জ্ঞানের ঔপনিবেশিকতা

জ্ঞানতত্ত্বীয় ধারণা

জ্ঞানের ঔপনিবেশিকতা হল একটি জ্ঞানতত্ত্বীয় ধারণা যা পেরুর সমাজবিজ্ঞানী এনিবা কিহানো প্রাথমিকভাবে ধারণাবদ্ধ করেন। ধারণাটি পরবর্তীতে সমসাময়িক ঔপনিবেশিকতা বিরোধী চিন্তাধারায় সংযোজিত ও অভিযোজিত হয়। ধারণাটির প্রবক্তারা ইউরোপকেন্দ্রিক জ্ঞানব্যবস্থার সমালোচনা করেন। তাদের মতে, উপনিবেশবাদের প্রভাব জ্ঞানক্ষেত্রের মধ্যে এখনো টিকে আছে। ঔপনিবেশিকতা বিরোধী পণ্ডিতবর্গ জ্ঞানের ঔপনিবেশিকতাকে বৈশ্বিক পর্যায়ে শক্তির ঔপনিবেশিকতার মূল চালিকাশক্তি বলে মনে করেন। উপনিবেশবাদের শিকার জনগোষ্ঠীর অস্তিত্বের ঔপনিবেশিকতার জন্যও এটি দায়ী যা তাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায় উপনিবেশবাদের প্রভাবকে নির্দেশ করে।

দিয়েগো মুনোজ কামারগো ১৫৮৫ সালে রচিত ডেসক্রিপসিওন ডি ত্লাসকালায় ফ্রান্সিসকীয় ভ্রাতৃসংঘের দ্বারা মেক্সিকীয় পাণ্ডুলিপি ধ্বংসের চিত্র তুলে ধরেছেন।[১]

উৎপত্তি ও বিকাশ সম্পাদনা

ফ্রেগোসো বেইলনডি লিসোভয় এর মতে, পশ্চিমা জ্ঞানকে উপনিবেশবাদের সহায়ক বলে যারা বর্ণনা করেছেন তাদের মধ্যে হাতুয়ে ছিলেন অগ্রগণ্য। তিনি ঔপনিবেশিক দ্বীপ লা এস্পানোলার (বর্তমানে হাইতিডোমিনিকান প্রজাতন্ত্র) একজন টাইনো আদিবাসী যোদ্ধা ছিলেন। তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে আন্তোনিও ডি মন্টেসিনোস ১৫১১ সালে একজন শিক্ষাবিদ হিসাবে তার কর্মজীবন শুরু করেন এবং বার্তেলোমে দে লাস কাসাসকে সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা শেখান। সমসাময়িক যুগে ফ্রঁৎস ফানঁকে ঔপনিবেশিকতার বুদ্ধিবৃত্তিক দিকগুলির সমালোচনার ক্ষেত্রে একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হিসেবে গণ্য করা হয়। ফানঁ "ঔপনিবেশিকতাকে একটি বস্তুগত প্রক্রিয়া হিসেবে আখ্যায়িত করার পাশাপাশি এটিকে একটি মানসিক ও জ্ঞানতাত্ত্বিক প্রক্রিয়া" হিসেবেও বর্ণনা করেছেন। এনিবা কিহানো এই দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রসারিত করে ঔপনিবেশিকতার বুদ্ধিবৃত্তিক মাত্রার সমালোচনাকে অগ্রসর করেছেন।[২]

