ঢোপকল

প্রাচীন জলাধার

ঢোপকল রাজশাহী শহরের অন্যতম প্রাচীন ঐতিহ্য। এ ঢোপকলের সঙ্গে রাজশাহীর সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য জড়িত। মহারাণী হেমন্ত কুমারীর প্রচেষ্টা ও অনুদানে ১৯৩৭ খ্রীষ্টাব্দে রাজশাহী বাসীর জন্য সার্বক্ষণিক বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ নিশ্চিত করতে পানি সরবরাহ প্রকল্প মহারাণী হেমন্ত কুমারী ওয়াটার ওয়ার্কস নির্মিত হয় যার অন্যতম নিদর্শন রাজশাহী শহরে অবস্থিত এই ঢোপকলসমূহ।[১]

ঢোপকল
নগরীর কাজিপাড়া এলাকায় অবিস্থিত একটি ঢোপকল
প্রাক্তন নামমহারাণী হেমন্ত কুমারী ওয়াটার ওয়ার্কস
সাধারণ তথ্য
শহররাজশাহী
দেশবাংলাদেশ
নির্মাণকাজের আরম্ভ১৯৩৪
নির্মাণকাজের সমাপ্তি১৯৩৭; ৮৭ বছর আগে (1937)
নির্মাণব্যয়২,৫০,০০০ টাকা
উচ্চতা১২ ফুট
কারিগরী বিবরণ
উপাদানসিমেন্ট, কাস্ট আয়রণ, পিতল
পরিচিতির কারণরাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী পানি সরবরাহ প্রকল্প

ইতিহাস সম্পাদনা

এই ঢোপকল তৈরীর সময়ে রাজশাহী পৌরসভার (বর্তমানে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন) দায়িত্বপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ছিলেন রায় ডি এন দাশগুপ্ত।[১] সে সময় রাজশাহী শহরে পানযোগ্য পানির খুব কষ্ট ছিল। বিশুদ্ধ পানির খুবই অভাব ঘটেছিল তখন। যার ফলশ্রুতিতে ছড়িয়ে পড়েছিল কলেরা-আমাশয় সহ নানারকম পেটের পীড়া। বেশ কিছু লোকের মৃত্যুও ঘটেছিল সেই সময় এই অসুখের জন্য।[২]

রায় ডিএন দাশগুপ্ত রাজশাহী পৌরসভার চেয়ারম্যান (১৯৩৪-৩৯) থাকাকালে রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশনের সহযোগিতায় নগরবাসীকে সুপেয় পানি সরবরাহের উদ্যোগ নেন। সিদ্ধান্ত নেয়া হয় রাস্তার মোড়ে মোড়ে পানির কল স্থাপন করা হবে। ১৯৩৭ সালের অগাষ্ট মাসের কোন একটি দিনে মিনিষ্ট্রি অব ক্যালকাটার অধীনে রাজশাহী ওয়াটার ওয়াকর্স নামে পানি সরবরাহ ও বিশুদ্ধকরণ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়। এবং ব্যয় করা হয় প্রায় আড়াই লক্ষাধিক টাকা। এই কাজে নগরীর নামকরা ধনী লোকেদের এগিয়ে আসার জন্য অনুরোধ করা হয়। সেই সূত্র ধরেই মহারাণী হেমন্তকুমারী নিজেই দান করেন প্রায় ৬৫ হাজার টাকা। বিশাল অঙ্কের একক অনুদানের কারণে রাজশাহী জেলা বোর্ডের দান করা জমিতে মহারানী হেমন্ত কুমারীর নামেই ওয়াটার ওয়ার্কস স্থাপিত হয়। কালক্রমে তার নাম হেমন্তকুমারী ঢোপকল নামেই পরিচিত হতে থাকে।[২]

