তাকামিন জোকিচি

জাপানি রসায়নবিদ

তাকামিন জোকিচি (高峰 譲吉, ৩ নভেম্বর ১৮৫৪ - ২২ জুলাই ১৯২২)[১][২] ছিলেন একজন জাপানি রসায়নবিদ। তিনি ১৯০১সালে সর্বপ্রথম এপিনেফ্রিন আলাদা করতে সক্ষম হন। এই কজটর জন্য তিনি বিশেষভাবে পরিচিত।

তাকামিন জোকিচি
高峰 譲吉
জন্ম(১৮৫৪-১১-০৩)৩ নভেম্বর ১৮৫৪
তাকাওকা, তোয়ামা, জাপান
মৃত্যু২২ জুলাই ১৯২২(1922-07-22) (বয়স ৬৭)
নিউ ইয়র্ক, নিউ ইয়র্ক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
নাগরিকত্বজাপানী
মাতৃশিক্ষায়তনটোকিও বিশ্ববিদ্যালয়
পরিচিতির কারণঅ্যাড্রেনালিন পৃথকীকরণ এবং বিশুদ্ধকরণ,
তাকদিয়াস্টেস পৃথকীকরণ
পুরস্কারজাপান একাডেমি পুরস্কার (১৯১২)
বৈজ্ঞানিক কর্মজীবন
কর্মক্ষেত্ররসায়ন

প্রাথমিক জীবন এবং শিক্ষা সম্পাদনা

তাকামিন ১৮৫৪ সালের নভেম্বর মাসে তাকাওকা, তোয়ামা প্রিফেকচারে জন্মগ্রহণ করেন।[৩] তার বাবা ছিলেন একজন ডাক্তার। মা ছিলেন ভাত থেকে প্রস্তুত এক ধরনের মদ সেক নামক ব্রিউয়ারদের পরিবারের একজন সদস্য। মধ্য হোনশুতে অর্থাৎ বর্তমান ইশিকাওয়া প্রিফেকচারের রাজধানী কানাজাওয়াতে তার শৈশব কেটেছে। তিনি নাগাসাকির একটি ডাচ পরিবার থেকে ছোটবেলায় ইংরেজি শিখেছিলেন। তাই সবসময় ডাচ উচ্চারণে ইংরেজি বলতেন। তিনি ওসাকা, কিয়োটো এবং টোকিওতে পড়াশোনা করে ১৮৭৯ সালে টোকিও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হন। ১৮৮৩ সাল পর্যন্ত তিনি স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয় এবং অ্যান্ডারসন কলেজে স্নাতকোত্তর গবেষণর কাজে যুক্ত ছিলেন।

কর্মজীবন সম্পাদনা

জাপান সম্পাদনা

১৮৮৩ সালে তাকামিন জাপানে ফিরে এসে সদ্য প্রতিষ্ঠিত জাপানের কৃষি ও বাণিজ্য মন্ত্রকের রসায়ন বিভাগে যোগ দেন। সেখানে তিনি ১৮৮৭ সাল পর্যন্ত ছিলেন।[৪] এরপর তিনি টোকিও জিনজো হিরিও নামে একটি সার কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে তিনি তাকা-ডিয়াস্টেজ নামে একটি উৎসেচক আলাদা করতে সক্ষম হন। এই উৎসেচকটি শ্বেতসারকে ভাঙ্গতে অনুঘটক হিসাবে কাজ করে। কোজি নামক ছত্রাক থেকে তাকামিন তার ডায়াস্টেজ উৎসেচকটি তৈরি করেছিলেন। কোজি ছত্রাক সয়া সস এবং মিসো তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এর ল্যাটিন নাম Aspergillus oryzae। এটি জাপানের একটি "মনোনীত জাতীয় ছত্রাক" (কোক্কিন)। [৫]

