ত্রাজিমিন হ্রদের যুদ্ধ

ত্রাজিমিন হ্রদের যুদ্ধ (খ্রিষ্টপূর্ব ২১৭ সালের ২১ জুন) দ্বিতীয় পুণিক যুদ্ধের অন্তর্গত একটি বড় যুদ্ধ ছিল। হ্যানিবলের নেতৃত্বে কার্থাজিনিয়ানরা রাষ্ট্রদূত গাইয়াস ফ্লামিনিয়াসের অধীনস্থ রোমানদের পরাজিত করেছিল। ত্রাজিমিন হ্রদে রোমান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে হ্যানিবলের বিজয় সামরিক ইতিহাসে সৈন্য সংখ্যার দিক দিয়ে বৃহত্তম অতর্কিত আক্রমণ হিসেবে রয়ে গেছে।[৭]

ত্রাজিমিন হ্রদের যুদ্ধ
মূল যুদ্ধ: দ্বিতীয় পিউনিক যুদ্ধ

ত্রাজিমিন হ্রদের যুদ্ধক্ষেত্র, হৃদ থেকে
তারিখখ্রিষ্টপূর্ব ২১৭ সালের ২১ জুন[১]
অবস্থান
ফলাফল কার্থাগিনিয়াদের বিজয়
বিবাদমান পক্ষ
কার্থেজ রোমান প্রজাতন্ত্র
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী
হ্যানিবল গাইয়াস ফ্ল্যামিনিয়াস 
শক্তি
৫৫,০০০ সৈন্য[২] ৩০,০০০ সৈন্য[৩]
হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি
১,৫০০ নিহত (পলিবিয়াস)[৪]
২,৫০০ নিহত এবং "অনেকে" জখমের কারনে মারা গেছে (লিভি)[৫]

৩০,০০০

  • ১৫,০০০ নিহত[৬]
  • ১৫,০০০ বন্দী[৪]

উপস্থাপনা সম্পাদনা

ট্রেবিয়ার যুদ্ধে টাইবেরিয়াস সেম্প্রোনিয়াস লঙ্গাসের পরাজয়ের ফলে রোমানরা ভীষণ উদ্বিগ্ন ও হতাশ হয়ে উত্তরের নতুন হুমকির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের দ্রুত পরিকল্পনা করে। সেম্প্রোনিয়াস রোমে ফিরে আসেন এবং পরের বছর খ্রিষ্টপূর্ব ২১৭ সালে রোমান সিনেট নতুন রাষ্ট্রদূত নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। নতুন রাষ্ট্রদূত হয়েছিলেন নিয়াস সারভিলিয়াস জেমিনাস এবং গাইয়াস ফ্ল্যামিনিয়াস। রাষ্ট্রদূত নির্বাচিত হওয়ার পরে যথাযথ আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া পরিচালনা না করে রোম ছেড়ে চলে যাওয়ার কারণে সিনেট থেকে তাকে প্রত্যাহার করার সম্ভাবনা ছিল। [৮] সিনেট পাবলিয়াস কর্নেলিয়াস স্কিপিওকে প্রতিস্থাপন করে তার সেনাবাহিনীর সেনাপতিত্ব নেওয়ার জন্য সার্ভিলিয়াসকে কর্মভার দিয়েছিল এবং সেমপ্রোনিয়াসের সেনাবাহিনীর যাবতীয় অংশের নেতৃত্বের জন্য ফ্ল্যামিনিয়াসকে নিয়োগ করা হয়েছিল। যেহেতু ট্রেবিয়ায় পরাজয়ের ফলে উভয় সেনাবাহিনীই দুর্বল হয়ে পড়েছিল, তাই চারটি নতুন সেনাবাহিনী গঠন করা হয়েছিল। নতুন বাহিনী ও প্রাক্তন সেনাবাহিনীর অবশিষ্টাংশ দুজন কনসালের মধ্যে বিভক্ত করা হয়েছিল। [৯] টিকিনাস এবং ট্রেবিয়ার লড়াইয়ের পরে ফ্লামিনিয়াসের সেনাবাহিনী প্রতিরক্ষা প্রস্তুতির জন্য রোমের কাছে দক্ষিণ দিকে ঘুরে গিয়েছিল। হ্যানিবল তা তৎক্ষণাৎ অনুসরণ করেছিলেন এবং দ্রুত অগ্রসর হয়ে এবং শীঘ্রই রোমান সেনাবাহিনী পেরিয়ে যান। শহরে পৌঁছানোর আগে হ্যানিবলকে যুদ্ধে আনার জন্য ফ্লোমিনিয়াস তাঁর গতি বাড়াতে বাধ্য হয়েছিল। সার্ভিলিয়াসের অধীনের আরেকটি বাহিনী ফ্লামিনিয়াসের সাথে যোগ দিতে চলেছিল।