জ্ঞানের ঔপনিবেশিকতার ধারণাটি সামগ্রিক ঔপনিবেশিকতার তত্ত্ব থেকে উদ্ভূত হয়েছে।[টীকা ১] ঔপনিবেশিকতা বা "বৈশ্বিক ঔপনিবেশিকতার" ধারণাটি তিনটি উপাদান নিয়ে গঠিত: ক্ষমতার ঔপনিবেশিকতা, অস্তিত্বের ঔপনিবেশিকতা ও জ্ঞানের ঔপনিবেশিকতা।[টীকা ২] জ্ঞানের ঔপনিবেশিকতার ধারণা ১৯৯২ সালে পেরুর সমাজবিজ্ঞানী এনিবা কিহানোর লেখা একটি নিবন্ধে খুঁজে পাওয়া যায়।[টীকা ৩] চতুর্দশ শতাব্দী থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ল্যাটিন আমেরিকার ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক ঘটনার প্রেক্ষাপটে ক্ষমতা, জ্ঞান, জাতিগত শ্রেণিবিন্যাস ও পুঁজিবাদী বৈশ্বিক ব্যবস্থার উপর ব্যাপক আলোচনার অংশ হিসেবে কিহানো এই ধারণাটি প্রবর্তন করেন।[টীকা ৪]

পরবর্তীতে ওয়াল্টার মিনিওলো, এনরিকে ডাসেলসান্তিয়াগো কাস্ত্রো-গোমেজ সহ বেশ কয়েকজন ঔপনিবেশিকতা বিরোধী চিন্তাবিদদের দ্বারা ধারণাটি প্রসারিত হয়।[৯]

পটভূমি সম্পাদনা

কিহানোর মতে, উপনিবেশায়নের শিকার জনগোষ্ঠীর জানার পদ্ধতি, জ্ঞান উৎপাদন, দৃষ্টিভঙ্গি, দর্শন, ছবি, প্রতীক ও তাৎপর্য নির্ণায়ক পদ্ধতি এবং তাদের সাংস্কৃতিক সম্পদ, নিদর্শন ও অভিব্যক্তি প্রকাশের উপায় সমূহের উপর উপনিবেশবাদের এক বিশেষ প্রভাব রয়েছে। কিহানো মনে করেন, জ্ঞানের এই দমন-নীতি মহাদেশ জুড়ে আদিবাসী জনগোষ্ঠী এবং আদিবাসী সমাজ ও ঐতিহ্যের বিনাশের কারণ। কিহানো বিশ্বাস করেন যে ঔপনিবেশিক আমলে উপনিবেশিত জনগোষ্ঠীর জ্ঞানের দমন, বাজেয়াপ্তকরণ ও সাম্রাজ্যবাদী জ্ঞান আরোপ করার ধরণগুলি জাতি ও জাতিগত শ্রেণিবিন্যাসের ধারণার মাধ্যমে প্রতিবিম্বিত হয়। এই কারণে একটি সুস্পষ্ট রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে উপনিবেশবাদের পতনের পরও এর প্রভাব অব্যাহত থাকে। [১০] এই ব্যবস্থা বিভিন্ন "ঔপনিবেশিক পরিস্থিতিতে" টিকে থাকে যেখানে ঐতিহাসিকভাবে উপনিবেশিত অঞ্চলের জনগণ বঞ্চনা ও শোষণের শিকার হয়। উপনিবেশবাদের এই চলমান অবস্থাকে উপনিবেশ বিরোধী পণ্ডিতরা "ঔপনিবেশিকতা" হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন, যা জ্ঞানক্ষেত্র সহ অনেক আন্তঃসম্পর্কিত ক্ষেত্রসমূহ জুড়ে উপনিবেশবাদের নিপীড়ন ও শোষণের অনুভূত উত্তরাধিকার বর্ণনা করে। সাবেলো গাতশেনি কিহানোকে উদ্ধৃত করে এই ধরনের চারটি আন্তঃসংযুক্ত কাণ্ডের বিষয়ে উল্লেখ করেছেন। সেগুলো হলঃ "অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ; কর্তৃত্বের নিয়ন্ত্রণ; লিঙ্গ ও যৌনতার নিয়ন্ত্রণ; এবং আত্মমাত্রিকতার আদর্শ ও জ্ঞানের নিয়ন্ত্রণ"।[১১]

তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ সম্পাদনা

নেলসন মালডোনাডো-টরেসের মতে, ঔপনিবেশিকতা বলতে দীর্ঘস্থায়ী এমন এক বৈশ্বিক শক্তি কাঠামোকে বোঝায় যা উপনিবেশবাদের ফলে বিকশিত হয়েছিল কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসনের আনুষ্ঠানিক সীমানা অতিক্রম করে এটি সংস্কৃতি, শ্রম, আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ক ও জ্ঞান উৎপাদনের উপর প্রভাব ফেলে। এটি সাহিত্য, একাডেমিক কৃতিত্বের মান, সাংস্কৃতিক প্রবণতা, সাধারণ জ্ঞানানুভূতি, মানুষের স্ব-চিত্র, ব্যক্তিগত লক্ষ্য এবং আধুনিক জীবনের বিভিন্ন দিকগুলিতে বেঁচে থাকে।[১২] এনিবা কিহানো এই ক্ষমতা কাঠামোটিকে "শক্তির ঔপনিবেশিকতা" হিসাবে বর্ণনা করেছেন যা "জ্ঞানের ঔপনিবেশিকতা" ধারণার উপর টিকে আছে[১৩] এবং যা "ক্ষমতার ঔপনিবেশিকতার মূল চালিকাশক্তি"।[১৪] ক্ষমতার ঔপনিবেশিকতা বলতে "শোষণ ও আধিপত্যের আধুনিক রূপের মধ্যকার আন্তঃসম্পর্ককে বোঝায়", অন্যদিকে জ্ঞানের ঔপনিবেশিকতা জ্ঞান উৎপাদনের বিভিন্ন স্তরে উপনিবেশবাদের প্রভাবকে বোঝায়।[১৫] কারেন টাকার জ্ঞানের ঔপনিবেশিকতাকে "বৈশ্বিক ঔপনিবেশিকতার" একটি ব্যবস্থার মধ্যে "নিপীড়নের একাধিক ছেদকারী রূপের একটি" হিসাবে চিহ্নিত করেছেন।[১০] জ্ঞানের ঔপনিবেশিকতা "দর্শন ও জীবনার্থের বিকৃতি ঘটায়"। ক্ষমতার ঔপনিবেশিকতা অন্যদিকে "কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা, ভূমি দখল ও শ্রম শোষণ করে"।[১৬]

জ্ঞানের ঔপনিবেশিকতা নানাবিধ জ্ঞানতাত্ত্বিক উদ্বেগকে সামনে নিয়ে আসে। এটি জ্ঞান উৎপাদনের উদ্দেশ্য, জ্ঞানের নির্দিষ্ট রূপের প্রাসঙ্গিকতা ও অপ্রাসঙ্গিকতা, এবং কীভাবে জ্ঞানের নির্দিষ্ট একটি রূপ নির্দিষ্ট ব্যক্তি ও সম্প্রদায়কে বিতাড়িত বা ক্ষমতায়িত করে এসব বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করে।[১৭] ধারণাটি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মৌলিক জ্ঞানতাত্ত্বিক বিভাগ ও দৃষ্টিভঙ্গি যেমন বিশ্বাস ও বস্তুনিষ্ঠ সত্যের সাধনা, যৌক্তিক বিষয়ের ধারণা, জ্ঞান অর্জনকারী সত্ত্বা ও জ্ঞাত বস্তুর মধ্যকার জ্ঞানতাত্ত্বিক পার্থক্য, বৈজ্ঞানিক জ্ঞান, এবং মানব প্রকৃতির সর্বজনীনতার বৈধতা-অনুমান নিয়ে প্রশ্ন তোলে। এই তত্ত্ব অনুসারে, জ্ঞানতাত্ত্বিক এই বিভাগ ও মনোভাব হল "ইউরোপকেন্দ্রিক নির্মাণ বা তত্ত্বায়ন" যা অন্তর্নিহিতভাবে "আধিপত্যবাদী ঔপনিবেশিক ইচ্ছারই" প্রতিফলন বলে উল্লেখ করা যেতে পারে।[৯] উপনিবেশ বিরোধী তাত্ত্বিকরা "ইউরোপকেন্দ্রিক জ্ঞান ব্যবস্থার" কথা উল্লেখ করেন, যা তারা বিশ্বাস করেন যে একমাত্র ইউরোপীয়দের কাছে জ্ঞান সৃষ্টির দায়িত্ব অর্পণ করেছে এবং জ্ঞান উৎপাদনের ইউরোপীয় পদ্ধতির ব্যবহারকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। কিহানোর মতে, বৈশ্বিক শক্তি বিস্তারের নতুন এই ধারার উপর ইউরোপ তার আধিপত্যের অধীনে আত্মমাত্রিকতা, সংস্কৃতি এবং বিশেষ করে জ্ঞান ও জ্ঞান সৃষ্টির উপায় উপকরণের উপর স্থায়ী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। এর ফলে, একদিকে উপনিবেশিত জনগোষ্ঠীর সৃষ্ট জ্ঞান যেমন প্রত্যাখ্যাত হয়েছে, অন্যদিকে তেমনি শ্রেণীবদ্ধ কাঠামোর শ্রেষ্ঠত্ব/নিকৃষ্টতার মাণের ভিত্তিতে জ্ঞান উৎপাদনের ঐতিহ্যবাহী রূপকে দমন করা হয়েছে।[১৮]