যুক্তরাষ্ট্র সম্পাদনা

 
১৯০৫ সালে তাকা-ডায়াস্টেজের বিজ্ঞাপন

১৮৮৪সালে টাকামিন নিউ অর্লিন্স বিশ্ব তুলা শতবর্ষী প্রদর্শনীর সহ-কমিশনার হিসাবে নিযুক্ত হন। সেখানে তিনি লাফকাডিও হার্ন এবং ১৮ বছর বয়সী ক্যারোলিন ফিল্ড হিচের সাথে দেখা করেন। ১৮৮৫ সালে, তিনি জাপানি পেটেন্ট অফিসের অস্থায়ী প্রধান হন এবং পেটেন্ট প্রশাসনের ভিত্তি স্থাপনে সহায়তা করেন। তিনি টোকিও কৃত্রিম সার কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। এই কোম্পানি চার্লসটন, সাউথ ক্যারোলিনা থেকে প্রচুর পরিমাণে ফসফেট আমদানি করে। ১৮৯০ সালে তিনি তার স্ত্রী এবং দুই ছেলেকে নিয়ে শিকাগোতে চলে আসেন। [৩]:

তিনি নিউ ইয়র্ক সিটিতে তার নিজস্ব গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করেন তাকা-ডিয়াস্টেজের জন্য একচেটিয়া উৎপাদন অধিকারের লাইসেন্সটি তিনি তুলে দেন পার্ক-ডেভিস নামে আমেরিকার বৃহত্তম একটি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিকে।[৬] এই পদক্ষেপের ফলে তিনি তুলনামূলকভাবে অল্প সময়ের মধ্যে একজন কোটিপতি হয়েছিলেন। ২০ শতকের প্রথম দিকে তার সম্পত্তির মূল্য ছিল $৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। [৫] 

১৮৯৪ সালে তাকামিন "প্রসেস অফ মেকিং ডায়াস্ট্যাটিক এনজাইম" (মার্কিন পেটেন্ট ৫২৫,৮২৩ ) শিরোনামের একটি মার্কিন পেটেন্টের জন্য আবেদন করেন। আবেদনটি মঞ্জুর করা হয়। এটি ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জীবাণুঘটিত উৎসেচকের প্রথম পেটেন্ট।[৪][৭]

১৯০১ সালে তিনি অ্যাড্রেনালিন হরমোনকে আলাদা এবং বিশুদ্ধ করেন। এটি প্রাণীর গ্রন্থি থেকে হাঁপানির জন্য প্রথম কার্যকর ব্রঙ্কোডাইলেটর ছিল। [১][৮]

১৯০৪ সালে জাপানের সম্রাট মেইজি তাকামিনকে একটি উপহার দিয়ে সম্মানিত করেন। সেন্ট লুইস ওয়ার্ল্ড মেলার প্রেক্ষাপটে (লুইসিয়ানা ক্রয় প্রদর্শনী) জাপান সরকার ১,৩০০ বছর আগে কিয়োটো ইম্পেরিয়াল করোনেশন প্যালেসের আদলে তৈরি একটি ঐতিহাসিক জাপানি কাঠামো, "পাইন এবং ম্যাপেল প্যালেস" (শোফু-ডেন) র প্রতিলিপি করা হয়। জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে আরও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রচেষ্টার কৃতজ্ঞতার স্বীকৃতিস্বরূপ ডঃ তাকামিনকে এটি দেওয়া হয়েছিল।[৯] তিনি ঐতিহাসিক জাপানি কাঠামো, "পাইন এবং ম্যাপেল প্যালেস" কাঠামোটি মিসৌরি থেকে নিউ ইয়র্ক শহরের পঁচাত্তর মাইল উত্তরে তার গ্রীষ্মকালীন বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন। ১৯০৯ সালে এই অঞ্চলটি পরিদর্শনের সময় প্রিন্স কুনি কুনিয়োশি এবং জাপানের প্রিন্সেস কুনির জন্য এই কাঠামোটি গেস্ট হাউস হিসাবে কাজ করেছিল। [১০] যদিও এই সম্পত্তিটি ১৯২২ সালে বিক্রি করা হয়। তবে পুনর্গঠিত কাঠামোটি তার শান্ত পরিবেশে রয়ে গিয়েছে। ২০০৮ সালেও এটি নিউইয়র্কের সুলিভান কাউন্টির পর্যটন আকর্ষণগুলির মধ্যে একটি হিসাবে অব্যাহত রয়েছে।[১১]

