নতুন বিশ্বব্যবস্থা' প্রতিষ্ঠাকে ইতিহাসের চূড়ান্ত সাফল্য বলে তুলে ধরবে। এই ষড়যন্ত্রমূলক বিশ্ব আধিপত্য অর্জনের জন্য অভিজাত শ্রেণির সদস্যরা নানা ফ্রন্ট সংগঠনের মাধ্যমে কাজ করে যাচ্ছে বলে অভিযোগ। কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা, জাতিগত ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিতর্কিত নীতি চাপিয়ে দেয়া ইত্যাদিকেই এই তত্ত্বের সমর্থকরা বিশ্ব আধিপত্যের ধাপ হিসেবে দেখেন।

১৯৯০'র দশকের পূর্বে নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার নিয়ে ষড়যন্ত্রমূলক চিন্তা মার্কিন সমাজের দুটি প্রান্তিক ধারায় সীমাবদ্ধ ছিল। প্রথমত, সরকারবিরোধী চরম-ডানপন্থী গোষ্ঠী এবং দ্বিতীয়ত, খ্রিস্টধর্মের ভিতর সেই সব মৌলবাদীরা যারা Antichrist ("অ্যান্টিক্রাইস্ট"-ধর্মান্ধদের বিশ্বাসে শয়তানের প্রতিনিধি)-এর আবির্ভাব নিয়ে ভীত ছিল।

ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ও ধর্মীয় চরমপন্থা নিয়ে গবেষণা করা শিক্ষাবিদগণ, যেমন মাইকেল বারকুন এবং চিপ বারলেট, লক্ষ্য করেন যে ডানপন্থীদের এই NWO ষড়যন্ত্র তত্ত্ব অনেকেই মেনে নিয়েছে। এমনকি এটি মূলধারার সংস্কৃতিতেও প্রবেশ করেছে। ফলাফল হিসেবে বেঁচে থাকার স্বার্থে সামরিক প্রস্তুতি ও আত্মনির্ভরশীল জীবনযাপন প্রচেষ্টা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। এই রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা সতর্ক করেন, নব বিশ্বব্যবস্থা নিয়ে গণউন্মাদনা শেষ পর্যন্ত মার্কিন রাজনীতিতে বিধ্বংসী ভূমিকা রাখতে পারে। একাকী সন্ত্রাসবাদ থেকে শুরু করে স্বৈরাচারী-জাতীয়তাবাদী নেতাদের উত্থান এর অন্তর্ভুক্ত।

শব্দটির ইতিহাস সম্পাদনা

সাধারণ ব্যবহার (স্নায়ু যুদ্ধের পূর্বে) সম্পাদনা

বিংশ শতাব্দীতে, উডরো উইলসন এবং উইনস্টন চার্চিলের মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা "নতুন বিশ্বব্যবস্থা" (New world order) শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। তাঁরা বিশ্ব রাজনৈতিক চিন্তাধারায় নাটকীয় পরিবর্তন এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বিশ্বব্যাপী ক্ষমতার ভারসাম্যে পরিবর্তন সঙ্ঘটিত একটি নতুন ঐতিহাসিক যুগকে নির্দেশ করতে এই শব্দটি ব্যবহার করেন। আন্তঃযুদ্ধকালীন ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়কালকে বিশ্বব্যাপী সমস্যা সমাধানের সুযোগ হিসাবে দেখা হয়েছিল। এই সমস্যাগুলো স্বতন্ত্র জাতি-রাষ্ট্রগুলির সমাধান করার ক্ষমতার বাইরে অবস্থিত ছিল। তবে সেসময় বিভিন্ন রাষ্ট্রের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে সম্মান জানানো হত। ১৯২০ সালে লীগ অফ নেশনস, ১৯৪৫ সালে জাতিসংঘ (UN) এবং ১৯৪৯ সালে ন্যাটোর মত আন্তঃসরকারি সংগঠন গঠনের মধ্য দিয়ে এই ধরনের সম্মিলিত উদ্যোগগুলি প্রকাশ পেয়েছিল। এছাড়া ব্রেটন উডস সিস্টেম এবং জেনারেল অ্যাগ্রিমেন্ট অন ট্যারিফস অ্যান্ড ট্রেড (GATT) এর মতো আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাগুলি বাস্তবায়িত হয়েছিল। এই ব্যবস্থাগুলি ক্ষমতার একটি সমবায় ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য এবং আরেকটি বিশ্বব্যাপী সংঘাতের সম্ভাবনা প্রতিরোধের জন্য জাতিগুলির মধ্যে পুনর্মিলন সহজতর করার জন্য বাস্তবায়ন করা হয়েছিল। ১৯৩০ এর দশক থেকে শুরু করে আমেরিকার রক্ষণশীল ব্যবসায়িক জাতীয়তাবাদীরা উদার আন্তর্জাতিকতাবাদ চর্চার এই বিশ্বজনীন প্রচেষ্টার নিয়মিত সমালোচনা ও বিরোধিতা করেছিলেন।

প্রগতিশীলরা দুটি বিশ্বযুদ্ধের পরপরই জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক সংগঠন ও কাঠামোকে স্বাগত জানিয়েছিল, কিন্তু তারা যুক্তি দিয়েছিল যে এই উদ্যোগগুলো গণতান্ত্রিক ঘাটতির শিকার। সেজন্য তারা বিশ্বব্যাপী ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য তো বটেই, এমনকি আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ রোধের জন্যও এগুলিকে অপর্যাপ্ত বলে মনে করেছিলেন। তারা মনে করতেন, জাতিসংঘকে সার্বভৌম জাতি-রাষ্ট্রগুলির একটি মুক্ত সংগঠন হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, গণতান্ত্রিক বিশ্ব সরকারের দিকে প্রস্থান হিসাবে নয়। এইভাবে, বিশ্বব্যাপী পরিবর্তনের ব্যাপারে আন্তঃসরকারি সংগঠনগুলোকে খুব বেশি কার্যকরী না মনে করে, বিশ্বজুড়ে বিশ্বজনীন কর্মীরা একটি বিশ্ব ফেডারেল আন্দোলন গঠন করেছিল।

ব্রিটিশ লেখক এবং ভবিষ্যদ্বক্তা এইচ. জি. ওয়েলস ১৯৪০ এর দশকে প্রগতিশীলদের চেয়েও অনেক এগিয়ে গিয়েছিলেন। "নতুন বিশ্বব্যবস্থা" শব্দটিকে গ্রহণ করে এবং এর নতুন অর্থ নির্ধারণ করে একটি প্রযুক্তিভিত্তিক বিশ্ব-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং একটি পরিকল্পিত অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার প্রতিশব্দ হিসাবে এটিকে গড়ে তোলেন। এভাবে তিনি রাষ্ট্রীয় সমাজতান্ত্রিক বৃত্তগুলিতে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন।

ষড়যন্ত্রের প্রসঙ্গ হিসেবে ব্যবহার (শীতল যুদ্ধকালীন সময়) সম্পাদনা

দ্বিতীয় রেড স্কেয়ারের সময় (১৯৪০ এর শেষ দিক- ১৯৫০ সাল) আমেরিকার ধর্মনিরপেক্ষ এবং খ্রিস্টান ডানপন্থী উস্কানিদাতারা উভয়ই, কানাডিয়ান ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিক উইলিয়াম গাই কারের কাজ দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়ে, ফ্রিম্যাসন, ইলুমিনাতি এবং ইহুদিদের একটি "আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্রের" পিছনে চালিকা শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করতে থাকে। নাস্তিক, আমলাতান্ত্রিক সমষ্টিবাদী বিশ্ব সরকার হিসেবে চিহ্নিত "ঈশ্বরহীন সাম্যবাদের" হুমকি, বিশ্বব্যাপী ধ্বংসাত্মক ষড়যন্ত্রে পরিণত হয়েছিল। রেড স্কেয়ার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ডানপন্থীদের অন্যতম মূল ধারণার আকার দিতে সাহায্য করেছিল - উদারপন্থী ও অগ্রগামীরা নাকি তাদের কল্যাণ-রাষ্ট্র নীতিমালা এবং বৈদেশিক সাহায্যের মতো আন্তর্জাতিক সহযোগিতা কর্মসূচিগুলির মাধ্যমে ধীরে ধীরে বৈশ্বিক সমষ্টিবাদের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এই কল্পিত প্রক্রিয়া অবশেষে একটি সাম্যবাদী/সমষ্টিবাদী এক-বিশ্ব সরকারের দিকে পরিচালিত করবে।

১৯৫০ সালে ইউনাইটেড স্টেটস সিনেট কমিটি অন ফরেন রিলেশনের সামনে হাজির হয়ে জেমস ওয়ারবার্গ বিখ্যাতভাবে বলেন: "আমরা বিশ্ব সরকার পাব, আমরা তা পছন্দ করি বা না করি। প্রশ্ন হলো - সম্মতির মাধ্যমে না জোর করে, কীভাবে বিশ্ব সরকার অর্জিত হবে।"

১৯৬০-এর দশকে জন বার্চ সোসাইটির মতো প্রভাবশালী ডানপন্থী সংগঠনগুলি এই মিথ্যা ধারণা প্রচার করে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সরকারগুলি আন্তর্জাতিকতাবাদীদের একটি দল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এই "লোভী" ব্যাংকার এবং দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদরা জাতিসংঘকে "এক বিশ্ব সরকার" তৈরির মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। এই বিশ্বায়ন-বিরোধী চক্রান্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে জাতিসংঘ থেকে প্রত্যাহারের প্রচারণাকে উস্কে দিয়েছিল।

মার্কিন লেখক মেরি এম. ডেভিসন, তার ১৯৬৬ সালের বুকলেট 'দ্য প্রোফাউন্ড রেভলিউশনে' অভিযুক্ত নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার ষড়যন্ত্রের সূত্রপাত চিহ্নিত করেছেন ১৯১৩ সালে আন্তর্জাতিক ব্যাংকারদের দ্বারা ইউএস ফেডারেল রিজার্ভ প্রতিষ্ঠার মধ্যে। তিনি দাবি করেছিলেন যে, পরবর্তীতে এই ব্যাংকাররা ১৯২১ সালে কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস গঠন করেছিল একটি ছায়া সরকার হিসেবে। বুকলেটটি প্রকাশিত হওয়ার সময়, অনেক পাঠক "আন্তর্জাতিক ব্যাংকার" কথাটিকে রথসচাইল্ড পরিবার কর্তৃক পরিচালিত একটি "আন্তর্জাতিক ইহুদি ব্যাংকিং ষড়যন্ত্র" হিসেবে ব্যাখ্যা করেছিলেন।

'নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার' শব্দটি বিশ্বের দেশগুলির সার্বভৌমত্ব নির্মূল করার জন্য নিবেদিত একটি গোপন বিশ্ব অভিজাত শ্রেণী দ্বারা ব্যবহৃত হয় - এই তর্কের ভিত্তিতে মার্কিন লেখক গ্যারি অ্যালেন তার বইগুলি- নান ডেয়ার কল ইট কন্সপাইরেসি (১৯৭১), রকফেলার: ক্যাম্পেইনিং ফর দ্য নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার (১৯৭৪), এবং সে "নো!" টু দ্য নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার'-এ (১৯৮৭) সমসাময়িক ডানপন্থী ষড়যন্ত্রতত্ত্বকে স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন। ১৯৯০ এর দশকের শুরুতে কমিউনিজমের পতনের পর, নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার ষড়যন্ত্রের কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তুতে একটি পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এবারের প্রধান খলনায়ক হিসেবে ক্রিপ্টো-কমিউনিস্টদের পরিবর্তে চিহ্নিত হয় বিশ্বায়নবাদীদের, যারা আন্তর্জাতিক ব্যাংকার, দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদ এবং কর্পোরেশন, বা জাতিসংঘ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত একটি সমষ্টিবাদী বিশ্ব সরকার প্রতিষ্ঠার চক্রান্ত করছে বলে মনে করা হতো। ১৯৯০ এর দশকে আমেরিকান ডানপন্থীদের মধ্যে কর্পোরেট আন্তর্জাতিকতাবাদের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান বিরোধিতাই এই ক্রমাগত পরিবর্তনে মুখ্য ভূমিকা রেখেছিল।

১৯৯০ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ইউএস কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে দেওয়া তার ভাষণে, 'টুওয়ার্ড আ নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার', রাষ্ট্রপতি জর্জ এইচ.ডব্লিউ. বুশ সোভিয়েত-পরবর্তী রাষ্ট্রগুলির সাথে সহযোগিতায় শীতল যুদ্ধ পরবর্তী বিশ্বব্যাপী শাসনের জন্য তার উদ্দেশ্য বর্ণনা করেছিলেন। তিনি বলেন:

“এখন পর্যন্ত, আমরা যে বিশ্বকে জানতাম সেটি ছিল বিভক্ত একটি বিশ্ব - কাঁটাতার এবং কংক্রিট ব্লক, দ্বন্দ্ব এবং শীতল যুদ্ধের বিশ্ব। এখন, আমরা একটি নতুন বিশ্ব আসতে দেখছি। যে বিশ্বে একটি নতুন বিশ্বব্যবস্থার আসল সম্ভাবনা রয়েছে। উইনস্টন চার্চিলের ভাষায়, একটি 'বিশ্বব্যবস্থা' যেখানে 'ন্যায়বিচার এবং সুষ্ঠু খেলার নীতি ... শক্তিশালীর বিরুদ্ধে দুর্বলদের রক্ষা করে...' এমন একটি বিশ্ব যেখানে জাতিসংঘ, শীতল যুদ্ধের অচলাবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে, এর প্রতিষ্ঠাতাদের ঐতিহাসিক লক্ষ্য পূরণ করতে প্রস্তুত। এমন একটি বিশ্ব যেখানে স্বাধীনতা এবং মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা সমস্ত জাতির মধ্যে একটি আবাস খুঁজে পায়।

দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস পর্যবেক্ষণ করেছে যে, সেই সময়ে উদারপন্থীরা এই নতুন বিশ্বব্যবস্থাকে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষার যৌক্তিকতা হিসেবে নিন্দা করছিল। একই সময়ে, রক্ষণশীলরা যেকোনো নতুন নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিল এবং জাতিসংঘের পুনরুজ্জীবনের যেকোনো সম্ভাবনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছিল। চিপ বারলেট, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডানপন্থী আন্দোলনের উপর বিশেষজ্ঞ একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক, লিখেছেন যে খ্রিস্টান এবং ধর্মনিরপেক্ষ চরম ডানপন্থীরা বুশের ভাষণে বিশেষভাবে ভীত ছিল। মৌলবাদী খ্রিস্টান গোষ্ঠীগুলি বুশের কথাগুলিকে শেষ সময়ের (End Times) সংকেত হিসাবে ব্যাখ্যা করেছিল। এছাড়া, আরও ধর্মনিরপেক্ষ তাত্ত্বিকরা সমস্যাটিকে একটি সাম্যবাদ-বিরোধী এবং সমষ্টিবাদ বিরোধী দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করে এবং জাতিসংঘ কর্তৃক সমস্ত দেশের উপর আধিপত্যের আশঙ্কা করেছিল।

শীতল যুদ্ধ-পরবর্তী ব্যবহার সম্পাদনা

খ্রিস্টান সম্প্রচারক প্যাট রবার্টসন তার ১৯৯১ সালের বেস্টসেলার বই 'দ্য নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার'-এর মাধ্যমে সাম্প্রতিক আমেরিকান ইতিহাস সম্পর্কে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ছড়ানোর ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করেন। তিনি এমন একটি চিত্র তুলে ধরেন যেখানে ওয়াল স্ট্রিট, ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেম, কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস, বিল্ডারবার্গ গ্রুপ এবং ট্রাইলেটারাল কমিশন পরোক্ষভাবে ঘটনাবলীকে নিয়ন্ত্রণ করছে। তাদের লক্ষ্য বিশ্ব সরকার গঠনের মাধ্যমে পথ তৈরি করা, যাতে শয়তানের আবির্ভাব সহজ হয়।

লক্ষ্য করা গেছে, ১৯৯০-এর দশক জুড়ে লিণ্ডা থম্পসন, মার্ক কোয়ের্নকে এবং রবার্ট কে. স্পিয়ারের মতো ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিকরা উগ্র বক্তৃতা দিয়ে আমেরিকান মিলিশিয়া আন্দোলনের উত্থান ঘটান। এই মিলিশিয়া আন্দোলনের সরকার-বিরোধী মতাদর্শ বিভিন্ন সমাবেশে বক্তৃতা, বইপত্র, গান শো-তে বিক্রি হওয়া ভিডিওটেপ, রেডিও, ফ্যাক্স নেটওয়ার্ক এবং কম্পিউটার বুলেটিন বোর্ডের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল। তর্ক করা যেতে পারে যে রাতভর সম্প্রচারিত এএম রেডিও অনুষ্ঠান এবং ইন্টারনেটের ভাইরাল বিষয়বস্তুই 'নতুন বিশ্বব্যবস্থা'র হুমকি সম্পর্কে চরমপন্থী প্রতিক্রিয়া জাগাতে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছিল। এর ফলে ব্যাপকভাবে এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বের প্রচার ঘটে, এবং কেনেডি হত্যাকাণ্ড নিয়ে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব, ইউএফও বিশেষজ্ঞ, কিংবদন্তির ভূমি-তাত্ত্বিক এমনকি গুপ্তবিদ্যাচর্চা-কারীদের মতো দলগুলোতেও এই তত্ত্ব ছড়িয়ে পড়ে।

১৯৯০ দশকের মাঝামাঝি থেকে ২০০০ দশকের শুরুর দিকে, হলিউডের ষড়যন্ত্র-থ্রিলার টেলিভিশন অনুষ্ঠান এবং চলচ্চিত্রও বিভিন্ন গুপ্ত তত্ত্বকে সাধারণ দর্শকদের কাছে পৌঁছে দেয়। এই তত্ত্বগুলো ছিল 'নতুন বিশ্বব্যবস্থা' তত্ত্বেরই অংশ – কালো হেলিকপ্টার, ফেমা কনসেনট্রেশন ক্যাম্প ইত্যাদি। 'দ্য এক্স-ফাইলস' ধারাবাহিক (১৯৯৩-২০০২), 'কন্সপিরেসি থিওরি' (১৯৯৭) এবং 'দ্য এক্স-ফাইলস: ফাইট দ্য ফিউচার' (১৯৯৮) ছবিগুলো এর উল্লেখযোগ্য উদাহরণ।

একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে, বিশেষ করে ২০০০ দশকের শেষের দিকে বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের সময়, গর্ডন ব্রাউন এবং হেনরি কিসিঞ্জারের মতো অনেক রাজনীতিবিদ এবং পণ্ডিত 'নতুন বিশ্বব্যবস্থা' শব্দটি ব্যবহার করতে শুরু করেন। বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থার ব্যাপক সংস্কারের পক্ষে এবং চীন ও ভারতের মতো উদীয়মান বাজারগুলিকে গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বানে 'নিউ ব্রেটন উডস' গঠনের পরামর্শ দেন তারা। এই সব ঘোষণা 'নতুন বিশ্বব্যবস্থা' সংক্রান্ত ষড়যন্ত্র তত্ত্বগুলিকে পুনরুজ্জীবিত করে; ফলে টক-শো হোস্ট শন হ্যানিটি তার ফক্স নিউজ প্রোগ্রামে বলেন, "ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিকরা সঠিক ছিল"। গণমাধ্যম পর্যবেক্ষণকারী সংস্থাগুলো বারবার ফক্স নিউজ, বিশেষ করে এর বর্তমানে বিলুপ্ত অনুষ্ঠান 'গ্লেন বেক'-কে সমালোচনা করেছে এই ষড়যন্ত্র তত্ত্ব প্রচার করার জন্য।

২০০৯ সালে, আমেরিকান চলচ্চিত্র নির্মাতা লুক মেয়ার এবং অ্যান্ড্রু নীল সমালোচকদের দ্বারা প্রশংসিত প্রামাণ্যচিত্র 'নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার' প্রকাশ করেন যাতে তারা ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিকদের জগৎ নিয়ে আলোচনা করেন – যাদের মধ্যে ছিলেন আমেরিকান রেডিও হোস্ট অ্যালেক্স জোন্স। এই চলচ্চিত্রের বিষয় ছিল তারা কীভাবে 'নতুন বিশ্বব্যবস্থা' প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায়কে প্রতিহত করতে চায়। এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বগুলোর ক্রমবর্ধমান প্রচার ডানপন্থী উস্কানিদাতা এবং বামপন্থী হিপ হপ সংগীতশিল্পীদের (যেমন কেআরএস-ওয়ান, পাবলিক এনিমির প্রফেসর গ্রিফ এবং ইমোর্টাল টেকনিক) মধ্যে একটি জোট তৈরি করেছে। এটা দেখায় কীভাবে একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে স্বার্থবাদ-বিরোধী এই তত্ত্ব অপ্রত্যাশিত মিত্রতা তৈরি করতে পারে।

ষড়যন্ত্র তত্ত্ব সম্পাদনা

নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা (New World Order) এর ধারণা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে অনেক ধারাবাহিক ষড়যন্ত্র তত্ত্বের জন্ম দিয়েছে। এখানে প্রধান ষড়যন্ত্র তত্ত্বগুলির একটি তালিকা রয়েছে, যা কালানুক্রমিকভাবে সাজানো:

শেষ সময় সম্পাদনা

ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে বিশ্বব্যাপী অনেক খ্রিস্টান ধর্মতাত্ত্বিক আশঙ্কা করছেন যে শেষ সময়ের আগমনের সাথে সাথে, একটি সর্বগ্রাসী নতুন বিশ্বব্যবস্থা ক্ষমতায় আসবে। তাদের অনেকে বিশ্বাস করেন যে যারা ধন-সম্পদ ও ক্ষমতার লোভে শয়তানের সাথে চুক্তি করেছে তারা হল এই অশুভ পরিকল্পনার অংশ। তাদের ধারণা, বাইবেলের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী একটি ইউটোপিয়ান বিশ্ব সরকার গঠিত হবে - যার ভিত্তি হবে বিভিন্ন ধর্মের সংমিশ্রণে তৈরি একটি ধর্মীয় বিশ্বাস। কিন্তু পরবর্তীতে এই সরকার ও ধর্মীয় বিশ্বাসে শয়তান, ভন্ড খ্রিস্ট/মসিহ এবং মিথ্যা ভবিষ্যদ্বাক্তার প্রভাব দেখা যাবে; যা শেষ পর্যন্ত চরম স্বৈরাচারী সাম্রাজ্যে রূপ নেবে।

অনেক সমসাময়িক খ্রিস্টান ষড়যন্ত্র তত্ত্ব অনুযায়ী, হয় ক্যাথলিক চার্চের শেষ পোপ (অতি গোপনীয় ইতালীয় সংগঠন Alta Vendita অথবা জেসুইটদের দ্বারা মদদপুষ্ট ), কোনো নিউ এজ গুরু, অথবা এমনকি কোনো মৌলবাদী খ্রিস্টান সংগঠন (যেমন The Fellowship) এর নেতাই হবেন সেই মিথ্যা ভবিষ্যদ্বাক্তা। অনেকে মনে করেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট, কোনো বৃহৎ ইসলামিক রাষ্ট্রের খলিফা, এমনকি জাতিসংঘের মহাসচিবই হতে পারেন ভন্ড খ্রিস্ট/মসিহ।

কিন্তু, এই ধরণের ষড়যন্ত্র তত্ত্বের বিস্তার নিয়ে কঠোর সমালোচনাও রয়েছে, এমনকি খ্রিস্টধর্মের ভেতর থেকেও। ১৯৯৩ সালে, ইতিহাসবিদ ব্রুস ব্যারন একটি খ্রিস্টান গবেষণা পত্রিকায় প্যাট রবার্টসনের ১৯৯১ সালের বই "The New World Order" পর্যালোচনা করতে গিয়ে এই অ্যাপোক্যালিপ্টিক খ্রিস্টান ষড়যন্ত্রবাদকে কঠোর ভাষায় নিন্দা করেন। আরেকটি সমালোচনা পাওয়া যায় ঐতিহাসিক গ্রেগরি এস. ক্যাম্পের ১৯৯৭ সালের বই "Selling Fear: Conspiracy Theories and End-Times Paranoia" -তে।

খ্রিস্টান ধর্মীয় পণ্ডিত রিচার্ড টি. হিউজেস যুক্তি দেন যে "নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা"র বক্তব্য খ্রিস্টধর্মকেই কলঙ্কিত করে। কারণ, খ্রিস্টান ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিকরা যেভাবে "নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা"র বর্ণনা করেন, তার কোন ভিত্তিই বাইবেলে নেই। তিনি বলেন যে এই ধারণাটি কেবল বাইবেল পরিপন্থী নয়, বরং এটি সম্পূর্ণভাবে বাইবেল বিরোধী এবং মৌলিকভাবে খ্রিস্টান-বিরোধী। তাঁর মতে, বাইবেলের নববিধানের মূল বার্তাগুলিকে ভুলভাবে উপস্থাপন করে ভয়, আতঙ্ক এবং হতাশার বার্তা দেওয়া হচ্ছে ক্ষমতায় আসা একটি বিশ্ব সরকারের মাধ্যমে।

অগ্রগামী খ্রিস্টান যেমন ধর্মতত্ত্ববিদ পিটার জে. গোমস, খ্রিস্টান মৌলবাদীদের সতর্ক করেন যে "ভয়ের আত্মা" ধর্মগ্রন্থ এবং ইতিহাসকে বিকৃত করতে পারে। ক্যাম্প আরো সতর্ক করেন যে এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বিশ্বাস করার ফলে খ্রিস্টানদের মনে বিপজ্জনক ভাবে বিভিন্ন কুসংস্কার জন্ম নিতে পারে। তাই, এই সব ষড়যন্ত্রে বিশ্বাসী খ্রিস্টানদের তিনি অনুতাপ করার আহ্বান জানান।

ফ্রিম্যাসনরি সম্পাদনা

ফ্রিম্যাসনরি বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন ধর্মনিরপেক্ষ ভ্রাতৃত্ববোধক সংগঠন। এর উৎপত্তি অষ্টাদশ শতাব্দীতে গ্রেট ব্রিটেনে। সময়ের সাথে সাথে, ফ্রিম্যাসনরিকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু অভিযোগ এবং ষড়যন্ত্র তত্ত্ব তৈরি হয়েছে। যেমন- ফ্রিম্যাসনদের একটি লুকানো রাজনৈতিক এজেন্ডা রয়েছে এবং তারা একটি নতুন বিশ্বব্যবস্থা তৈরির ষড়যন্ত্র করছে, যেখানকার সরকার ম্যাসনিক নীতি অনুসারে সংগঠিত হবে বা শুধুমাত্র ফ্রিম্যাসনদের দ্বারা পরিচালিত হবে।

ম্যাসনিক প্রতীক ও আচার-অনুষ্ঠানের গূঢ় প্রকৃতি অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে ফ্রিম্যাসনদের ওপর প্রথমে গোপনে শয়তানের পূজা করার অভিযোগ এনেছিল। সারা বিশ্বে ধর্ম ও সরকারকে ভেঙে ফেলার জন্য ফ্রিম্যাসনরির মধ্যে ষড়যন্ত্রের মূল অভিযোগ স্কটিশ লেখক জন রবিনসনের কাছে পাওয়া যায়। তার এই প্রতিক্রিয়াশীল ষড়যন্ত্র তত্ত্ব আটলান্টিক পেরিয়ে উনিশ শতকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রোটেস্ট্যান্ট বিরোধী-ম্যাসনরির উত্থানকে প্রভাবিত করেছিল। ১৮৯০-এর দশকে, ফরাসি লেখক লিও ট্যাক্সিল ফ্রিম্যাসনরির নিন্দা করে এবং লুসিফারকে সর্বোচ্চ সত্তা এবং মহাবিশ্বের মহান স্থপতি হিসাবে পূজা করার অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে একগুচ্ছ পুস্তিকা ও বই লিখেছিলেন। ট্যাক্সিল স্বীকার করলেও তার দাবিগুলো ছিল ভিত্তিহীন প্রতারণা, তবুও অনেক ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিক এতে বিশ্বাস করেছেন এবং করছেন। এটি ফ্রিম্যাসনরি সম্পর্কে পরবর্তী ম্যাসনবিরোধী দাবিগুলিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল।

কিছু ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিক শেষ পর্যন্ত অনুমান করেছিলেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিছু প্রতিষ্ঠাতা, যেমন জর্জ ওয়াশিংটন এবং বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন এর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তারা আমেরিকান সমাজের সাথে ম্যাসনিক পবিত্র জ্যামিতিক নকশা জড়িয়ে রেখেছিলেন, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের গ্রেট সিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক-ডলার বিল, ন্যাশনাল মলের ল্যান্ডমার্কগুলির স্থাপত্য এবং ওয়াশিংটন, ডি.সি.-এর রাস্তা ও মহাসড়কে। এসব ছিল আসন্ন নতুন বিশ্বব্যবস্থার মডেল হিসেবে প্রথম "ম্যাসনিক সরকার" তৈরির একটি মাস্টার প্ল্যানের অংশ হিসেবে।

ফ্রিম্যাসনরা ষড়যন্ত্রের এই দাবিগুলো খণ্ডন করে। ফ্রিম্যাসনরি যুক্তিবাদকে উন্নীত করে এবং গুপ্ত প্রতীকগুলিতে কোনও শক্তি দেয় না। প্রতীক আঁকা, তা যত বড়ই হোক না কেন, ক্ষমতা জোরদার বা নিয়ন্ত্রণের কাজ হিসাবে দেখা - এটি ম্যাসনিক নীতির অংশ নয়। উপরন্তু, গ্রেট সিলের নকশার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের ম্যাসনিক সদস্যপদ প্রতিষ্ঠা করার কোনও প্রকাশিত তথ্য নেই। ষড়যন্ত্র তত্ত্ববিদরা দৃঢ়তার সাথে বলে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গ্রেট সিলের উপাদানগুলিতে ম্যাসনিক প্রভাব রয়েছে এবং এই উপাদানগুলি ইচ্ছাকৃতভাবে বা অনিচ্ছাকৃতভাবে ব্যবহৃত হয়েছিল কারণ নির্মাতারা এই প্রতীকগুলির সাথে পরিচিত ছিলেন। বস্তুত, সর্বদর্শী আই অফ প্রভিডেন্স এবং অসমাপ্ত পিরামিড অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে ম্যাসনিক লজের বাইরে এবং ভিতরে সমানভাবে প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হত। অতএব, নকশাকাররা তখনকার পরিচিত গূঢ় প্রতীক থেকেই নকশা তৈরি করেছিলেন।

যুক্তরাষ্ট্রের গ্রেট সিলের বিপরীত দিকে ১৭৮২ সাল থেকে এবং ১৯৩৫ সাল থেকে এক ডলারের বিলের পিছনে "novus ordo seclorum" লেখাটি লাতিন ভাষায় আছে। এর অনুবাদ "যুগের নতুন ক্রম" এবং এটি এমন একটি যুগের সূচনা বোঝায় যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি স্বাধীন জাতি-রাষ্ট্র। ষড়যন্ত্র তত্ত্ববিদরা প্রায়শই এটিকে "নতুন বিশ্বব্যবস্থা" হিসাবে ভুল অনুবাদ করেন।