কিহানো ইউরোপকেন্দ্রিক জ্ঞানকে একটি "নির্দিষ্ট যৌক্তিকতা বা জ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে বর্ণনা করেছেন যা উপনিবেশবাদ ও পুঁজিবাদের আন্তঃসম্পর্কিত ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী প্রভাব বিস্তার করে। এটি "বস্তুর বিভাগ" এর মধ্যে দ্বিমাত্রিক শ্রেণীবদ্ধ সম্পর্ক তৈরি করে কাজ করে এবং এটি একটি নির্দিষ্ট ধর্মনিরপেক্ষ, উপকরণ ও "প্রযুক্তিগত যৌক্তিকতার" প্রতীক যা কিহানো সতেরো শতকের মধ্যভাগের পশ্চিম ইউরোপীয় চিন্তাধারা এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর বৈশ্বিক পুঁজিবাদী সম্প্রসারণের দাবির প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন।[১০] কিহানোর মতে, এটি "আদিম-সভ্য," "অযৌক্তিক-যৌক্তিক," ও "প্রথাগত-আধুনিক" এমন বিভাগগুলি ব্যবহার করে পশ্চিম ইউরোপ ও বাকি বিশ্বের মধ্যে সম্পর্ক নির্ধারণ করে এবং তাদের মধ্যে পার্থক্য ও শ্রেণিবিন্যাস তৈরি করে। এই বিভাজনে অইউরোপীয়দের অতীতের সাথে সংযুক্ত করা হয়, এবং এইভাবে "নিকৃষ্ট" ও "সর্বদা আদিম" হিসেবে বর্ণনা করা হয়।[১০] একইভাবে, এটি পশ্চিম ইউরোপ ও "অইউরোপ" এর মধ্যকার সম্পর্ককে জ্ঞান অর্জনকারী সত্ত্বা ও জ্ঞাত বস্তুর মাঝের সম্পর্ক হিসেবে দেখে। এমন দৃষ্টিভঙ্গি কেবল পশ্চিম ইউরোপকে নির্ভরযোগ্য জ্ঞানের একমাত্র উৎস বলে স্বীকৃতি দেয়।[১০] কিহানোর মতে, "পশ্চিমা জ্ঞানতাত্ত্বিক ব্যবস্থা" এই ধারণা দেয় যে:

শুধুমাত্র ইউরোপীয় সংস্কৃতি যুক্তিসঙ্গত, এটি "জ্ঞান অর্জনকারী সত্ত্বা" ধারণ করতে পারে - অন্য সংস্কৃতিগুলি যুক্তিসঙ্গত নয়, সেগুলো "জ্ঞান অর্জনকারী সত্ত্বা" ধারণ করতে অক্ষম। ফলস্বরূপ, অন্যান্য সংস্কৃতিগুলি এই অর্থে আলাদা যে তারা অসম, এবং প্রকৃতিগতভাবে নিম্নমানের। এগুলি কেবল জ্ঞানের বা আধিপত্য অনুশীলনের "বস্তু" হতে পারে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে ইউরোপীয় সংস্কৃতি ও অন্যান্য সংস্কৃতির মধ্যে "দ্রষ্টা" ও "দৃষ্টির" মধ্যকার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যা এখনো বজায় রয়েছে। এইভাবে এটি আন্তসাংস্কৃতিক যোগাযোগের প্রতিটি পথ, জ্ঞানের বিনিময় এবং সংস্কৃতির মধ্যে জ্ঞান উৎপাদনের পদ্ধতিগুলি অবরুদ্ধ করে দেয়, যেহেতু এই দৃষ্টিভঙ্গি বোঝায় যে "জ্ঞান অর্জনকারী সত্ত্বা" ও "জ্ঞাত বস্তুর" মধ্যে বাহ্যিকতার সম্পর্ক ছাড়া আর কিছু থাকতে পারে না।[১৯]

— এনিবা কিহানো, পল এন্থনি চেম্বার্স কর্তৃক উদ্ধৃত, এপিস্টেমোলোজি এন্ড ডোমিনেশন, ২০২০

কিহানো ও এনরিক ডাসেলের মতো অন্যান্য চিন্তাবিদদের দ্বারা প্রস্তাবিত এই বিষয়-বস্তু/দ্রষ্টা-দৃষ্টি দ্বৈতবাদটি র‍্যনে দেকার্তের কোগিটোর একটি নির্দিষ্ট পাঠের উপর ভিত্তি করে তৈরি। "আমি চিন্তা করি, তাই আমার অস্তিত্ব আছে" র‍্যনে দেকার্তের বিখ্যাত অভিব্যক্তির এই "আমি" হল এক সাম্রাজ্যবাদী "আমি", যা কিহানোর মতে "ইউরোপীয় প্রেক্ষাপটের বাইরে অন্য 'সত্ত্বার" প্রতিটি রেফারেন্স বাদ দেওয়া সম্ভব করেছে"।[৯] [৯]

ইউরোপে লিওটার্ড, ভাট্টিমো ও দেরিদার পূর্বে আর্জেন্টিনীয় দার্শনিক এনরিক ডাসেল পশ্চিমা অধিবিদ্যার বিষয়ে হাইডেগারের সমালোচনার পরিণতির ইঙ্গিত দিয়েছিলেন এবং ইউরোপীয় আলোকায়ন ও ঔপনিবেশিক শক্তিকে কেন্দ্র করে বিকশিত হওয়া আধুনিক সত্ত্বার মধ্যে অন্তর্নিহিত সম্পর্কের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। কার্তেসীয় ইগো কগিটোর পিছনে একটি লুকানো সাংকেতিক অর্থ রয়েছে যার মাধ্যমে নির্মিত "আলোকিত সত্ত্বা" নিজেকে স্বর্গীয় আসনে বসায় এবং বস্তু-জগতের গঠন ও আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম এমন এক ধরনের দেবতা হয়ে ওঠে। আধুনিক ইগো কোগিটো যা মডার্নিটি বা আধুনিকতার জন্ম দিয়েছে, এইভাবে ক্ষমতার ইচ্ছায় পরিণত হয়: "আমি চিন্তা করি" তখন "আমি জয় করি" এর সমতুল্য হিসেবে বিবেচিত হয়। এটি সেই জ্ঞানতত্ত্বীয় ভিত্তি যার উপর ইউরোপীয় আধিপত্য ষোড়শ শতাব্দী থেকে টিকে আছে।[২০]