১৯০৫ সালে তাকামিন নিপ্পন ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন, যা বহু বছর ধরে ম্যানহাটনের ১৬১ পশ্চিম ৯৩ তম রাস্তায় অবস্থিত ছিল।[১২]

তাকামিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জাপানের মধ্যে সদ্ভাব বজায় রাখার জন্য তার আজীবন কাজ করে গিয়েছেন।[১৩][১৪]

১৯১২ সালে টোকিওর মেয়র (ইউকিও ওজাকি) এবং তাকামিন জোকিচি চেরি ব্লসম গাছ উপহার দেন। গাছগুলি ওয়াশিংটন, ডিসির টাইডাল বেসিনের আশেপাশে পশ্চিম পোটোম্যাক পার্কে রোপণ করা হয়েছিল।[১৫]

১৯১৫ সালের একটি ছবিতে সফররত জাপানি কূটনীতিক ব্যারন ইইচি শিবুসাওয়াকে সম্মানিত ভোজসভার হোস্ট হিসেবে জোকিচি তাকামিনকে উপস্থাপন করা হয়েছে। এই দৃষ্টান্তটি ১৯১২ সালে ওয়াশিংটন, ডিসিতে চেরি ব্লসম গাছ উপহার দেওয়ার ক্ষেত্রে জোকিচি তাকামিনের জড়িত থাকার সাথে যুক্ত, যা বার্ষিক উদযাপিত জাতীয় চেরি ব্লসম ফেস্টিভালে পরিণত হয়।[১৬][১৭]

ব্যক্তিগত জীবন সম্পাদনা

 
নিউ ইয়র্ক সিটির ব্রঙ্কসের উডলন কবরস্থানে তাকামিন জোকিচির সমাধি

১৮৮৭ সালের ১০ আগস্ট তাকামিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণের সময় নিউ অর্লিন্সের ক্যারোলিন ফিল্ড হিচকে বিয়ে করেন। তাদের দুই পুত্র সন্তান ছিল। এক পুত্র জোকিচি তাকামিন ১৮৮৮ সালে জাপানের টোকিওতে জন্মগ্রহণ করেন। ১৮৮৯ সালে অন্য পুত্র এবেনেজার তাকাশি তাকামিনের জন্ম হয়। ১৮৯০ সালের ডিসেম্বরে শিকাগোতে এসে এই পরিবারটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যায়।[৩]:[৪] মার্কিন প্রভাবের কারণে তিনি ক্যাথলিক ধর্মে দীক্ষিত হন। ঐতিহাসিক নথি অনুসারে তিনি সারা জীবন এই বিশ্বাস বজায় রেখেছিলেন। [১৮]

পুরস্কার ও সম্মাননা সম্পাদনা

  • ১৮৯৯ সালে তাকামিনকে টোকিও বিশ্ববিদ্যালয় ইঞ্জিনিয়ারিং-এ সম্মানসূচক ডক্টরেট প্রদান করা হয়।[৫]
  • ১৯৮৫ সালের ১৮ এপ্রিল জাপান পেটেন্ট অফিস তাকে দশজন জাপানি মহান উদ্ভাবকের একজন হিসাবে নির্বাচিত করে।[১৯]

জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে সম্পাদনা

২০১১ সাল পর্যন্ত তোরু ইচিকাওয়া তাকামিনের জীবন নিয়ে দুটি চলচ্চিত্র তৈরি করেছেন। ২০১০ সালে সাকুরা, সাকুরা নামে তাকামিনকে নিয়ে জাপানী চলচ্চিত্র তৈরি হয়।[২০] ইচিকাওয়া দ্বারা পরিচালিত এবং হাটসুনোরি হাসেগাওয়া অভিনীত তাকামিন শিরোনামের একটি সিক্যুয়েল ২০১১ সালে মুক্তি পায় ।[২১]