যদিও ফ্রিম্যাসনরির ইউরোপীয় মহাদেশীয় শাখায় এমন সংগঠন রয়েছে যেগুলি তাদের ম্যাসনিক লজের মধ্যে রাজনৈতিক আলোচনার অনুমতি দেয়, ম্যাসনিক গবেষক ট্রেভর ডব্লিউ ম্যাককিউন যুক্তি দেন যে এই অভিযোগগুলি বেশ কয়েকটি বিষয়কে উপেক্ষা করে। প্রথমত, অনেক গ্র্যান্ড লজ স্বাধীন এবং সার্বভৌম, যার অর্থ তারা স্বাধীনভাবে কাজ করে এবং তাদের একটি সাধারণ এজেন্ডা থাকে না। বিভিন্ন লজের বিশ্বাসের বিষয়গুলি প্রায়শই ভিন্ন হয়। দ্বিতীয়ত, বিখ্যাত ফ্রিম্যাসনরা সর্বদা রাজনৈতিক বর্ণালীর সমস্ত দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করেছেন, এতে কোনও নির্দিষ্ট পছন্দ নেই। এভাবে, "ম্যাসনিক সরকার" কথাটিই ভ্রান্ত; একটি আদর্শ সরকার কেমন হবে তা নিয়ে ফ্রিম্যাসনদের মধ্যে কোনও ঐক্যমত্য নেই।

ইলুমিনাটি সম্পাদনা

ইলুমিনাটি বা আলোকিতদের সংঘ ছিল একটি আলোকিত যুগের গুপ্ত সংগঠন। ১লা মে, ১৭৭৬ সালে বাভারিয়া, জার্মানিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অ্যাডাম ওয়াইসহপ্ট এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন। এই আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য ছিল মুক্তচিন্তা, ধর্মনিরপেক্ষতা, উদারনৈতিকতা, প্রজাতন্ত্রবাদ ও লিঙ্গসাম্যের মতো মূল্যবোধগুলোর প্রচার ও প্রসার। গঠনতন্ত্রে ওয়াইসহপ্ট ও তার অনুসারীরা অপ্রকাশ্য গোষ্ঠীগুলোর মাধ্যমে যুক্তিসঙ্গত চিন্তাধারা শেখানোর আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু ১৭৮৫ সালে বাভারিয়ার শাসক চার্লস থিওডোর গুপ্ত সংগঠনের কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করলে সমাজটি ভেঙে যায়। চার্লস থিওডোর মনে করেছিলেন, এসব সংগঠন বাভারিয়ার রাজতন্ত্র ও সরকারী ধর্ম রোমান ক্যাথলিকবাদকে উৎখাতের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকে, স্কটিশ পদার্থবিজ্ঞানী জন রবিসন এবং ফরাসি জেসুইট যাজক অগাস্টিন ব্যারুয়েল এর মতো রক্ষণশীলরা দাবি করতে শুরু করেন যে ইলুমিনাটি আসলে কখনো দমিত হয়নি। বরং, তারা ফরাসি বিপ্লব এবং এর পরবর্তী সন্ত্রাসের রাজত্বের পেছনে ইলুমিনাটির হাত রয়েছে বলে অভিযোগ করেন। ভয় ছিল, ইলুমিনাটি ধর্ম-বিরোধিতা, রাজতন্ত্র-বিরোধিতা, এবং পুরুষতান্ত্রিকতার-বিরোধিতার মতো আলোকিত যুগের চিন্তাধারাকে গোপনে ছড়িয়ে দিয়ে ইউরোপ ও বিশ্বে বিপ্লবী ঢেউ এনে দিতে চায়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে, ইউরোপের শাসকশ্রেণি এই ইলুমিনাটি ষড়যন্ত্রের ধারণাকে সিরিয়াসলি নেয় এবং এটি কল্পিত ভীতির বিরুদ্ধে তাদের নিপীড়নমূলক প্রতিক্রিয়াগুলি আসলে ১৮৪৮ সালের সেসব বিপ্লবগুলোকে উসকে দেয় যেগুলো প্রতিরোধ করাই তাদের লক্ষ্য ছিল।

বিংশ শতাব্দীর আন্তঃযুদ্ধকালীন সময়ে ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ নেস্টা হেলেন ওয়েবস্টার এবং আমেরিকান সমাজকর্মী ইডিথ স্টার মিলার এর মতো ফ্যাসিবাদী প্রচারকরা কেবল এই ইলুমিনাটি ষড়যন্ত্রের কল্পকাহিনীকেই জনপ্রিয় করেনি, বরং এটিও দাবি করেছিলেন যে ইলুমিনাটি আসলে ইহুদি অভিজাতদের একটি গোপন সংগঠন যারা বিশ্বকে বিভক্ত করে শাসন করার জন্য অর্থনৈতিক পুঁজিবাদ এবং সোভিয়েত কমিউনিজম উভয়কেই সমর্থন করে। মার্কিন মৌলবাদী খ্রিস্টান আন্দোলনের মধ্যে, জেরাল্ড বার্টন উইনরড-এর মতো ধর্মপ্রচারক, ইলুমিনাটি ষড়যন্ত্র তত্ত্বগুলির প্রচারে প্রধান ভূমিকা রাখেন। তারা আলোকিত যুগের ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদ, আধুনিকতা এবং উদারনীতির বিরুদ্ধে প্রচারণা চালায়।

১৯৭৫ সালে প্রকাশিত মার্কিন লেখক রবার্ট শিয়া এবং রবার্ট অ্যান্টন উইলসনের তিন খন্ডের উপন্যাস সিরিজ, "দ্য ইলুমিনেটাস! ট্রিলজি" হত্যাকারীদের নানারকম ষড়যন্ত্রকে ইলুমিনাটির সাথে জড়িয়ে দেয়। এই জনপ্রিয় বইটি ১৯৬০ এর দশক থেকে শুরু করে ইলুমিনাটি-সংক্রান্ত সুপার-কন্সপিরেসি তত্ত্বগুলিকে জনপ্রিয় করতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে।

'দ্য প্রটোকলস অফ দ্য এল্ডার্স অফ জায়ন' সম্পাদনা

'দ্য প্রটোকলস অফ দ্য এল্ডার্স অফ জায়ন' একটি বহুল প্রচলিত ইহুদি-বিরোধী প্রচারপত্র। ১৯০৩ সালে রাশিয়ান ভাষায় প্রকাশিত এই নথিতে একটি ইহুদি ও ফ্রিম্যাসন ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বিশ্ব আধিপত্য অর্জনের অভিযোগ তোলা হয়। এটি হতে চাওয়া বিশ্বনেতাদের একটি গোপন সভার কার্যবিবরণী হিসেবে নিজেকে দাবি করে। সেই ইহুদি প্রধানেরা নিজেদেরকে ঈশ্বরের মনোনীত প্রজা মনে করায়, বিশ্বকে তাদের অধীনে আনার জন্য ফ্রিম্যাসনদের ব্যবহার করে ষড়যন্ত্র করছে। 'দ্য প্রটোকলস' রাশিয়ার জার-বিরোধী আন্দোলনের উপর ইহুদিবিদ্বেষকে আরোপ করে রাজতন্ত্র ও সরকারি ধর্মের সমর্থক গোঁড়া রক্ষণশীলদের উদারনীতিবাদের সমালোচনার প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে। মূলত, এই প্রচারপত্রটির মাধ্যমে ফ্রিমেসন ষড়যন্ত্রের আড়াল থেকে এক ইহুদি মূলের প্রকাশ ঘটানোর চেষ্টা করা হয়।

আইরিশ সাংবাদিক ফিলিপ গ্রেভসের মতো কয়েকজন বিতার্কিক ১৯২১ সালে 'দ্য টাইমস' পত্রিকায় একটি নিবন্ধে প্রমাণ করেন যে 'দ্য প্রটোকলস' একটি জালিয়াতি এবং সাহিত্যকর্ম চুরির একটি স্পষ্ট নমুনা। ব্রিটিশ একাডেমিক নরম্যান কোহন ১৯৬৭ সালে তাঁর বই 'ওয়ারেন্ট ফর জেনোসাইড'-এ এটিকে একই যুক্তিতে সমর্থন করেন। সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত সত্য এই যে, রাশিয়ান-ফরাসি লেখক এবং রাজনৈতিক কর্মী মাতভেই গোলোভিনস্কি এই কুখ্যাত নথিটি রচনা করেন। তিনি রাশিয়ার গুপ্তপুলিশ 'ওখরানা'র জন্য ১৯০৫ সালের রাশিয়ান বিপ্লবের আগে এই বিপ্লববিরোধী প্রচারপত্রটি রচনা করেছিলেন। ফরাসি রাজনৈতিক কটূক্তিকার মরিস জলির লেখা নেপোলিয়ন তৃতীয়ের বিরুদ্ধে রচিত উনিশ শতকের ব্যঙ্গাত্মক রচনা 'দ্য ডায়ালগ ইন হেল বিটুইন ম্যাকিয়াভেলি অ্যান্ড মন্টেসকুই' থেকে প্রায় আক্ষরিকভাবে সাহিত্যচুরি করে এটি রচিত হয়।

বিংশ শতাব্দীর অনেক ইহুদিবিদ্বেষী ও ফ্রিমেসন-বিরোধী উন্মাদনার উৎস হিসেবে 'দ্য প্রটোকলস' দায়ী। কয়েকটি নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার তত্ত্বসহ বেশ কিছু সমসাময়িক ষড়যন্ত্র তত্ত্বের বিকাশে এটি যথেষ্ট প্রভাবশালী ছিল। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৮২ সালের বিতর্কিত বই 'দ্য হলি ব্লাড অ্যান্ড দ্য হলি গ্রেইল'-এর লেখকরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে 'দ্য প্রটোকলস' ছিল 'প্রাইরি অফ জায়ন'-এর অস্তিত্ব এবং কর্মকাণ্ডের সবচেয়ে প্ররোচনামূলক প্রমাণ। তাদের অনুমান ছিল যে এই গোপন সংগঠনটি ইউরোপের রাজতন্ত্র এবং হলি সি-এর সিংহাসন দখলকারী মেরোভিঙ্গিয়ান মহামান্য বংশধরের সম্রাজ্যবাদী ধর্মসংঘের মাধ্যমে ধর্মীয়ভাবে একীভূত "ইউনাইটেড স্টেটস অফ ইউরোপ" প্রতিষ্ঠার জন্য গোপনে কাজ করছে। এই 'পবিত্র ইউরোপীয় সাম্রাজ্য' একবিংশ শতাব্দীর পরাশক্তিতে পরিণত হতো। যদিও সাংবাদিক ও পণ্ডিতরা 'প্রাইরি অফ জায়ন'কে একটি প্রতারণা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, 'দ্য প্রটোকলস'কে সত্য বলে বিশ্বাসকারী কতিপয় ধর্মপ্রচারক, প্রাইরি অফ জায়নকে বাইবেলের ভবিষ্যদ্বাণীর পূর্ণতা মনে করেন। এটিকে তারা একটি নতুন বিশ্বব্যবস্থার আসন্ন হুমকির সূচক হিসেবে গ্রহণ করে।