ব্যবস্থাপনা সম্পাদনা

পুরো শহর জুড়ে প্রায় শতাধিক এমন ঢোপকল স্থাপন করা হয়। মহারাণী হেমন্তকুমারী পানি শোধন কেন্দ্রে পানিকে বিভিন্ন ট্রিটমেন্ট করে পানি থেকে আয়রন ও পানির ক্ষারতা দুর করা হতো। তারপর সেটা সরবরাহ করা হতো সেই ঢোপগুলোতে। তবে সর্বপ্রথমে সেটা পাথরকুঁচির ফিল্টার দিয়ে পানি ফিল্টার করা হতো। এরপর সেটা সিমেন্টের তৈরী মোটা পাইপের সাহায্যে বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হতো।[৩]

এই ঢোপকলগুলোর প্রতিটির পানি ধারণক্ষমতা ৪৭০ গ্যালন। প্রতিটি ঢোপকলেই ছিল একটি 'রাফিং ফিল্টার'। এতে বালি ও পাথরের স্তর থাকায় সরবরাহ করা পানি আরও পরিশোধিত হয়ে বের হতো এবং গরমের সময় মোটামুটি ঠান্ডাও থাকতো। সেই সময় সারাদিনে মাত্র দুই ঘণ্টা পানি সরবরাহ করা হতো। মোড়ে মোড়ে ঢোপকলগুলোতে পানি ধরে রাখা হতো। ফলে সারাদিনই পানি পাওয়া যেত।[৪]

প্রায় প্রতি দুই মাস পর পর এই ঢোপকল গুলোকে পরিষ্কার করা হতো। পরিষ্কারের নিয়মটি ছিল খুবই ভালো। এই ঢোপকলের উপরের ঢাকনাটি খোলা যেত। তারপর ভিতরে মানুষ নেমে ব্লিচিং পাউডার ও অন্যান্য জিনিস দিয়ে সেটা পরিষ্কার করতো। প্রতি দুই মাস পর পর প্রত্যেকটি ঢোপকল থেকে পানির স্যাম্পল সংগ্রহ করা হতো। পরে সেটা পাঠানো হতো পরীক্ষাগারে পানির মান ঠিক আছে কিনা সেটা দেখার জন্য। বর্তমানে এই ঢোপকল প্রায় বিলুপ্ত। শহরের স্মৃতি বলতে ২-১ টি ঢোপকল রয়েছে। যার মধ্যে একটি কুমারপাড়ায় অবস্থিত । [৩]

নির্মাণ কৌশল সম্পাদনা

ঢোপকল গুলো লম্বায় প্রায় ভুমি থেকে ১২ ফুট উঁচু এবং ব্যাস প্রায় ৪ ফুট। ঢোপকলগুলো তৈরী করা হয়েছিল সিমেন্টের ঢালাই করে। এই ঢোপকলের উপর থেকে নিচ পর্যন্ত ঢেউ খেলানো একটা প্লাষ্টার করা হতো। যে নকশাটা করা হতো টিনের সাহায্যে। চারিদিকে টিনের একটা রাউন্ড বানিয়ে তার মধ্যে সিমেন্ট আর ইটের খোয়ার ঢালাই ঢেলে দেয়া হতো। এর ঢালাই খুবই শক্ত। সহজে কোন কিছুর ধাক্কায় বা আঘাতে এটা ভাঙ্গে না।

আরো দেখুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. হক, তানজিমুল (১৯ মার্চ ২০১৪)। "হারিয়ে যাচ্ছে রাজশাহীর ঐতিহ্য 'ঢোপকল'"। রাইজিং বিডি। স্কাইরুট মিডিয়া লিমিটেড। 
  2. হাবিব, সৌরভ (১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬)। "মহারানীর ঢোপকল যাচ্ছে জাদুঘরে"দৈনিক সমকাল। ১৩৬, তেজগাঁও বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা ১২০৮। [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  3. "জাদুঘরে যাচ্ছে রাজশাহীর ঐতিহাসিক নিদর্শন ঢোপকল"সিল্ক সিটি নিউজ। কাদিরগঞ্জ, গ্রেটার রোড, রাজশাহী, বাংলাদেশ। ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬। ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৮ মার্চ ২০১৬ 
  4. ঐতিহ্য রাজশাহী, ১৯৮৬