নবকৃষ্ণ দেব

ভারতীয় রাজনৈতিক প্রতিনিধি

নবকৃষ্ণ দেব (ইংরেজি: Nabakrishna Deb; ১০ অক্টোবর ১৭৩৩ – ২২ ডিসেম্বর ১৭৯৭) যিনি রাজা নবকৃষ্ণ দেব নামে বেশি পরিচিত ও শোভাবাজার রাজপরিবারের প্রতিষ্ঠাতা। ১৭৫৭ সালে কলকাতায় নতুন তৈরি[১] শোভাবাজার রাজবাড়িতে তিনি প্রথম দুর্গাপূজা শুরু করেন যা কলকাতা শহরের সবথেকে পুরোনো দুর্গাপূজা।[২] অনেক শিল্পী ও প্রজাদের উন্নয়নের জন্য ওনার অবদান আছে। সিরাজউদ্দৌলার ইসলামপন্থী দখল থেকে বাংলার মুক্তির মূল ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি।

রাজা নবকৃষ্ণ দেব
জন্ম(১৭৩৩-১০-১০)১০ অক্টোবর ১৭৩৩
মৃত্যু২২ ডিসেম্বর ১৭৯৭(1797-12-22) (বয়স ৬৪)
পেশারাজা
রবার্ট ক্লাইভের উপস্থিতিতে শোভাবাজার রাজবাড়িতে দুর্গাপূজা
বর্তমানে শোভাবাজার রাজবাড়ির দুর্গাপূজা

জন্মবৃত্তান্ত সম্পাদনা

নবকৃষ্ণ দেব ১৭৩৩ সালের ১০ই অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন রামচরণ দেব। অল্প বয়সে পিতার মৃত্যুর পর মাতার যত্নে উর্দু ও ফরাসি এবং হবে আরবি ও ইংরেজি শেখেন।

ষড়যন্ত্র সম্পাদনা

পলাশীর যুদ্ধের আগে নবাব সিরাজদ্দৌলার বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র হয়েছিল, ইংরেজদের পক্ষ থেকে শোভাবাজারের নবকৃষ্ণ দেব ছিলেন তার মুল প্রতিনিধি। মুর্শিদাবাদে গিয়ে তিনি কেবলমাত্র নবাবের ওমরাহগণের সঙ্গেই পরামর্শ করেন নি, বহু জমিদারকেও রবার্ট ক্লাইভের সহায় করে তুলেছিলেন। এমনকি ক্লাইভের দুতরূপে মীরজাফরের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম ছিলেন তিনিই। পলাশীর প্রান্তরে সিরাজের পরাজয়ের পর মীরজাফর, রামচাঁদ রায়, আমীর বেগ আর নবকৃষ্ণ দেব মিলে সিরাজের কোষাগার লুঠ করেন। শোনা যায়, ওই কোষাগার থেকে আট কোটি টাকার মূল্যবান সম্পদ ভাগ করে নেন তাঁরা।

উত্তর কলকাতার শোভাবাজার অঞ্চলে তৎকালীন বড় ব্যবসায়ী শোভারাম বসাকের কাছ থেকে একটি প্রাসাদোপম বাড়ি নবকৃষ্ণ কিনেছিলেন আগেই। পলাশীর যুদ্ধের পর সেই প্রাসাদের সঙ্গে নবকৃষ্ণ তৈরি করালেন দেওয়ানখানা, নাচঘর, লাইব্রেরী, নহবতখানা ইত্যাদি। আর একটি সুবিশাল সাত খিলানের ঠাকুরদালান।