এটি হওয়ার আগেই হ্যানিবাল ফ্ল্যামিনিয়াসকে যে অঞ্চলটিকে রক্ষার জন্য প্রেরণ করা হয়েছিল, তা ধ্বংস করে দিয়ে গাইয়াস ফ্ল্যামিনিয়াসের বাহিনীকে একটি যুদ্ধের জন্য প্ররোচিত করেছিলেন। পলিবিয়াস লিখেছিলেন, "হ্যানিবাল নির্নয় করেছিলেন যে তিনি ফ্ল্যামিনিয়াসকে যুদ্ধে নামাতে পারবেন এবং খুব শীঘ্রই তিনি ফ্যাসুলির আশেপাশের জায়গা ছেড়ে চলে গিয়ে রোমান শিবিরের বাইরে কিছুটা পথ অগ্রসর হয়ে প্রতিবেশী দেশে আক্রমণ করেছিলেন। তখন ফ্ল্যামিনিয়াস ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন কারণ শত্রুর কাছে তিনি তুচ্ছ প্রমানিত হয়েছিলেন এবং দেশটির বিধ্বংস চলার সাথে তিনি দেখেন যে প্রতিটি দিকে থেকেই ধ্বংস এগিয়ে চলেছে এবং তার পক্ষে ধৈর্য সহকারে তা সহ্য করা সম্ভব হয়নি।" [১০][১১] একই সময়ে হ্যানিবল রোমের মিত্রদের আনুগত্য ছিন্ন করার জন্য প্রজাতন্ত্র তাদের রক্ষায় ক্ষমতাহীন তা প্রমাণ করে চেষ্টা করেছিলেন। ফ্ল্যামিনিয়াস অ্যারিটিয়ামে চুপচাপ ক্যাম্প করে রয়ে গেলেন। ফ্ল্যামিনিয়াসকে যুদ্ধে নামাতে না পেরে হ্যানিবল সাহস করে তার প্রতিপক্ষের বাম দিক থেকে চারপাশে ঘুরে দাঁড়ালেন এবং ফ্ল্যামিনিয়াসকে কার্যকরভাবে রোম থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিলেন।

তবুও ফ্ল্যামিনিয়াস একগুঁয়েভাবে নিজের বাহিনীকে শিবিরেই রেখে দিয়েছিলেন। হ্যানিবল এই প্রত্যাশায় অ্যাপুলিয়ায় যাত্রা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে ফ্ল্যামিনিয়াস হয়তো তাকে নিজের পছন্দ মতো কোন যুদ্ধের ময়দানে অনুসরণ করতে পারে। [১২][১৩]

কৌশলগত বিন্যাস সম্পাদনা

 
ট্র্যাসিমিন লেকের যুদ্ধ (মানচিত্রের গ্যালারী, ভ্যাটিকান যাদুঘর, রোম)

