দুর্গাবতী দেবী

ভারতীয় বিপ্লবী

দুর্গাবতী দেবী (দুর্গা ভাবী) (৭ অক্টোবর ১৯০৭ – ১৫ অক্টোবর ১৯৯৯) একজন ভারতীয় বিপ্লবী ও মুক্তি সংগ্রামী। তিনি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণকারী নারীদের একজন। তিনি ভগৎ সিং কে ব্রিটিশ পুলিশ অফিসার জন সন্ডারসকে হত্যার পর ছদ্মবেশে পালাতে সাহায্য করেন, এবং এ কাজের জন্যই তিনি সর্বাধিক পরিচিত[১]। তিনি হিন্দুস্থান সোশালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন (এইচএসআরএ) এর সদস্য ভগবতীচরণ ভোরার স্ত্রী হওয়ায় অন্যান্য সদস্যগণ তাকে ভাবী বলে সম্বোধন করতেন এবং ভারতীয় বিপ্লবী মহলে তিনি দুর্গা ভাবী নামে পরিচিত ছিলেন।

দুর্গাবতী দেবী
দুর্গা ভাবী
জন্ম(১৯০৭-১০-০৭)৭ অক্টোবর ১৯০৭
মৃত্যু১৫ অক্টোবর ১৯৯৯(1999-10-15) (বয়স ৯২)
প্রতিষ্ঠানহিন্দুস্থান সমাজতান্ত্রিক রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন, নওজওয়ান ভারত সভা
আন্দোলনভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন
দাম্পত্য সঙ্গীভগবতীচরণ ভোরা
সন্তানশচীন্দ্র ভোরা

জীবনী সম্পাদনা

এলাহাবাদের এক গুজরাতি ব্রাহ্মণ পরিবারের কন্যা দুর্গাবতী দেবী গ্রামের স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন। ছোটোবেলাতেই তাঁর মা মারা গেলে তাঁর বাবা সন্ন্যাসগ্রহণ করেন। ফলে বাবা-মায়ের বদলে কাকিমার কাছে বড়ো হয়েছেন তিনি।

ভগবতী চরণ ভোরার সঙ্গে এগারো বছর বয়সে দুর্গাবতী দেবীর বিবাহ হয়।

তিনি নওজওয়ান ভারত সভার একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে প্রথম নজরে আসেন, যখন সভার পক্ষ থেকে ১৬ই নভেম্বর ১৯২৬ তারিখে লাহোরে শহীদ কর্তার সিং সারভা এর ১১তম মৃত্যুবার্ষিকীর আয়োজন করা হয়। জে. পি সন্ডারসকে হত্যার পর তিনি ভগৎ সিংশিবরাম রাজগুরু কে পালাতে সাহায্য করার ব্যাপারে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন।

তিনি, যতীন্দ্র নাথ দাস এর জেলবন্দি অবস্থায় ৬৩ দিনের অনশনের কারণে মৃত্যুর পর, লাহোর থেকে কলকাতা পর্যন্ত তার শবমিছিল এ নেতৃত্ব দেন। এ সময় সমস্ত পথ জুড়েই অগণিত মানুষ এই শবযাত্রায় যোগ দেন।[১]

বিপ্লবী কার্যক্রম সম্পাদনা

ভগৎ সিং ১৯২৯ সালে নয়া দিল্লীর কেন্দ্রীয় সংসদ ভবনে বোমানিক্ষেপের ঘটনায় আত্মসমর্পণ করার পর, দুর্গাবতী দেবী লর্ড হেইলিকে হত্যার চেষ্টা করেন। হেইলি পালিয়ে যান কিন্তু তার বহু সহযোগী মারা যান। দুর্গাবতী পুলিশের হাতে ধরা পড়েন এবং তার তিন বছরের কারাদণ্ড হয়। তিনি ভগৎ সিং ও তার সঙ্গীদের বন্দি অবস্থা থেকে মুক্ত করতে, তার ৩,০০০ টাকা মূল্যমানের গহনা বিক্রি করে দেন।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

দুর্গাবতী ও তার স্বামী কুতুব রোড, দিল্লিতে বিমলপ্রসাদ জৈন নামে এক এইচএসআরএ সদস্যকে "হিমালয়ান টয়লেট" নামে একটি বোমা কারখানা (বোমা তৈরির প্রসঙ্গ গোপন করতে একটি ছদ্মনাম) চালাতে সাহায্য করতেন। এই কারখানায় তারা মূলত পিকরিক অ্যাসিড, নাইট্রোগ্লিসারিনমার্কারি ফালমিনেট নিয়ে কাজ করতেন।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন][২]