দুর্গাপূজা সম্পাদনা

'কলকাতা বিচিত্রা' গ্রন্থে রাধারমণ রায় লিখেছেন, পলাশীতে সিরাজের পতনে যারা সবচেয়ে উল্লসিত হন তাঁদের মধ্যে ছিলেন নদীয়ার মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায় আর কলকাতার নবকৃষ্ণ দেব। "কোম্পানীর জয়কে তাঁরা হিন্দুর জয় মনে করলেন। ধূর্ত ক্লাইভও তাঁদের সেরকমই বোঝালেন।" ক্লাইভ চাইলেন এই জয়কে সেলিব্রেট করতে। তাই পলাশীর যুদ্ধের বিজয় উৎসব হিসাবে নবকৃষ্ণ আয়োজন করলেন দুর্গাপূজার। গড়ে উঠলো একচালা প্রতিমা। প্রতিমার গা ভর্তি সোনার গয়না ঝলমল করে উঠলো। আনন্দবাজার পত্রিকায় লিখিত একটি প্রবন্ধে লেখক জানিয়েছেন, "দুর্গার কেশদামে গুঁজে দেওয়া হল ২৬টি স্বর্ণনির্মিত স্বর্ণচাঁপা। নাকে ৩০টি নথ। মাথায় সোনার মুকুট।" তারপর তোপধ্বনির সঙ্গে সঙ্গে সন্ধিপূজোর শুরু। দৈনিক নৈবেদ্য দেওয়া হচ্ছে ৩০ মন চালের। সে বছর নবকৃষ্ণদেব আর নদীয়ার কৃষ্ণচন্দ্র লক্ষাধিক টাকা ব্যয় করে শরৎকালীন দুর্গাপূজার মাধ্যমে ইংরেজদের বিজয় উৎসবটি পালন করলেন। তাজ্জব ব্যাপার হচ্ছে, "ক্লাইভ নিজে খ্রীষ্টান আর মূর্তিপূজোর বিরোধী হয়েও স্রেফ নিজেদের স্বার্থে হিন্দুপ্রেমিক সেজে নবকৃষ্ণের দুর্গাপূজোয় ১০১ টাকা দক্ষিণা আর ঝুড়িঝুড়ি ফলমূল পাঠিয়েছিলেন।" শুধু তাই নয়, দুর্গাপূজার সময় নবকৃষ্ণের বাড়িতে সপারিষদ উপস্থিত হয়ে পূজোর আনন্দও উপভোগ করেছিলেন ক্লাইভ। এমনকি তিনি এখানে পশুবলী সহ পূজো দিয়েছিলেন বলেও শোনা যায় ! নবকৃষ্ণের কাছেও দুর্গাঠাকুর ছিলেন উপলক্ষ্য মাত্র। ক্লাইভকে তুষ্ট করাই ছিল আসল উদ্দেশ্য। নবকৃষ্ণ ভালো করেই জানতেন মূর্তিপূজোর বিরোধী খ্রীষ্টান ক্লাইভকে শুধু দুর্গাঠাকুর দেখিয়ে মন ভরানো যাবে না। তিনি তাই ক্লাইভের জন্যে মদ-মাংস-বাঈনাচেরও বন্দোবস্ত করেছিলেন। সে কারনেই উঠোনের একপ্রান্তে ঠাকুরদালান তৈরির সাথে সাথে অন্যপ্রান্তে তৈরি করা হয়েছিল নাচঘর। ক্লাইভকে তুষ্ট করবার জন্য আনানো হয়েছিল বিদেশ থেকে নিকি বাঈ নামে এক নর্তকীকে। এসব থেকে বোঝা যায় যে নবকৃষ্ণের কাছে দুর্গাঠাকুর ছিলেন উপলক্ষ্য, আসলে তিনি ক্লাইভকে তুষ্ট করতে চেয়েছিলেন।

১৭৫৭ সালে নবকৃষ্ণ দেব জাঁকজমকসহকারে দুর্গাপূজা শুরু করে যে ধারা তৈরি করেন, কলকাতার উঠতি বণিক শ্রেণির মধ্যে তা একটি রেওয়াজ এবং আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে ওঠে। শোভাবাজারের দেব পরিবারের পারিবারিক দুর্গাপূজায় যোগদানকারী ইংরেজদের সংখ্যা প্রতিপত্তির একটি সূচক হয়ে ওঠেছিল। ধার্মিক সঙ্কোচ দুরে সরিয়ে রেখে মুসলিম ঘরানার নর্তকীদের আমন্ত্রণ করা হত। ইংরেজরা নর্তকীদের সাথে নাচে অংশগ্রহণ করতেন, তথ্যের সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহ আছে তবে শোনা যায়, তাঁরা নাকি উইলসন হোটেল থেকে আনা গরু এবং শুয়োরের মাংসর সাথে আকণ্ঠ পানভোজন করতেন। এক হিসেবে বলা যায়, কলকাতায় বাঈজী নাচের প্রবর্তক নবকৃষ্ণই। একমাত্র ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের কারণে এই উৎসবের ছেদ পড়েছিল, পুনরায় পরের বছর তা মহাসমারোহে অনুষ্ঠিত হয়। নবকৃষ্ণের জীবনীকার বিপিনবিহারী মিত্র লিখেছেন, "ঠিক একশত বছর পূর্ব্বে পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভের পর নবকৃষ্ণ যে ভবনে রবার্ট ক্লাইভ এবং কলিকাতাস্থ অন্যান্য ইংরাজদিগকে অভ্যর্থনা করেন, সেই ভবনে তাঁহার পৌত্রেরা ক্লাইভের সমকালীন ইংরাজদিগের পৌত্রদিগকে সিপাহী বিদ্রোহ শান্তির পর অভ্যর্থনা করায় উভয়পক্ষই পূর্ব্বকথা স্মরণ করিয়া আপনাদিগকে অত্যন্ত গৌরবান্বিত মনে করিয়াছেন।"

রাজ পরিবার সম্পাদনা

মৃত্যু সম্পাদনা

১৭৯৭-এর ২২ ডিসেম্বর নবকৃষ্ণ ঘরে পালঙ্কে শুয়ে মারা যান সকলের অলক্ষ্যে।

গ্যালারি সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবাশিষ, বনেদি কলকাতার ঘরবাড়ি, দ্বিতীয় মুদ্রণ ২০০২, পাতা. ১০১-১০২, প্রকাশকঃ আনন্দ প্রকাশক, আইএসবিএন ৮১-৭৭৫৬-১৫৮-৮
  2. Cotton, H.E.A, p. 72

সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত সংসদ বাংলা চরিতাভিধান সাহিত্য সংসদ প্রকাশিত । ISBN 978-81-7955-135-6 (Vol.1)

রাধারমণ রায় রচিত কলকাতা বিচিত্রা দেব সাহিত্য কুটীর প্রাইভেট লিমিটেড (ভারত) প্রকাশিত

নির্মল কর ক্লাইভের দুর্গাপূজা

গোলাম আহমেদ মোর্তজা রচিত এ এক অন্য ইতিহাস মাকতাবাতুত তাকওয়া প্রকাশিত | ISBN 984-60-5004-9

বিপিনবিহারী মিত্র রচিত মহারাজা নবকৃষ্ণ দেব বাহাদুরের জীবনচরিত রেডিয়্যান্স (ভারত) প্রকাশিত