অবিশ্বাসীদের যুক্তি হলো সমসাময়িক ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিকরা 'দ্য প্রটোকলস'-এর বিষয়বস্তুকে ভিন্ন কোন উৎস থেকে আসা বলে দাবি করেন। যেমন- পতিত ফেরেশতা বা ভিনগ্রহের আক্রমণকারী। ষড়যন্ত্রমনা ব্যক্তিরা এগুলো সত্যিই বিশ্বাস করে, নাকি একটি কুখ্যাত নথিকে গ্রহণযোগ্য করতে এই চেষ্টা করে – তা নির্ধারণ করা কঠিন। অবিশ্বাসীদের মতে, এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া খুব একটা ভিন্ন নয়, কারণ এতে আসল ইহুদিবিদ্বেষী পাঠ্যটিকেই অপরিবর্তিত রেখে 'দ্য প্রটোকলস'-কে বিশ্বাসযোগ্যতা ও প্রচার দেওয়া হচ্ছে।

রাউন্ড টেবিল সম্পাদনা

১৮১৫ থেকে ১৯১৪ পর্যন্ত ব্রিটিশ "সাম্রাজ্যবাদী শতকের" দ্বিতীয়ার্ধে, দক্ষিণ আফ্রিকায় জন্মগ্রহণকারী ব্রিটিশ ব্যবসায়ী, খনি-প্রভু, এবং রাজনীতিবিদ সিসিল রোডস ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পুনর্গঠনের পক্ষে কথা বলেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পুনঃঅধিগ্রহণ এবং শক্তিধর সাম্রাজ্যে পরিবর্তনের মাধ্যমে স্থায়ী বিশ্বশান্তি আনতে চেয়েছিলেন। ২৩ বছর বয়সে ১৮৭৭ সালে লেখা তার প্রথম ইচ্ছাপত্রে এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য একটি গুপ্ত সংগঠনের জন্য তহবিল দানের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। এই সংগঠন হিসেবে তিনি "সোসাইটি অফ দ্য ইলেক্ট" মনে করেছিলেন।

রোডসের উদ্দেশ্য ছিল:

  • সারা বিশ্বে ব্রিটিশ শাসন প্রসারিত করা
  • যুক্তরাজ্য থেকে বসতি স্থাপনের একটি ব্যবস্থা তৈরি করা
  • বিশেষ করে আফ্রিকা মহাদেশ, পবিত্র ভূমি, ইউফ্রেটিস উপত্যকা, সাইপ্রাস ও ক্রিট দ্বীপপুঞ্জ, পুরো দক্ষিণ আমেরিকা, গ্রেট ব্রিটেনের আগেকার অধিকৃত নয় এমন প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ, চীন ও জাপানের উপকূলীয় অঞ্চলসমূহ ব্রিটিশ উপনিবেশে পরিণত করা
  • শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে যুক্তরাষ্ট্র পুনরুদ্ধার করা
  • ঔপনিবেশিক প্রতিনিধিত্ব সহ ইম্পেরিয়াল পার্লামেন্টে এমন একটি ব্যবস্থা উদ্বোধন করা যা সাম্রাজ্যের বিচ্ছিন্ন সদস্যদের একত্রিত করতে পারে
  • এত বড় শক্তি অর্জন করা যাতে যুদ্ধকে অসম্ভব করে তোলা যায়, এবং মানবতার সর্বোত্তম স্বার্থ রক্ষা করা যায়

"তার বিখ্যাত ইচ্ছাপত্রের" তেরো বছর পর ১৮৯০ সালে রোডস একই ধারণা নিয়ে কাজ করেন: "সর্বত্র ইংল্যান্ড", যা "শেষ পর্যন্ত সমস্ত যুদ্ধ বন্ধ করে দেবে এবং সারা বিশ্বে একটি ভাষা চালু করবে।" তিনি বিশ্বাস করতেন, "এই ধারণা বাস্তবায়নের একমাত্র উপায় হচ্ছে একটি গুপ্ত সংগঠন যেটি ধীরে ধীরে বিশ্বের সম্পদ অর্জন করবে এবং এমন উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত হবে।"

রোডস রোডস স্কলারশিপের জন্যও মনোনিবেশ করেছিলেন। ব্রিটিশ রাষ্ট্রনায়ক আলফ্রেড মিলনার ছিলেন এই স্কলারশিপের অন্যতম অছি। ১৯০২ সালে প্রতিষ্ঠিত এই তহবিলের মূল লক্ষ্য ছিল অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বিনামূল্যে পড়াশোনা করে ভবিষ্যতের ব্রিটিশ, আমেরিকান এবং জার্মান নেতাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব এবং একটি সার্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ ঘটিয়ে মহাশক্তিগুলোর মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা।

মিলনার এবং ব্রিটিশ কর্মকর্তা লিওনেল জর্জ কার্টিস ছিলেন রাউন্ড টেবিল আন্দোলনের স্থপতি, যা ব্রিটেন ও তার স্ব-শাসিত উপনিবেশগুলোর মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরীর জন্য প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন সংগঠনের একটি নেটওয়ার্ক। এই মতাদর্শে এগিয়ে কার্টিস ১৯১৯ সালে রয়্যাল ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স প্রতিষ্ঠা করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রকে পুনরুদ্ধার সহ একটি সাম্রাজ্যিক ফেডারেশন তৈরির পক্ষে তার ১৯৩৮ সালের বই "দ্য কমনওয়েলথ অফ গড" এ কথা বলতে শুরু করেন। এই সংগঠনটির কাজ সমর্থন আদায়ের জন্য প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চগুলিকে ঈশ্বরের কাজ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছিল। ১৯৪৯ সালে কমনওয়েলথ অফ নেশনস তৈরি হয়েছিল, কিন্তু রোডস, মিলনার এবং কার্টিস কল্পিত শক্তিশালী সাম্রাজ্যিক ফেডারেশনের পরিবর্তে এটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অবাধ সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

১৯১৭ সালে নিউইয়র্কের একদল শিক্ষাবিদের মাধ্যমে কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স যাত্রা শুরু করে। রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন তাদেরকে আন্তঃযুদ্ধকালীন সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির বিকল্পগুলি নিয়ে ভাবতে অনুরোধ করেন। মূলত ব্রিটিশ ও আমেরিকান পণ্ডিত এবং কূটনীতিকদের একটি দল হিসাবে কল্পনা করা হয়েছিল (যাদের কেউ কেউ রাউন্ড টেবিল আন্দোলনের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন)। কিন্তু এটি পরর্বতীতে নিউইয়র্কের ১০৮ জন অর্থনীতিবিদ, উৎপাদক ও আন্তর্জাতিক আইনজীবীর মাধ্যমে সুসংগঠিত হয়। এদের নেতৃত্বে ছিলেন নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী এবং মার্কিন সেক্রেটারি অফ স্টেট এলিহু রুট। ১৯২১ সালের ২৯ শে জুলাই এটি আনুষ্ঠানিকভাবে কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স হিসেবে যাত্রা করে। ১৯২২ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত একটি ত্রৈমাসিক সাময়িকী 'ফরেন অ্যাফেয়ার্স' ছিল কাউন্সিলের প্রথম প্রকল্প।

১৯৬০-এর দশকে, জন বার্চ সোসাইটির মতো প্রভাবশালী রক্ষণশীল গোষ্ঠীগুলো প্রথমেই একটি অন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব ছড়াতে শুরু করে। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, 'অ্যাংলো-আমেরিকান এস্টাবলিশমেন্ট' বা ক্ষমতাধর গোষ্ঠী এবং বিশ্বব্যাংকের মত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আড়ালে একদল ধনকুবের ক্ষমতার লোভে একটি একক বিশ্বসরকার প্রতিষ্ঠার চক্রান্ত করছে। এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বের সমর্থকরা বিশ্বাস করতেন যে এই আন্তর্জাতিক ব্যাংকাররা মার্কিন সার্বভৌমত্ব ধ্বংসের মাধ্যমে পুরো বিশ্বকে তাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে চায়।

ইতিহাসবিদ ক্যারল কুইগলির ১৯৬৬ সালের বই 'ট্র্যাজেডি অ্যান্ড হোপ' -এর গবেষণা ফলাফল এই বিশ্বাসকে দৃঢ় করেছিল, যদিও তিনি দাবি করেছিলেন সারা বিশ্ব নিয়ন্ত্রণের চক্রান্ত মূলত ব্রিটিশ ও আমেরিকানদের উচ্চবিত্ত শ্রেণির আর্থিক স্বার্থ দ্বারা চালিত একটি উদ্যোগ। কুইগলি আরও বলেন যে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় যে প্রভাবশালী গোষ্ঠীগুলো ক্ষমতায় ছিল তাদের প্রভাব দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং সুয়েজ সংকটের পর ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে। আজকের দিনে, এই ষড়যন্ত্রবাদীদের মতে, মূলতঃ কোন নির্দিষ্ট গোষ্ঠী সঠিকভাবে বিশ্বকে পরিচালনা করছে না।

ল্যারি ম্যাকডোনাল্ড, যিনি জন বার্চ সোসাইটির দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাউস অফ রিপ্রেজেনটেটিভস এর সদস্য ছিলেন, তিনি গ্যারি অ্যালেনের ১৯৭৬ সালের বই 'দ্য রকফেলার ফাইল' এর ভূমিকা লিখেছিলেন। তিনি দাবি করেছিলেন যে, রকফেলার পরিবার এবং তাদের সহযোগীরা একটি একক বিশ্ব সরকার প্রতিষ্ঠার বাসনা থেকে অনুপ্রাণিত, যেখানে একদিকে যেমন উগ্র-পুঁজিবাদ থাকবে তেমনি থাকবে কমিউনিজমও; আর পুরো সরকার থাকবে তাদের নিয়ন্ত্রণে। তিনি যা দেখছিলেন তা ছিল "আন্তর্জাতিক পরিসরে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে পরিকল্পিত এবং অবিশ্বাস্যভাবে অশুভ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত একটি ষড়যন্ত্র।"

ডেভিড রকফেলার ২০০২ সালে তার আত্মজীবনী "মেমোয়ার্স"-এ লিখেছেন:

"এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে, রাজনৈতিক বর্ণালীর উভয় প্রান্তের মতাদর্শগত চরমপন্থীরা সু-প্রচারিত ঘটনাগুলোকে কেন্দ্র করে... আমেরিকান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের ওপর আমাদের অস্বাভাবিক প্রভাবের দাবি করে রকফেলার পরিবারকে আক্রমণ করে আসছে। কেউ কেউ এমনকি বিশ্বাস করে যে আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করা একটি গোপন চক্রের অংশ, আমার পরিবার এবং আমাকে 'আন্তর্জাতিকতাবাদী' হিসাবে চিহ্নিত করে এবং আরও সংহত বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো -আপনি যদি চান তাহলে একটি বিশ্ব গড়ে তোলার জন্য সারা বিশ্বের অন্যদের সাথে ষড়যন্ত্র করে আসছি। যদি এটাই অভিযোগ হয়, তাহলে আমি দোষী, এবং আমি এতে গর্বিত।"