হ্যানিবল যখন ত্রাজিমিন হ্রদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, তিনি আক্রমণ করার জন্য খুব উপযুক্ত একটি জায়গায় এসে পৌঁছলেন এবং শুনেছিলেন যে ফ্ল্যামিনিয়াস ছেড়ে আসন্ন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে তাকে অনুসরণ করছে। উত্তরে ভারী জঙ্গলে পাহাড়ের একটি রাশি ছিল যেখানে মালপাসো রোডটি ত্রাজিমিন হ্রদের উত্তর পাশ দিয়ে গেছে। হ্রদের পাহাড়ের কিনারার পাশে হ্যানিবল শিবির স্থাপন করেছিলেন যেখান থেকে তিনি উত্তরের সংকীর্ণ রাস্তা পুরোপুরি নজরে রেখেছিলেন এবং যুদ্ধের জন্য তাঁর সৈন্যদলকে নিয়ে পুরো রাত কাটিয়েছিলেন। শিবিরের নীচের দিকে তিনি তার ভারী পদাতিক (আইবেরিয়ান এবং আফ্রিকান) কিছুটা উচ্চতার উপরে রাখেন। এখানে, তাদের পর্যাপ্ত জায়গা ছিল যেন তারা বাম দিকের মুখ্য রোমান কলামের উপরে আক্রমণ করতে পারে [১৩][১৪] তাঁর অশ্বারোহী এবং গ্যালিক সৈন্যবাহিনী পাহাড়গুলির গভীর বুনো উপত্যকায় লুকিয়ে রেখেছিল যেখান থেকে রোমানরা প্রথমে প্রবেশ করবে, যাতে তারা দ্রুত গে বেরিয়ে প্রবেশদ্বারটি বন্ধ করে রোমনদের পালানোর পথকে অবরুদ্ধ করেতে পারে। তারপরে তিনি সমতলকে উপেক্ষা করে উচ্চতা বরাবর অন্তর রেখে তারসেনা হাল্কাভাবে স্থাপন করেছিলেন যাতে আক্রমণ করার ইঙ্গিত দেওয়া পর্যন্ত অরণ্যে ভালভাবে লুকিয়ে থাকতে পারে। এছাড়াও, যুদ্ধ শুরুর আগের রাতেই হ্যানিবল তার সৈন্যদের তুরোর পাহাড়ে যথেষ্ট দূরত্বে ক্যাম্পফায়ার জ্বালানোর নির্দেশ দিয়েছিল, যাতে রোমানদের বোঝানো যায় যে তার বাহিনী আসলে তাদের চেয়ে আরও দূরে ছিল।[৭]

যুদ্ধ সম্পাদনা

 
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক একাডেমীর ইতিহাস বিভাগ থেকে

২১ শে জুন সকালে রোমান সৈন্যরা হ্রদের উত্তর প্রান্তের নিকটবর্তী রাস্তা দিয়ে পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়। যুদ্ধের জন্য ব্যাকুল আকাঙ্ক্ষায় ফ্ল্যামিনিয়াস তার লোকদের উপর বেশিই চাপ দিয়েছিলেন এবং পিছনের কলামটি তাড়াতাড়ি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। অগ্রগামী লাইনের সৈন্য সামনের দিক থেকে দূরে টেনে রোমান বাহিনীকে বিভক্ত করার জন্য হ্যানিবাল একটি ছোট সৈন্যদল পাঠিয়েছিল। যখন সমস্ত রোমানরা কুয়াশাচ্ছন্ন সরু পথের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে হ্রদের দিকে সমভূমিতে প্রবেশ করল তখন রণধনী বাজিয়ে আক্রমণের ইঙ্গিত দেয়া হয়েছিল। [তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

 
ত্রাজিমিন হ্রদের যুদ্ধে ডুকারিয়াস ফ্ল্যামিনিয়াসকে শিরশ্ছেদ করছে (১৮৮২) জোসেফ-নোয়েল সিলভেস্টের শিল্পকর্ম (Musée des Beaux-Arts, Béziers)

পরিণতি সম্পাদনা

 
অন্যান্য যুদ্ধ

বাসিল লিডেল হার্টের মতে, আরেকটি উজ্জ্বল বিজয়ের মধ্য দিয়ে হ্যানিবল সফলভাবে "ইতিহাসের সর্ববৃহৎ আক্রমণ" পরিকল্পনা ও সম্পাদন করেছিলেন। [১৫] সামরিক ইতিহাসবিদ থিওডোর আয়রল্ট ডজ যোগ করেছেন, "ইতিহাসে পুরো বিশাল সেনাবাহিনীর সাথে ঝাঁপিয়ে পড়ার এটিই একমাত্র উদাহরণ।" [তথ্যসূত্র প্রয়োজন] একইভাবে, ইতিহাসবিদ রবার্ট এল. ও'কনেলও লিখেছেন, "এই জাতীয় চালাকির মাধ্যমে পুরো বিশাল সেনাবাহিনীকে কার্যকরভাবে গ্রাস এবং ধ্বংস এই একবারই হয়েছিল।"[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