— সান্তিয়াগো কাস্ত্রো-গোমেজ, পল এন্থনি চেম্বার্স কর্তৃক উদ্ধৃত, এপিস্টেমোলোজি এন্ড ডোমিনেশন, ২০২০

ঔপনিবেশিকতা বিরোধী দৃষ্টিকোণ অনুসারে, জ্ঞানের ঔপনিবেশিকতা এইভাবে ঐতিহাসিকভাবে প্রোথিত ও জাতিগতভাবে চালিত বুদ্ধিবৃত্তিক অনুশীলনগুলিকে বোঝায় যা উপনিবেশিত সমাজের অধঃপতনের সাথে সাথে ঔপনিবেশিক সভ্যতার জ্ঞানের রূপগুলি ও "জ্ঞান-উৎপাদন নীতি"কে ক্রমাগত সমুন্নত করে। এটি ঔপনিবেশিক শাসনের "সহিংসতায়" জ্ঞানের ভূমিকার উপর জোর দেয়, সেইসাথে এই সময়ের মধ্যে তৈরি হওয়া অনুভূত জাতিগত শ্রেণিবিন্যাস ও নিপীড়নকে টিকিয়ে রাখতে জ্ঞানের কার্যকারিতার উপর গুরুত্ব আরোপ করে।[১০]

দিক সম্পাদনা

সারাহ লুসিয়া হোগল্যান্ড "ইঙ্গো-ইউরোপীয় জ্ঞানানুশীলন" এর ঔপনিবেশিকতার চারটি দিক চিহ্নিত করেছেন:[২১]

  • জ্ঞানের ঔপনিবেশিকতা ইঙ্গো-ইউরোপকেন্দ্রিক অনুশীলনগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করে, যেখানে তৃতীয় বিশ্বের নারীদের জীবনকে তুলে ধরার একমাত্র আদর্শ হল ইঙ্গো-ইউরোপীয় আদর্শ। হোগল্যান্ডের মতে, পশ্চিমা গবেষকরা "নারীদের" সম্পর্কে গবেষণার জন্য পশ্চিমা ধারণার আশ্রয় নিয়ে অ-পশ্চিমা নারীদের জীবন মূল্যায়ন করেন। এইভাবে, পশ্চিমা নারীবাদীরা তাদের বিষয়গুলিকে পশ্চিমা জ্ঞানতাত্ত্বিক বিভাগ ও আদর্শ এবং পশ্চিমা সংকেতবিজ্ঞান ও অনুশীলনের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেন। তিনি দাবি করেন যে অনেক পশ্চিমা নারীবাদী গবেষক তাদের গবেষণার বিষয়গুলিকে সাংস্কৃতিক গঠন বা নির্মাণের মাধ্যমে উপলব্ধি করেন যা অ-পশ্চিমা নারীদের নারীত্বের পশ্চিমা ধারণার সাথে মিলিয়ে দেখে। এই দৃষ্টিভঙ্গি অ-পশ্চিমী নারীদের পশ্চাৎপদ বলে ধরে নিয়ে তাদের "আলোকিত উদ্ধারের প্রয়োজন" এমন ভাষ্য প্রদান করে।[২১]
  • গবেষণার বিষয়বস্তুকে কেবল আধুনিক জ্ঞানতত্ত্ব দ্বারা সংজ্ঞায়িত যৌক্তিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা হয়। হোগল্যান্ড এনিবা কিহানোকে উদ্ধৃত করেছেন, যিনি যুক্তি দেন যে পনেরো শতকে আমেরিকায় স্পেনীয় উপনিবেশ স্থাপনের সাথে জ্ঞানচর্চার উপনিবেশায়ন শুরু হয়েছিল যা এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত হতে সহায়তা করে যে পশ্চিমা জ্ঞান-সত্ত্বার বাইরে অন্য কোথাও জ্ঞান-সত্ত্বার উপস্থিতি সম্ভব নয়।[২১]
  • গবেষণা পদ্ধতিগুলি অনুমান করে নেয় যে "(অনুমোদিত) জ্ঞান অর্জনকারী সত্ত্বা" হল গবেষণা কার্যক্রমের একমাত্র এজেন্ট, এবং অনুমোদনকারী প্রতিষ্ঠানের ভিতরে তথ্য ব্যাখ্যা করা ও প্রক্রিয়াজাত করা একান্তই তাদের বিবেচনার বিষয়। ফলস্বরূপ, "পশ্চিমা বৈজ্ঞানিক অনুশীলন" গবেষককে প্রাপ্ত তথ্যের "বিশ্বাসযোগ্যতার বিচারক ও এর কর্তৃত্বের দ্বাররক্ষক" হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে, যে বিষয়টিকে তিনি "ঔপনিবেশিক সম্পর্কের একটি বিতর্কমূলক নীতি" হিসাবে চিহ্নিত করেন।[২১] এমন ধারণা এই অনুমানের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত যে, পশ্চিমা শিক্ষাবিদরা একচোখা নীতি নিয়ে "তথ্যের ব্যাখ্যা ও প্রক্রিয়াজাতকরণ" করতে অভ্যস্ত। কারণ, এটি করার জন্য শুধুমাত্র গবেষকেরই সঠিক এজেন্সি রয়েছে বলে মনে করা হয়।[২১] হোগল্যান্ডের মতে, গবেষককেও তার গবেষণার বিষয়গুলির মতোই সতর্কতার সাথে পরীক্ষা করা উচিত।[২১]

