দৌলত কাজী
দৌলত কাজী (কাজী দৌলত নামেও পরিচিত), ছিলেন মধ্যযুগের একজন বাঙালি কবি। তিনি ১৭শ শতাব্দীর প্রারম্ভে কোন এক সময় চট্টগ্রাম জেলার রাউজানে সুলতানপুরের কাজী পাড়ায় জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি আরাকান রাজসভার কবি ছিলেন, যদিও তার লেখার ভাষা ছিলো বাংলা। মধ্যযুগের অন্যান্য কবিদের মত তার কাজে তার পৃষ্ঠপোষক সম্পর্কে বর্ণনা থাকলেও নিজের সম্পর্কে তিনি কিছুই লিপিবদ্ধ করে যাননি। তিনি "সতী ময়না ও লোর চন্দ্রানী" কাব্য রচনা করে বাংলার শক্তিমান কবিদের মাঝে নিজের অবস্থান করে নিয়েছেন।[১] বাংলা কাব্যে ধর্মনিরপেক্ষ প্রণয়কাহিনীর তিনি পথিকৃৎ। সম্ভবত ১৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। গবেষকদের মতে আরাকান রাজ্যের আকিয়াবের কোনো এক স্থানে তার কবর রয়েছে। [২]
কাজী দৌলত | |
---|---|
জন্ম | অজানা (সম্ভবত ১৬ শতকের কোনো এক সময়) |
মৃত্যু | ১৬৩৮ |
যুগ | মধ্যযুগ |
অঞ্চল | দক্ষিণ এশিয়া |
ধারা | বাঙালি পুনর্জাগরণ |
প্রধান আগ্রহ | কবিতা |
জীবনী
সম্পাদনাপ্রাথমিক জীবন
সম্পাদনাদৌলত কাজী অল্প বয়সে নানাশাস্ত্রে সুপন্ডিত হয়ে উঠেন। নিজের দেশে স্বীকৃতি লাভে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে তিনি আরাকানে ভাগ্য অন্বেষনে যান। সে সময়কালে চট্টগ্রামবাসী জীবিকা অর্জনের জন্য আরাকানে যেতেন। আরাকান রাজসভায় তখন বহু কবি এবং জ্ঞানী লোকের ভিড় ছিল। রাজার প্রধান উজির আশরাফ খান একদিন হিন্দি ভাষার কবি মিয়া সাধন রচিত “সতী ময়না” কাহিনী শুনতে চান। দৌলত কাজী পাঞ্চালীর ছন্দে সতী ময়নার কাহিনী বর্ণনা করে সকলের প্রশংসা অর্জন করেন এবং আরাকান (রোসাঙ্গ) রাজ দরবারে কবিদের সভায় মধ্যে গৃহীত হন এবং সেখানে মর্যাদা লাভ করেন।
সাহিত্য জীবন
সম্পাদনাদৌলত কাজী আরাকান রাজসভার আশরাফ খানের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। ১৬২২ হতে ১৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে আশরাফ খান আরাকানের তৎকালীন অধিপতি থিরি থুধম্মা বা শ্রী সুধর্মার নস্কর উজির বা সমর সচিব পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।[৩] দৌলত কাজী ও আশরাফ খান, দুই জনেই সুফী মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। আশরাফ খানের আগ্রহে কবি “সতী ময়না ও লোর চন্দ্রানী" কাব্য রচনা করেন।[৪] এই কাব্যের শুরুতেই তিনি আরাকানরাজ থিরি থুধম্মা (শ্রী সুধর্মা) এবং উজির আশরাফ খানের প্রশংশায় লিখেছেনঃ
কর্নফুলী নদী পূর্বে আছে এক পূরী
রোসাঙ্গ নগরী নাম স্বর্গ অবতারী।।
তাহাতে মগধ বংশ ক্রমে যুদ্ধাচার
নাম শ্রী থুধম্মা রাজা ধন অবতার।।
প্রতাপে প্রভাত ভানু বিখ্যাত ভুবন
পুত্রের সমান করে প্রজার পালন।।
দেব গুরু পুজ এ ধর্মেতে তান মন
সে পদ দর্শনে হএ পাপের মোচন।।
পূণ্যফলে দেখে যদি রাজার চরণ
নারকীও স্বর্গ পাএ সাফল্য জীবন।।
.......................................