বার্কুন যুক্তি দেন যে এই বিবৃতিটি আংশিকভাবে রসাত্মক (ষড়যন্ত্র এবং বিশ্বাসঘাতকতার দাবি) এবং আংশিকভাবে গুরুতর— মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং জাপানের মধ্যে ত্রিপাক্ষিক সহযোগিতাকে উৎসাহিত করার বাসনা তুলে ধরা হয়েছে; উদাহরণস্বরূপ — এমন একটি আদর্শ যা রিপাবলিকান পার্টির আন্তর্জাতিকতাবাদী অংশের বৈশিষ্ট্য ছিল (নেলসন রকফেলারের সম্মানে "রকফেলার রিপাবলিকান" নামে পরিচিত) যখন এখানে আন্তর্জাতিকতাবাদী উইং ছিল। যাইহোক, এই বিবৃতিটিকে অলংকার বাদ দিয়ে অক্ষরে অক্ষরে নিয়ে ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিকরা ব্যাপকভাবে উদ্ধৃত করেছেন। তাদের যুক্তি হল - কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স আমেরিকান প্রেসিডেন্ট, সিনেটর এবং প্রতিনিধিদের মস্তিষ্ক হিসেবে নিজেদের ভূমিকা ব্যবহার করে তাদেরকে একটি এক বিশ্ব সরকার আকারে নতুন বিশ্বব্যবস্থা সমর্থন করার ক্ষেত্রে প্ররোচিত করে।

২০০৭ সালের ১৩ নভেম্বর কানাডিয়ান সাংবাদিক বেঞ্জামিন ফুলফোর্ডের সাথে একটি সাক্ষাত্কারে, রকফেলার পাল্টা যুক্তি দিয়ে বলেন যে, তিনি বিশ্ব সরকারের কোনও প্রয়োজন অনুভব করেন না এবং বিশ্বের সরকারগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার আকাঙ্ক্ষা করেন। তিনি আরও বলেন যে বিশ্বব্যাপী শাসন করার জন্য মাত্র একটি নির্বাচিত সরকার থাকা সম্ভবত বাঞ্ছনীয়ও নয়। তিনি "বিশ্বের শাসক" হওয়ার অভিযোগকে অযৌক্তিক বলে সমালোचना করেছেন।

লরেন্স এইচ. শৌপের মতো কিছু আমেরিকান সামাজিক সমালোচক যুক্তি দেন যে কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স হল একটি "সাম্রাজ্যবাদী মস্তিষ্ক ট্রাস্ট" যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী আন্তর্জাতিক এবং স্নায়ুযুদ্ধের জন্য মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির বিকল্পগুলো নির্ধারণ করে পর্দার পিছনে থেকে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে আসছে। কী কী বিকল্প আলোচনার টেবিলে উঠবে আর কোনগুলো উঠবেই না, তা তারাই ঠিক করতো। অন্যদিকে, জি. উইলিয়াম ডমহফের মতো আরও অনেকে যুক্তি দেন যে এটি আসলে একটি নীতি-আলোচনা ফোরাম যেটি মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি পরিকল্পনায় ব্যবসায়িক ইনপুট সরবরাহ করে। ডমহফ যুক্তি দেন যে "[এর] প্রায় ৩,০০০ সদস্য রয়েছে, গোপন পরিকল্পনা গোষ্ঠীর মধ্যে রাখার জন্য অনেক বেশি। কাউন্সিল শুধুমাত্র আলোচনা গোষ্ঠী, বিতর্ক এবং বক্তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করে। গোপনীয়তা বজায় রাখার মতো কিছু নয়, এটি বার্ষিক প্রতিবেদন জারি করে এবং এর ঐতিহাসিক সংরক্ষণাগারে প্রবেশের অনুমতি দেয়।" তবে, এই সমস্ত সমালোচক একমত যে "CFR-এর ঐতিহাসিক গবেষণাগুলি দেখায় যে ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিকদের দ্বারা দাবি করা মোট ক্ষমতা কাঠামোর চেয়ে এর ভূমিকা অনেকটাই ভিন্ন।"

দ্য ওপেন কন্সপিরেসি সম্পাদনা

১৯২৮ সালে প্রকাশিত তাঁর বই 'দ্য ওপেন কন্সপিরেসি'-তে ব্রিটিশ লেখক এবং ভবিষ্যদ্বক্তা এইচ. জি. ওয়েলস আন্তর্জাতিকতাবাদের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন। তিনি বিশ্ব-বিপ্লবের একটি নকশাও প্রস্তাব করেন যার মাধ্যমে একটি প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বরাষ্ট্র এবং পরিকল্পিত অর্থনীতি প্রতিষ্ঠিত হবে। তবে, ১৯৪০ সালে প্রকাশিত ‘দ্য নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার’ গ্রন্থে ওয়েলস সতর্কবার্তাও উচ্চারণ করেন:

... যখন দেখা যাবে যে পৃথিবী একটি গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার দিকে স্পষ্টভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, তখনও এই ব্যবস্থা কার্যকরী ও উপকারী বিশ্বব্যবস্থায় পরিণত হতে ব্যাপক বিলম্ব এবং হতাশার সম্মুখীন হতে পারে। অসংখ্য মানুষ… এই নতুন বিশ্বব্যবস্থাকে ঘৃণা করবে, এর আগমনের ফলে তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষাগুলো ধূলিসাৎ হবে এবং এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে করতে তারা মৃত্যুবরণ করবে। এই নতুন বিশ্বব্যবস্থার প্রতিশ্রুতিকে মূল্যায়ন করার সময়, আমাদের এই হতাশ এবং ক্ষুব্ধ মানুষের প্রজন্মের কষ্টের কথা মাথায় রাখতে হবে। তাদের অনেকেই হবেন সাহসী এবং মার্জিত।

ওয়েলসের বইগুলি ‘নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার’ (নতুন বিশ্বব্যবস্থা) পরিভাষাটির একটি দ্বিতীয় অর্থ প্রদান করে, যেটি আগামী প্রজন্মের রাষ্ট্রীয় সমাজতান্ত্রিক সমর্থক এবং সাম্যবাদ-বিরোধীদের দ্বারা বহুল ব্যবহৃত হবে। যদিও ওয়েলসের চিন্তাধারা জনপ্রিয়তা এবং কুখ্যাতি অর্জন করে, তিনি একটি গভীর এবং দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব সৃষ্টিতে ব্যর্থ হন। কারণ তিনি বুদ্ধিজীবীদের উদ্দেশ্যে সরাসরি আবেদনের মাধ্যমে নিজের শক্তি কেন্দ্রীভূত করতে পারেননি। অথচ, এই বুদ্ধিজীবীরাই শেষমেশ ওয়েলসীয় নতুন বিশ্বব্যবস্থাকে বাস্তবায়ন করতে পারতেন।

নব যুগ সম্পাদনা

ব্রিটিশ নব্য-থিওসফিক্যাল অকাল্টিস্ট (গূঢ়বিদ) অ্যালিস বেইলি, তথাকথিত নব যুগ আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, ১৯৪০ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তির ওপর মিত্রশক্তির চূড়ান্ত বিজয়ের ভবিষ্যদ্বাণী করেন (যা ১৯৪৫ সালে ঘটেছিল)। তিনি মিত্রবাহিনী কর্তৃক একটি রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নতুন বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠারও কথা বলেন। ওয়েলসের মুক্ত ষড়যন্ত্রের চূড়ান্ত পরিনতি হিসেবে তিনি একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় বিশ্ব সরকার কল্পনা করেন। তবে, তিনি আরও যুক্তি দেখান যে এই ব্যবস্থাটি সিনারকিস্ট (synarchist) হবে কারণ এটি প্রাচীন জ্ঞানের মহাজ্ঞানীদের দ্বারা পরিচালিত হবে, যারা খ্রিস্টের দ্বিতীয় আগমনের জন্য মানবতাকে প্রস্তুত করতে চায়। বেইলির মতে, মহা শ্বেত ভ্রাতৃত্ব (Great White Brotherhood) নামে পরিচিত একদল আরোহণপ্রাপ্ত মহাজ্ঞানীরা নতুন বিশ্বব্যবস্থায় রূপান্তরের তত্ত্বাবধান করার জন্য অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে কাজ করে। কিন্তু আপাতত, এই আধ্যাত্মিক শ্রেণিবিন্যাসের সদস্যরা কয়েকজন গূঢ়বিদের কাছেই পরিচিত, যাদের সাথে তারা টেলিপ্যাথির মাধ্যমে যোগাযোগ করে। তবে যেহেতু প্রকল্প বাস্তবায়নে তাদের ব্যক্তিগত সম্পৃক্ততার প্রয়োজন দিন দিন বাড়ছে, শ্রেণীবিন্যাসের বহিরাগমন ঘটবে এবং তখন সবাই পৃথিবীতে তাদের উপস্থিতি সম্পর্কে জানতে পারবে।

বেইলির রচনা, মার্কিন লেখক মেরিলিন ফার্গুসনের ১৯৮০ সালের বই “The Aquarian Conspiracy” এর পাশাপাশি, খ্রিস্টান ধর্মীয় রক্ষণশীলদের ষড়যন্ত্র তত্ত্বের জন্ম দেয়। তাদের মতে নব যুগ আন্দোলন ছিল সেই "মিথ্যা ধর্ম" যা নতুন বিশ্বব্যবস্থায় খ্রিস্টধর্মের স্থান নেবে। সংশয়বাদীরা যুক্তি দেখান যে "নব যুগ আন্দোলন" শব্দটি একটি ভুল নাম, যা সাধারণত ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিকরা যেকোনো নতুন ধর্মীয় আন্দোলনের জন্য ব্যবহার করে, যা মৌলবাদী খ্রিস্টান নয়। এই যুক্তি অনুসারে, যা কিছু খ্রিস্টীয় নয় তা সংজ্ঞা অনুসারে সক্রিয়ভাবে এবং ইচ্ছাকৃতভাবে খ্রিস্টান বিরোধী।