পরাজয়ের সংবাদ রোমে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল। কুইন্টাস ফ্যাবিয়াস ম্যাক্সিমাস ভেরুচোসাস রোমান সমাবেশ দ্বারা স্বৈরশাসক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং সংঘাতের হাত থেকে বাঁচতে নিম্ন স্তরের হয়রানির উপর নির্ভর করে রোম তার সামরিক শক্তি পুনর্গঠন না করা পর্যন্ত " ফ্যাবিয়ার কৌশল " অবলম্বন করেছিলেন। পরের বছর রোমানরা একনায়কত্বের অবসান করে পল্লুস এবং ভাররোকে কনসাল হিসাবে নির্বাচিত না করা পর্যন্ত অ্যাপুলিয়া হ্যানিবলের কাছে ধ্বংসের জন্য মুক্ত ছিল এবং। এর পরিণতি ছিল কান্নের যুদ্ধ, যা দ্বিতীয় পুণিক যুদ্ধের সময় রোমানদের সবচেয়ে খারাপ পরাজয় ছিল। [তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

মন্তব্য সম্পাদনা

  • লিভি বলেছেন যে ত্রাজিমিন হ্রদের গণহত্যা এত ভয়াবহ ছিল যে সেনাবাহিনীরা যুদ্ধ শুরু চলার মুহূর্তে ঘটা ভূমিকম্প সম্পর্কে বিন্দুমাত্র অবগত ছিল না। ভূমিকম্পের ফলে ইতালির অনেক শহরের বড় বড় অংশ সমূলে বিনষ্ট হয়ে যায়, বহু নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে যায় এবং বহু পর্বত সমতল ভূমিতে পরিণত হয়।"[১৬]
  • একটি প্রাচীন পুঁথি থেকে জানা যায় যে, তিন দিনেরও বেশি সময় ধরে হ্রদের জল রক্তে পরিপূর্ণ ছিল। হ্রদে পানি সরবরাহকারী একটি ক্ষুদ্র নদীর নামকরণ করা হয়েছিল সাঙ্গুইনেটো, যার অর্থ "রক্তের নদী"। [১৭] ত্রাজিমিন হ্রদ সংলগ্ন এমন অনেক এলাকাই রয়েছে যেগুলোর নামের একটি বিশেষ অর্থ রয়েছে। যেমন- ওসাইয়া ( "কার্নেল হাউস, হাড়ের জায়গা"), সেপোটাগ্লিয়া ( "সমাধি"), ক্যাপোরসো ( "কেপ রেড"), পিগারো ( "প্রশমিত স্থান "), প্রেজিও (পেজিও শব্দ হতে উৎপত্তি,যার অর্থ অধিকতর খারাপ "), পুগনানো (" যুদ্ধের স্থান "), এবং পিয়ান দি মার্তে (" মার্সের মাঠ ")। [তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. P. S. Derow, "The Roman Calendar, 218-191 B. C.", Phoenix, 30 (1976), p. 275
  2. Battle of Lake Trasimene, M.R. van der Werf, Ground Warfare: H-Q, ed. Stanley Sandler, (ABC-CLIO, 2002), 486.
  3. Battle of Lake Trasimene, M.R. van der Werf, Ground Warfare: H-Q, 486.
  4. Polybius, The Histories, 3.85
  5. Livy, Ab Urbe condita 22:7.3-4 (citing historian Quintus Fabius Pictor who fought in and wrote on the war)
  6. লিভি, 22:7.2-4 (citing Pictor)
  7. 1001 Battles That Changed the Course of World History
  8. Livy, Ab urbe condita, 21:64
  9. Livy, Ab Urbe condita, 21.63
  10. Polybius, The Histories, 3.82.
  11. Livy, Ab Urbe condita, 22.3
  12. Polybius, The Histories, 3.81–3.
  13. Livy, Ab Urbe condita, 22.4
  14. Polybius, The Histories, 3.83.
  15. Sir Basil Henry Liddell Hart (১৯৯১)। Strategy। Meridian। পৃষ্ঠা 26। আইএসবিএন 978-0-452-01071-0 
  16. Livy, Ab Urbe condita, 22.5
  17. Hannibal Barca and the Punic Wars ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত মার্চ ২৪, ২০০৬ তারিখে by Hilary Gowen.