মুখ্য পাত্র শ্রীযুক্ত আশরাফ খান
হানাফী মোজাহাব ধরে চিস্তিয়া খান্দান।।
..........................................
শ্রীযুক্ত আশরাফ খান লস্কর উজীর
যাহার প্রতাপ বজ্রে চুর্ণ আর শির।।
মিয়া সাধন নামক একজন হিন্দি ভাষী মুসলিম কবি রচিত "মৈনাসত" (কাব্যটি আসলে 'ঠেট গোহারি' বা একধরনের গ্রাম্য হিন্দি ভাষায় লেখা) নামক কাব্যই ছিল কবি দৌলত কাজীর “সতী ময়না ও লোর চন্দ্রানী" কাব্য রচনায় আদর্শ।[৫] এই কাব্যের সঠিক রচনাকাল জানা যায়নি। তবে অনুমান করা হয় ১৬২২ থেকে ১৬৩৮ সালের মধ্যে এই কাব্য রচনা করা হয়েছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই কাব্য সমাপ্ত হওয়ার আগেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। কবির মৃত্যুর ২০ বছর পরে ১৬৫৯ সালে কবি আলাওল(আনুমানিক ১৫৯৭-১৬৭৩) কাব্যের শেষাংশ রচনা করেন।
তিন খণ্ডের এই কাব্যের প্রথম এবং দ্বিতীয় খণ্ডে দৌলত কাজী কবি প্রতিভার উজ্জ্বল সাক্ষর রেখে গেছেন। প্রথম খণ্ডে কাব্যের নায়ক নায়িকা এবং তাদের স্বভাবগত দোষগুনের কথা তিনি লিখেছেন। দ্বিতীয় খণ্ডে কাব্যের নায়িকা ময়নাবতী বিরহের আগুনে দগ্ধ হয়েছে। তৃতীয় খণ্ডে ময়নাবতীর বিরহের অবসান ঘটে এবং তার স্বামী লোর ও সতিন চন্দ্রানীর মিলন হয়। দ্বিতীয় খন্ড লেখার পর তাঁর মৃত্যু হয় এবং কবির ইঙ্গিত অনুযায়ী কাব্যটিকে মিলনান্তক করে কবি আলাওল দৌলত কাজীর এ অসমাপ্ত কাব্যটি সম্পূর্ণ করেন। তিনি তার সংক্ষিপ্ত জীবনে যে অনন্য নিদর্শন রেখে গেছেন তার মূল্য কবি সৈয়দ আলাওলের রচনার পাশে খুব সহজেই স্বীকৃত। কবি আলাওল অসম্পূর্ণ কাব্য সমাপ্ত করতে গিয়ে কবি দৌলত কাজীর প্রতি সম্মান নিবেদন করে লিখেছেন “তান সম আমার না হয় পদগাঁথা”। বাংলার সঙ্গে সঙ্গে ব্রজবুলি ভাষায় ও তার বিশেষ দখল ছিল[৫]। তিনিই একমাত্র বাংলা ভাষার কবি, যিনি তার রচনা দিয়ে প্রমাণ করেছেন দেব-দেবীকেন্দ্রিক কাহিনী উপজীব্য না করেও ব্রজবুলি ভাষার সার্থক ব্যবহার করা সম্ভব
সমালোচনা
সম্পাদনাআবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের মতে,
"দৌলত কাজীও আলাওলের ন্যায় হিন্দু শাস্ত্র ও সংস্কৃত ভাষায় সুপন্ডিত ছিলেন। সমালোচ্য গ্রন্থে দৌলত কাজী শুদ্ধ সংস্কৃতে কয়েকটি গীত রচনা করিয়া গিয়াছেন। তাঁহার সে রচনা অতি কোমল ও মধুর। বঙ্গ ভাষায় যে তাঁহার অধিকার অসাধারন ছিল, তাহা বলাই বাহুল্য। ব্রজবুলীতে তাঁহার অধিকার আরো বেশি ছিল বলিয়া বোধ হয়। বাস্তবিক দৌলত কাজী ও আলাওল