বিরোধাভাসের বিষয় হল, একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশক থেকে, নতুন বিশ্বব্যবস্থার ষড়যন্ত্র তত্ত্ব নব যুগের গূঢ়বিদের দ্বারা ক্রমবর্ধমানভাবে গৃহীত এবং প্রচারিত হচ্ছে। এরা এমন লোক যারা যুক্তিবাদে বিরক্ত এবং বিকল্প চিকিৎসা, জ্যোতিষশাস্ত্র, কোয়ান্টাম রহস্যবাদ, আধ্যাত্মবাদ এবং থিওসফির মতো কলঙ্কিত জ্ঞানের দ্বারা আকৃষ্ট হয়। সুতরাং, 'এসোটেরিক এজেন্ডা'র মতো তথ্যচিত্রের নির্মাতারা দাবি করেন যে নতুন বিশ্বব্যবস্থার পক্ষে ষড়যন্ত্র করা বৈশ্বিক নেতারা কেবল ম্যাকিয়াভেলিয়ান লক্ষ্যের জন্য অকাল্টিজমের অপব্যবহার করছে। উদাহরণস্বরূপ, তারা নতুন বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সঠিক তারিখ হিসেবে ২১শে ডিসেম্বর, ২০১২ কে বেছে নেয়, নবযুগের লেখক জোসে আরগুয়েলেস, টেরেন্স ম্যাককেনা এবং ড্যানিয়েল পিঞ্চবেকের মায়ানবাদী তত্ত্বগুলির ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার সুযোগ নিতে।

সংশয়বাদীরা যুক্তি দেখান যে ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিক এবং গূঢ়বিদদের মধ্যে সংযোগ তাদের সাধারণ ভ্রান্ত ধারণাগুলি থেকে উদ্ভূত হয়। প্রথমত, যেকোনো বহুল প্রচলিত বিশ্বাস অগত্যা মিথ্যা হতে হবে। দ্বিতীয়ত, কলঙ্কিত জ্ঞান —যা প্রতিষ্ঠানেরা তিরস্কার করে— তা অবশ্যই সত্য হতে হবে। এর ফলে একটি বৃহৎ, স্ব-রেফারেন্সিয়াল নেটওয়ার্ক তৈরি হয় যেখানে, উদাহরণস্বরূপ, কিছু ইউএফও ধর্মাবলম্বীরা ইহুদিবিরোধী ফোবিয়াকে উস্কে দেয় যেখানে কিছু ইহুদিবিদ্বেষীরা পেরুভিয়ান শামানবাদ অনুশীলন করে।

চতুর্থ রাইখ সম্পাদনা

ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিকরা প্রায়শই "চতুর্থ রাইখ" শব্দটি "নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডারের" একটি নিন্দনীয় প্রতিশব্দ হিসাবে ব্যবহার করে, এক্ষেত্রে বোঝানো হয় যে এর রাষ্ট্রীয় মতাদর্শ এবং সরকার জার্মানির তৃতীয় রাইখের অনুরূপ হবে।

আমেরিকান লেখক জিম মারসের মতো ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিকরা দাবি করেন যে, কিছু প্রাক্তন নাৎসি যারা গ্রেটার জার্মান রাইখের পতন থেকে বেঁচে গিয়েছিল, তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যত্র ODESSA এবং Die Spinne-এর মতো সংস্থাগুলির মাধ্যমে আশ্রয় পেয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির পর থেকে তারা বিশ্বব্যাপী সংস্কৃতি, সরকার এবং ব্যবসায়ে নাৎসিবাদের অন্তত কিছু নীতি (যেমন, সামরিকবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, নাগরিকদের উপর ব্যাপক গুপ্তচরবৃত্তি, কর্পোরেশনবাদ, জাতীয় ঐক্যমত তৈরিতে প্রচার ব্যবহার) বাস্তবায়নের জন্য zákulis থেকে কাজ করছে। তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মহাকাশ উৎপাদনের উন্নতির জন্য অপারেশন পেপারক্লিপের অধীনে আনা সাবেক নাৎসি বিজ্ঞানীদের প্রভাব, এবং যুদ্ধের পরে ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রাক্তন-নাৎসি এবং তাদের সহানুভূতিশীলদের দ্বারা বৃহৎ সমষ্টির অধিগ্রহণ ও সৃষ্টিকেই এর প্রমাণ হিসেবে উদ্ধৃত করে।

এই নব্য-নাৎসি ষড়যন্ত্রটি একটি "আয়রন ড্রিম" দ্বারা অনুপ্রাণিত বলে জানা যায়, যাতে আমেরিকান সাম্রাজ্য জুডিও-ম্যাসনিক ষড়যন্ত্রকে ব্যর্থ করে দেয় এবং সরকারের দখলদার জায়নবাদীদের উৎখাত করে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ধীরে ধীরে "পশ্চিমা সাম্রাজ্য" নামের একটি চতুর্থ রাইখ গড়ে ওঠে - অ্যাডলফ হিটলারের নিউ অর্ডারের আদলে একটি প্যান-আর্য বিশ্ব সাম্রাজ্য। এই নব্য সাম্রাজ্য "পশ্চিমের পতন" কে রোধ করবে এবং শ্বেতাঙ্গদের আধিপত্যের একটি নতুন স্বর্ণযুগের সূচনা করবে।

অন্যদিকে, সন্দেহবাদীরা যুক্তি দেখান যে ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিকরা আমেরিকান সমাজে সাবেক-নাৎসি ও নব্য-নাৎসিদের প্রভাবকে মাত্রাতিরিক্তভাবে অতিরঞ্জিত করে। তারা আরও উল্লেখ করে যে, দেশে রাজনৈতিক দমন এবং বিদেশে সাম্রাজ্যবাদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে যা বিংশ শতাব্দীর আগেরও। রাজনৈতিক তাত্ত্বিক শেলডন উলিন উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে গণতন্ত্রের ঘাটতি এবং মহাশক্তির অবস্থান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি "বিপরীত স্বৈরাচার" (inverted totalitarianism) -এর উত্থানের পথ প্রশস্ত করেছে, যা নাৎসিবাদের অনেক নীতির সাথেই সাংঘর্ষিক।

এলিয়েনদের আক্রমণ সম্পাদনা

১৯৭০-এর দশকের শেষভাগ থেকে, অন্যান্য বাসযোগ্য গ্রহ বা সমান্তরাল মাত্রা (যেমন "গ্রে") থেকে আগত ভিনগ্রহী এবং পাতাললোক (যেমন "রেপটিলিয়ান") থেকে আসা প্রাণীদেরকে নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার ষড়যন্ত্রের সাথে যুক্ত করা হয়েছে। মার্কিন লেখক স্ট্যান ডেয়ো এবং মিল্টন উইলিয়াম কুপার, এবং ব্রিটিশ লেখক ডেভিড ইকের তত্ত্বগুলিতে এদেরকে কম-বেশি প্রভাবশালী চরিত্র হিসেবে দেখানো হয়েছে।

এসব ষড়যন্ত্র তত্ত্বের মূল ভাবনা এই যে, এলিয়েনরা আমাদের মাঝে দশক, শতাব্দী এমনকি সহস্রাব্দ ধরে রয়েছে। কিন্তু, "মেন ইন ব্ল্যাক" দ্বারা চালিত একটি সরকারি গোপনীয়তা মানুষকে একটি গোপন এলিয়েন আক্রমণের ব্যাপারে জানা থেকে বঞ্চিত করেছে। বর্ণ-শ্রেষ্ঠত্ববাদ ও সাম্রাজ্যবাদের উদ্দেশ্যে চালিত হয়ে এই এলিয়েনরা নিয়ন্ত্রণের সুবিধার্থে, গোপনে মানব সমাজের বিকাশ ও পরিবর্তনগুলো প্রভাবিত করে আসছে। কিছু কিছু তত্ত্বানুযায়ী, এলিয়েন অনুপ্রবেশকারীরা মানুষের রূপ ধারণ করেছে এবং মানুষের সমাজে অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এমনকি তারা সরকারি, বেসরকারি এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদ দখল করে নিয়েছে এবং এখন বিশ্বদখলের চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি কল্পিত গুপ্ত সরকারি সংস্থা, "ম্যাজেস্টিক ১২" কে প্রায়ই একটি 'শ্যাডো গভর্নমেন্ট' হিসেবে কল্পনা করা হয় যারা এলিয়েনদের শাসনের সাথে মিলে কাজ করছে এবং এলিয়েনদের অপহরণ কর্মকাণ্ডে সহায়তা করছে। এর বিনিময়ে তারা এরিয়া ৫১-এ সামরিক "ফ্লাইং সসার" তৈরি ও পরীক্ষণে এলিয়েনদের সাহায্য নিচ্ছে, যাতে মার্কিন সামরিক বাহিনী সর্বময় ক্ষমতাধর হয়ে উঠতে পারে।

অজ্ঞাত বস্তু সনাক্তকরণের ক্ষেত্রে যারা সমাজমনস্তাত্ত্বিক প্রকল্প মেনে চলেন, তারা এই যুক্তি দেখান যে নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার এর ষড়যন্ত্রতত্ত্ব ও ইউএফও-বিষয়ক ষড়যন্ত্রের একত্রীকরণ কেবল এই যুগের সরকারের প্রতি ব্যাপক অনাস্থা এবং ইউএফও-দের ক্ষেত্রে ভিনগ্রহ-প্রকল্পের জনপ্রিয়তার ফসলই নয়, বরং চরম-দক্ষিণপন্থীদের সাথে ইউএফও অনুসন্ধানীদের হাত মেলানোরও ফল। বারকুন মন্তব্য করেছেন যে, এই ঘটনার একমাত্র ইতিবাচক দিক হলো যে, যদি বিশ্বশাসনের ষড়যন্ত্রকারীদের এলিয়েন মনে করা হয়, তাহলে প্রচলিত মানবিক বলির পাঠা (ফ্রিম্যাসন, ইলুমিনাতি, ইহুদি ইত্যাদি) গুরুত্ব হারাবে বা অব্যাহতি পাবে।

ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড সম্পাদনা

বিজ্ঞান-বিরোধী এবং 'নব্য-লাডাইট ষড়যন্ত্র তত্ত্ববিদরা' (neo-Luddite Conspiracy Theorists) তাদের 'নতুন বৈশ্বিক শৃঙ্খলা' (New World Order) ষড়যন্ত্র তত্ত্বের মাধ্যমে প্রযুক্তি-ভবিষ্যদ্বাণীকে বিশেষভাবে গুরুত্ব প্রদান করেন। তাঁরা ধারণা করেন যে, বৈশ্বিক ক্ষমতাধর গোষ্ঠীটি হল প্রতিক্রিয়াশীল আধুনিকতাবাদী যারা 'উত্তর-মানব শাসকগোষ্ঠী' (posthuman ruling caste) হিসেবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ট্রান্সহিউমানিস্ট (transhumanist) পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সচেষ্ট। তাঁদের এই পরিকল্পনার লক্ষ্য হল মানব-ক্ষমতা বৃদ্ধির কৌশল ও প্রযুক্তির উন্নয়ন ও ব্যবহার। অন্যদিকে, একটি তাত্ত্বিক ভবিষ্যৎ মুহূর্ত 'প্রযুক্তিগত এককত্ব' -র (technological singularity) দিকে ত্বরান্বিত পরিবর্তন ঘটছে যেখানে ঘটনাবলী এতই দ্রুত এগিয়ে চলবে যে, সাধারণ মানুষের পক্ষে তাদের আশেপাশের এই দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্ব সম্পর্কে কোনরকম পূর্বাভাস দেয়া বা একে বোঝা দুটোই অসম্ভব হয়ে পড়বে। ষড়যন্ত্র তত্ত্ববিদরা আশঙ্কা করেন যে এই সবের পরিণতি হিসেবে হয় একটি 'ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড' এর মতো নিয়ন্ত্রিত ভবিষ্যৎ সমাজের উত্থান ঘটবে - একটি "ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার," অথবা মানবজাতির বিলুপ্তি ঘটবে।

মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী জেমস হিউজ-এর মতো গণতান্ত্রিক ট্রান্সহিউমানিস্টরা বিপরীত যুক্তি উপস্থাপন করেন। তাঁরা বলেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতাধর মহলের অনেক প্রভাবশালী সদস্যই আসলে 'বায়োকনজারভেটিভ' যারা মানবদেহের ক্ষমতা বৃদ্ধি সংক্রান্ত যেকোনো প্রযুক্তির তীব্র বিরোধী। এর প্রমাণ হিসেবে তিনি প্রেসিডেন্ট বুশের 'কাউন্সিল অন বায়োএথিক্স' কর্তৃক মানব ক্লোনিং এবং জার্মলাইন ইঞ্জিনিয়ারিং নিষিদ্ধ করার উদ্দেশ্যে একটি আন্তর্জাতিক চুক্তির প্রস্তাবকে উল্লেখ করেন। তিনি আরও যুক্তি দেখান যে, ষড়যন্ত্র তত্ত্ববিদরা ট্রান্সহিউমানিস্ট আন্দোলন আসলে কতটা প্রান্তিক তা অবমূল্যায়ন করেন।

সমালোচনা সম্পাদনা

অনেক সমালোচক নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডারের সমর্থকদের বলেন যে তারা বড় বড় ঐতিহাসিক ঘটনার পেছনে সবসময়ই অসৎ উদ্দেশ্য খুঁজে পেতে চান। সমালোচকদের মতে ইতিহাসে বড় পরিবর্তনগুলোর পেছনে প্রায়ই সামাজিক ও অর্থনৈতিক শক্তির প্রভাব থাকে, গোপন ষড়যন্ত্র থাকে না।

সমালোচকরা বলেন যে এই তত্ত্বে বিশ্বাসী মানুষেরা নানারকম অমূলক ভীতি মনে লালন করে, যার কোনো যুক্তিগ্রাহ্য ভিত্তি নেই।

মার্কসবাদীরা, যারা ডানপন্থীদের এইসব ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বিশ্বাস করে না, তারাও বিশ্বশক্তির কাঠামো নিয়ে সমালোচক। তাদের মতে, বিশ্বের ক্ষমতাধর শ্রেণি সাধারণ মানুষের ভালো চায় না। আবার অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থাতেও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অভাব আছে। তবে, মার্কসবাদীদের মতে বড় ধনিক শ্রেণি শুধু নিজেদের স্বার্থ দেখে এবং বিশ্বে নয়া-উদারনীতির বাজার ও সামরিক শক্তি দিয়ে একচ্ছত্র আধিপত্য চায়। এর চেষ্টাকেই তারা "নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার" বলে থাকেন। মার্কসবাদীরা মনে করেন যে বিশ্ব এখন আমেরিকান শাসনের যুগ থেকে ধীরে ধীরে সরে এসে এক বিশ্বব্যাপী শাসক শ্রেণীর দিকে যাচ্ছে, যদিও তা আমেরিকা থেকে উঠে এসেছে। কট্টর কমিউনিজম-বিরোধিতায় আচ্ছন্ন হয়ে, ডানপন্থী ষড়যন্ত্রবাদীরা তাদের মূল লক্ষ্যকেই ("নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার") ভুল বুঝে ফেলে। Ironically, এটি হলো মূলধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার সর্বোচ্চ পর্যায় - একই ব্যবস্থা যা এইসব ষড়যন্ত্রবাদীরা রক্ষা করতে চায়।

ডমহফ, মনোবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং ক্ষমতার তত্ত্ব নিয়ে গবেষক, ২০০৫ সালে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন যেখানে তিনি যুক্তি দেখান ১% ধনী ও শিক্ষিত লোকের একসাথে এমনভাবে কাজ করা অসম্ভব যাতে এই ষড়যন্ত্রগুলো সত্যি হয়। তার মতে, এইসব দাবি বহুদশক ধরে করা হয়েছে এবং সবসময়ই ভুল প্রমাণিত হয়েছে।

ডিপ্লোম্যাটিক কুরিয়ার ম্যাগাজিনের সম্পাদক পার্টিজ ২০০৮ সালে একটি প্রবন্ধ লেখেন যেখানে বলেন যে বিশ্বসরকার তৈরির চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে, যদি কিছু হয় তবে তা হলো বিশ্বজুড়ে জাতীয়তাবাদের উত্থান।

অনেক সমালোচকের মতে এই নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার বিশ্বাসী সাধারণ মানুষ হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়ে, তাদের চিন্তাধারা জটিল হয়ে যায়। এমনকি যখন তারা সম্ভাব্য ষড়যন্ত্রকারীদের সমালোচনা করে, তারপরও পরিস্থিতি আশাহীন মনে হয়।

সাউদার্ন পভার্টি ল' সেন্টারের আলেক্সান্ডার জাইটচিক একটি রিপোর্টে দাবি করেন যে এইসব অমূলক ষড়যন্ত্র তত্ত্ব আসলে র‍্যাডিকাল ডানপন্থীদের সমাজকে অস্থিতিশীল করার একটি চেষ্টা মাত্র।

নতুন বিশ্বব্যবস্থা (নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার) সম্পর্কিত অধিকাংশ ষড়যন্ত্র তত্ত্বের আশু বিপর্যয় প্রবণতাই যে একক উগ্রবাদীদের ('lone wolves') নেতৃত্বহীন প্রতিরোধের মাধ্যমে ওকলাহোমা সিটি বোমা হামলার মতো ঘরোয়া সন্ত্রাসী ঘটনার দিকে চালিত করতে পারে, সে ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করে বার্কুন লেখেন, "বিপদ এই বিশ্বাসগুলোতে নয়... বরং সেই আচরণে নিহিত যা তারা উস্কে দিতে বা ন্যায্যতা দিতে পারে"। তিনি আরও সতর্ক করে বলেন, "যদি তারা বিশ্বাস করে যে ভবিষ্যদ্বাণী করা মন্দ দিনটি আসলে এসে গেছে, তবে তাদের আচরণের ভবিষ্যদ্বাণী করা অনেক বেশি কঠিন হয়ে যাবে।"

ডানপন্থী জনতাবাদী আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা মিথ্যাচারী নেতারা জনগণকে ভয় দেখিয়ে এমনকি ফ্যাসিবাদী বিপ্লব ঘটানোর চেষ্টা করতে পারেন। এই বিষয়ে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বারলেট লেখেন, "ডানপন্থী জনতাবাদী (populist) আন্দোলন একটি সমাজের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে কারণ তারা প্রায়শই বিদেশী বিদ্বেষ, কর্তৃত্ববাদ, বলির পাঠা নির্ধারণ এবং ষড়যন্ত্রমূলক চিন্তাকে জনপ্রিয় করে তোলে। এটি মূলধারার রাজনীতিবিদদের ভোটার আকর্ষণ করতে এই থিমগুলিকে গ্রহণ করতে, বৈষম্যমূলক কর্মকাণ্ডকে (এমনকি সহিংসতাকে) বৈধতা দিতে এবং সংস্কারবাদী জনতাবাদী আন্দোলন থেকে ফ্যাসিবাদ এর মতো বিপ্লবী ডানপন্থী জনতাবাদী আন্দোলনের জন্য নিয়োগের দরজা খুলে দিতে পারে।"

ধর্ম বিষয়ের অধ্যাপক হিউজেস সতর্ক করেছেন যে, 'নতুন বিশ্বব্যবস্থা' (নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার) এর চেয়ে বৈশ্বিক রাজনীতিকে মারাত্মকভাবে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করার মতো ধারণা আর নেই । তিনি ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে "রিভেলেশন, রেভলিউশনস অ্যান্ড দ্য টাইরানিকাল নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার" শিরোনামের একটি নিবন্ধে লেখেন, "এই ধাঁধার গুরুত্বপূর্ণ অংশটি হল অ্যান্টিক্রাইস্টের পরিচয়, সেই স্বৈরাচারী ব্যক্তিত্ব যিনি নতুন বিশ্বব্যবস্থাকে নেতৃত্ব দেন এবং অনুপ্রাণিত করেন"। [অতীতে] এটি সোভিয়েত ইউনিয়ন বা আরব বিশ্বকে নির্দেশ করেছে। তিনি বলেন, এটি বিশ্বাসীদের "ইসলামী বিশ্বের সাথে যুদ্ধকে স্বাগত জানাতে" অনুপ্রাণিত করে এবং পারমাণবিক ধ্বংসযজ্ঞের দরজা খুলে দেয়।"

নতুন বিশ্বব্যবস্থা সম্পর্কিত ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিকদের সমালোচনা তাদের নিজেদের সম্প্রদায়ের মধ্য থেকেই আসে। নিজেদেরকে "স্বাধীনতা সংগ্রামী" বলে বিশ্বাস করা সত্ত্বেও, অনেক ডানপন্থী জনতাবাদী ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিকরা এমন মতামত রাখেন যা তাদের ঘোষিত স্বাধীনতাবাদী মতাদর্শের সাথে সাংঘর্ষিক, যেমন খ্রিস্টান আধিপত্যবাদ, কর্তৃত্ববাদী উগ্র জাতীয়তাবাদ, শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদ এবং নির্মূলবাদ। এই বিরোধিতার কারণেই আইক নামক একজন তাত্ত্বিক, যিনি যুক্তি দেন যে খ্রিস্টান দেশপ্রেমিকরাই একমাত্র আমেরিকান যারা নতুন বিশ্বব্যবস্থা সম্পর্কে সত্য বোঝে (যা তিনি বিশ্বাস করেন "ব্যাবিলনীয় ব্রাদারহুড" নামের সরীসৃপদের একটি জাতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত), তিনি একটি খ্রিস্টান দেশপ্রেমিক দলকে বলেছিলেন, "আমি জানি না ব্রাদারহুড দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বিশ্ব, নাকি তোমরা যেটি দিয়ে সেটিকে প্রতিস্থাপন করতে চাও, কোনটি আমার বেশি অপছন্দ।"