"তাদের" সম্বন্ধে "আমাদের" সাথে "আমাদের" কথোপকথন এমন একটি কথোপকথন যেখানে "তাদের" চুপ করিয়ে দেওয়া হয়। "তারা" সবসময় পাহাড়ের অন্য পাশে দাঁড়িয়ে থাকে; নগ্ন, নির্বাক ও অনুপস্থিত।[২২]

— তৃন্তি মিনহা, উইমেন, নেটিভ, আদার, সারাহ লুসিয়া হোগল্যান্ড কর্তৃক উদ্ধৃত, আসপেক্টস অব দ্য কলোনিয়ালিটি অব নলেজ, ২০২০
  • জ্ঞানের ঔপনিবেশিকতা "পশ্চিমা ভাষ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণতা অনুমান করে" এবং পশ্চিমা চিন্তাধারায় "অন্যান্য সংস্কৃতি, অন্যান্য জ্ঞান এবং অন্যান্য উপায়ে অনুবাদ ও পুনর্লিখনের" অনুশীলনকে বোঝায়।[২১] হোগল্যান্ড যুক্তি দিয়েছেন যে পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে আদিবাসী দাবিগুলিকে বোধগম্য করার জন্য পুনর্নির্মাণ করা আদিবাসী সংস্কৃতিকে পুনর্লিখনের মাধ্যমে নির্মূল করার সমান। কারণ, এই ধরনের জানার ও গবেষণার বিষয় "আদিবাসীদের নিজস্ব শর্তে জ্ঞাত বিষয় হিসাবে পরিগণিত হয় না", কারণ "তারা পশ্চিমা পরিভাষায় জ্ঞান অর্জনকারী সত্ত্বা হিসাবে স্বীকৃত নন", কিংবা "যৌক্তিক" নন এবং ব্যক্তিকেন্দ্রিকতাবাদে বিশ্বাসী নন।[২১]