সর্বদা মুসলমান সমাজ়ে অতুলনীয়। অধিকন্তু তাঁহারা যে বঙ্গীয় সাহিত্য দরবারে হিন্দু-কবিগনের সহিত একাসনে বসিবার সম্পূর্ণ উপযুক্ত আশা করি। সে বিষয়ে কেহ ভিন্নমত হইবেন না। দৌলত কাজী আলাওল সাহেবের প্রায় অর্ধশতাব্দী পূর্বের লোক। সুতরাং তাঁহাদের ভাষার মধ্যে যে একটু পার্থক্য আছে তাহা বিচিত্র নহে। আমাদের মতে মুসলমানদের এই দুই মহাকবি প্রায় সমতুল্য। দৌলত কাজী বিদ্যাবুদ্ধিতে বা কবিত্বে আলাওল সাহেব অপেক্ষা কোন অংশেই হীন বলিয়া বোধ হয় না। আলাওল নিজেই তাঁহার শ্রেষ্ঠতা স্বীকার করিয়া গিয়াছেন। আলাওলের মত কবি তদপেক্ষা কোন কম ক্ষমতাশীল কবির অসমাপ্ত কাব্যের সমাপ্তি বিধান করিতে কদাপি যাইতনা, ইহাত সহজেই বলা যায়। ফলত সর্বসাধারণের নিকট সুকবি বলিয়া মান্য হইবার যদি কোন কবি মুসলমানদের থাকে, তবে সেই কবি দৌলত কাজী ও আলাওল সাহেবই। ইহারা ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ, বহুভাগ্যেই কোন সমাজে এমন লোকের আবির্ভাব হইয়া থাকে"।[৬]
ডঃ এনামুল হকের মতে,
"দৌলত কাজী শুধু বাঙ্গালি মুসলমান কবিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ নহেন, প্রাচীন বাংলার শক্তিমান কবিদের মধ্যেও তিনি একজন শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। তাঁহার কবি শক্তি অসাধারন। তাঁহার শিল্প ও সৌন্দর্যবোধ তীক্ষ্ণ ও হৃদয়গ্রাহী, বাংলা ও ব্রজবুলী এই উভয়বিধ ভাষায় তাঁহার ক্ষমতা তুলনাবিহীন"।[৭]
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ Paniker, K. Ayyappa (১৯৯৭)। Medieval Indian Literature: Surveys and selections (ইংরেজি ভাষায়)। Sahitya Akademi। পৃষ্ঠা ৮১৩। আইএসবিএন 978-81-260-0365-5।
- ↑ স্মরণের আবরনে চট্টগ্রামের কৃতী পুরুষ-২য় খন্ড, নেছার আহমদ, শৈলী প্রকাশন, চট্টগ্রাম, ২০০৯, পৃ ৪২
- ↑ স্মরণের আবরনে চট্টগ্রামের কৃতী পুরুষ-২য় খন্ড, নেছার আহমদ, শৈলী প্রকাশন, চট্টগ্রাম, ২০০৯, পৃ ৩৮
- ↑ বাংলা জীবনকোষ, ওহীদুল আলম, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ২০০৯, পৃ ১৭২
- ↑ ক খ স্মরণের আবরনে চট্টগ্রামের কৃতী পুরুষ-২য় খন্ড, নেছার আহমদ, শৈলী প্রকাশন, চট্টগ্রাম, ২০০৯, পৃ ৪০
- ↑ আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ রচনাবলী ১ম খন্ড, আবুল আহসান চৌধুরী সম্পাদিত, বাংলা একাডেমী, ঢাকা
- ↑ স্মরণের আবরনে চট্টগ্রামের কৃতী পুরুষ-২য় খন্ড, নেছার আহমদ, শৈলী প্রকাশন, চট্টগ্রাম, ২০০৯, পৃ ৪১