১৯ ডিসেম্বর ১৯২৮ তারিখে, সন্ডারস হত্যার দুদিন পর শুকদেব দুর্গাবতীর কাছে সাহায্য চান ও তিনি তা করতে রাজি হন। তারা লাহোর থেকে ভাতিন্দাগামী ট্রেনে ওঠার সিদ্ধান্ত নেন যেটি পরদিন সকালে হাওড়া (কলকাতা)য় থামবে। তিনি ভগৎ সিং এর স্ত্রীর ছদ্মবেশ নেন ও নিজপুত্র শচীনকে ভগৎ সিং এর কোলে দিয়ে চলতে থাকেন। তখন রাজগুরু তাদের চাকর সেজে মালপত্র বহন করতে থাকেন। ধরা না পড়তে ভগৎ সিং আগের দিনই তার দাড়ি কামান, চুল ছোট করে ফেলেন আর পাশ্চাত্য পোশাক পরিধান করেন। আসলে, ১৯ ডিসেম্বর রাতে, যখন ভগৎ সিং আর শুকদেব দুর্গাবতীর বাড়ি যান, তখন শুকদেব ভগত সিংকে একজন নতুন বন্ধু হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন। দুর্গাবতী ভগৎ সিংকে চিনতেই পারেননি। তখন শুকদেব দুর্গাবতীকে ভগৎ সিং এর আসল পরিচয় দেন, আর বলেন যে, যদি দুর্গাবতী ভগৎ সিংকে আগে থেকে ভালমতো চেনার পরেও তার ছদ্মবেশ ধরতে না পারেন, তাহলে পুলিশও তাকে চিনতে পারবে না। কারণ তারা একজন দাড়িওয়ালা শিখকে খুঁজতে থাকবে।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

পরদিন ভোরে তারা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। লাহোর স্টেশনে ছদ্মবেশী ভগৎ সিং কানপুরের উদ্দেশে তার এবং দুর্গাবতীর জন্য দুটি প্রথম শ্রেণীর আর রাজগুরুর জন্য একটি তৃতীয় শ্রেণীর টিকেট কেনেন। কোন অপ্রীতিকর ঘটনা সামাল দিতে ভগৎ সিং আর রাজগুরু উভয়েই কাছে গুলি ভরা বন্দুক ছিল। সেই সময় প্ল্যাটফর্মে ভগৎ সিংএর খোঁজে প্রায় ৫০০ পুলিশ নিয়োজিত ছিল। পুলিশের সন্দেহ এড়িয়ে তারা ট্রেনে ওঠেন। কানপুরে নেমে তারা লখনউ গামী ট্রেনে ওঠেন কারণ হাওড়া স্টেশনে সিআইডি সরাসরি লাহোর থেকে আসা যাত্রীদের সাধারণত তল্লাশি করত। লখনউ এ রাজগুরু বেনারস এর উদ্দেশ্যে রওনা দেন আর ভগৎ সিং, দুর্গাবতী আর তার সন্তান হাওড়ায় চলে আসেন। প্রফেসর ভগবতীচরণ ভোরা এবং তার বোন সুশিলা দেবী আগে থেকেই হাওড়ায় তাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। দুর্গাবতী তার সন্তানকে নিয়ে কয়েকদিন পর লাহোরে ফিরে যান।[৩]

কারাগারে বন্দি থাকাকালীন বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ দাস ৬৩ দিন ধরে অনশন করেছিলেন। এই সময় যতীন দাসের মৃত্যু হলে, সেই মৃত্যুমিছিলের একেবারে সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে মিছিল পরিচালনা করেছিলেন দুর্গাবতী দেবী।

পরবর্তী জীবন সম্পাদনা

ভারতের স্বাধীনতার পর দুর্গাবতী গাজিয়াবাদে একজন সাধারণ নাগরিকের মত নিভৃতে বসবাস করতে থাকেন, যা অন্যান্য স্বাধীনতা সংগ্রামীদের থেকে ব্যাতিক্রমী। পরবর্তীতে তিনি লখনউ এ দরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।

দুর্গাবতী দেবী ১৫ই অক্টোবর ১৯৯৯ তারিখে, ৯২ বছর বয়সে গাজিয়াবাদে মারা যান।[১]

আরও দেখুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "The Tribune...Sunday Reading"। Tribuneindia.com। সংগ্রহের তারিখ ৯ নভেম্বর ২০১২ 
  2. রায়, প্রকাশ (২০২১)। বিস্মৃত বিপ্লবী। চেন্নাই: নোশনপ্রেস চেন্নাই তামিলনাড়ু। পৃষ্ঠা ৪৬–৪৯। আইএসবিএন 978-1-63873-248-8 
  3. Bakshi, S. R. (১৯৮৮)। Revolutionaries and the British Raj। Atlantic Publishers। পৃষ্ঠা 61।