২০০৯ সালের হিসাব অনুসারে কানাজাওয়ার তাকামিনের বাড়িটি এখনও দেখা যায়। ২০০১ সালে এটিকে কানাজাওয়া দুর্গের মাঠের কাছাকাছি স্থানান্তরিত হয়।[২২]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Yamashima T (২০০৩)। "Jokichi Takamine (1854-1922), the samurai chemist, and his work on adrenalin": 95–102। ডিওআই:10.1177/096777200301100211পিএমআইডি 12717538 
  2. Sasges, Gerard (২০২১-০৩-০১)। "Mold's Dominion: Science, Empire, and Capitalism in a Globalizing World"। The American Historical Review126 (1): 82–108। আইএসএসএন 0002-8762ডিওআই:10.1093/ahr/rhab008  
  3. Shurtleff, W.; Aoyagi, A. (২০১২)। Jokichi Takamine (1854-1922) and Caroline Takamine (1866-1954): Biography and Bibliography. (পিডিএফ)। Lafayette, California: Soyinfo Center। আইএসবিএন 978-1-928914-46-4 
  4. Joan Bennet (ডিসেম্বর ২০০১)। "The Time Line: Adrenalin and cherry trees": 47–48,51। 
  5. Pulvers, Roger, "Jokichi Takamine: a man with fire in his belly whatever the odds", Japan Times, June 28, 2009, p. 8.
  6. Odagiri, Hiroyuki (১৯৯৬)। Technology and Industrial Development in Japan। Clarendon Press, Oxford। পৃষ্ঠা 214আইএসবিএন 978-0-19-828802-2 
  7. Takamine, Jokiohi (১৮৯৪)। "Process of making diastatic enzyme"Google Patents। সংগ্রহের তারিখ ২৪ জানুয়ারি ২০১৬ 
  8. Bennett M (১৯৯৯)। "One hundred years of adrenaline: the discovery of autoreceptors": 145–59। ডিওআই:10.1007/BF02281628পিএমআইডি 10454061 
  9. Estrow, Milton (সেপ্টেম্বর ২৮, ১৯৪৭)। "Japanese Palace; Replica Near Monticello Now Open to Public"New York Times 
  10. "Kuni in Japanese House; Host of Prince, Dr. Takamine, Has Japanese Structures of St. Louis Fair," New York Times. September 20, 1909.
  11. "Sho Fu Den"। ২০০৮-০২-২৬। Archived from the original on ২০০৮-০২-২৬। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৭-০৬  ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২০০৮-০২-২৬ তারিখে
  12. Gray, Christopher (২০০১-০৯-৩০)। "Streetscapes/161 West 93rd Street; A Building That Recalls the Days After Pearl Harbor"The New York Times (ইংরেজি ভাষায়)। আইএসএসএন 0362-4331। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৭-০৬ 
  13. Katz, Stan S. (২০১৯)। The Art of Peace (expanded সংস্করণ)। Horizon Productions। পৃষ্ঠা 32, 200, 216 note 5, 219 note 13, 364, 365, 370, 384 note 11। 
  14. "Introduction to The Art of Peace: the illustrated biography of Prince Iyesato Tokugawa"TheEmperorAndTheSpy.com। ২০২০। 
  15. "Cherry Trees in Washington DC"। ২০০৭-০২-২৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। 
  16. Katz, Stan S. (২০১৯)। The Art of Peace। Horizon Productions। পৃষ্ঠা 209, 225–6, 373–4, 379। আইএসবিএন 978-0-9903349-6-5 
  17. "1915 Photo: Theodore Roosevelt & William Howard Taft honor Baron Shibusawa Eiichi during his important diplomatic visit to the United States."। ২০২০। 
  18. Doak, Kevin Michael (২০১১)। Xavier's legacies: Catholicism in modern Japanese culture। Asian religions and society series। UBC Press। আইএসবিএন 978-0-7748-2021-9 
  19. "Ten Japanese Great Inventors"। Japan Patent Office। ২০০২। 
  20. "さくら、さくら -サムライ化学者 高峰譲吉の生涯-"Yahoo Movie Database (জাপানি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০ অক্টোবর ২০১৬ 
  21. "TAKAMINE ~アメリカに桜を咲かせた男~"Yahoo Movie Database (জাপানি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০ অক্টোবর ২০১৬ 
  22. 旧高峰家 ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২০০৮-১০-৩১ তারিখে. "City Kanazawa Official Web Site." Accessed 15 July 2009. (Japanese)