নিক শেফার্ডের মতে, জ্ঞানের ঔপনিবেশিকতার তিনটি মাত্রা রয়েছে: কাঠামোগত ও যৌক্তিক; জ্ঞানতাত্ত্বিক; এবং নৈতিক ও নীতিশাস্ত্রীয়।[২৩] শেফার্ডের মতে ডেটা বা তথ্য সবসময়ই শুধুমাত্র একটি দিকে অর্থাৎ পশ্চিমের দিকে প্রবাহিত হয় যা মূলত নিষ্কাশন প্রকৃতির। তথ্য, পর্যবেক্ষণ ও নিদর্শনগুলি দক্ষিণের বিশ্ব ও প্রাচ্য থেকে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার "শৃঙ্খলামূলক মহানগরে" স্থানান্তরিত হয়েছে, যেখানে সেগুলি প্রক্রিয়াজাত ও প্রকাশিত হয়। মেট্রোপলিটান প্রতিষ্ঠানের পণ্ডিতরা তাদের গবেষণা কর্মের দরুন পদমর্যাদা ও শ্রেণিবিন্যাসে অগ্রাধিকার প্রাপ্ত হন, কিন্তু গবেষনা কাজে সহায়তাকারী বিশ্ব-দক্ষিণের অংশগ্রহণকারীরা কেবলই "ভূমিতে স্থানীয় সহযোগী" হিসাবে বিবেচিত হয়। তাদের প্রায়শই "তথ্যদাতা", "খননকারী" বা সহজভাবে "ছোকরা (boys)" হিসাবে উল্লেখ করা হয়। যদিও এই বিষয়টিকে একটি ঐতিহাসিক পরিস্থিতি হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, শেফার্ডের মতে এই অনুশীলনটি আজও অব্যাহত রয়েছে এবং এটি জ্ঞানের ঔপনিবেশিকতার কাঠামোগত ও যৌক্তিক দিকগুলি গঠন করে।[২৩]

জ্ঞানতাত্ত্বিক মাত্রায় জ্ঞানের ঔপনিবেশিকতা সাধারণত ধারণকৃত বিভাগ ও ধারণাগুলিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে যা বৌদ্ধিক প্রক্রিয়াকে চিহ্নিত করে। সেইসাথে জ্ঞান কী এবং জ্ঞান কীভাবে কাজ করে সে সম্পর্কে একটি বোঝাপড়ার ক্ষেত্র নির্দেশ করে। ঔপনিবেশিকতা ও আধুনিকতার সংযুক্ত পদ্ধতিগুলি কীভাবে জ্ঞানকে বিভিন্ন শাখায় ধারণা ও গঠনের উপায়ে প্রকাশ করে তা বুঝতে এটি সহায়তা করে।[২৩] এর নৈতিক ও নীতিশাস্ত্রীয় মাত্রায়, জ্ঞানের উপনিবেশিকতা সেই অধিকারগুলিকে বোঝায় যা বিষয়ভিত্তিক অনুশীলনকারীরা তাদের প্রশিক্ষণের অংশ হিসাবে অর্জন করে। এটি তাদের অবস্থান ও পরিস্থিতিতে হস্তক্ষেপ করার অনুমতি দেয় কেবল বৈজ্ঞানিক অধিকার হিসাবে নয়, একটি নৈতিক কাজ হিসাবেও। শেফার্ড তার নিজস্ব ক্ষেত্র প্রত্নতত্ত্ব থেকে উদাহরণ তুলে ধরেছেন, যেখানে স্থানীয়দের দ্বারা পূজনীয় পবিত্র স্থানগুলিতে নিয়ম ভঙ্গ করে নিষ্কাশন করা হয়েছিল।[২৩]

একইভাবে, আরাম জিয়াই ও অন্যরা জ্ঞান উৎপাদনের তিনটি স্বতন্ত্র কিন্তু পরস্পর সংযুক্ত স্তরে "ঔপনিবেশিকতার সমস্যা" চিহ্নিত করেছেন।

ঔপনিবেশিকতার সমস্যা আমরা জ্ঞানের বিভিন্ন স্তরে যেমন জ্ঞানতত্ত্বে দেখতে পাই (কার অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান বৈধ কিংবা বৈজ্ঞানিক জ্ঞান হিসাবে গণ্য হয়? অন্যান্য জ্ঞানের অবমূল্যায়ন ও ধ্বংসের সাথে সর্বজনীনতার দাবি উত্থাপন করে জ্ঞানের এমন একটি তত্ত্ব কীভাবে যুক্ত?)। এর পাশাপাশি তত্ত্ববিদ্যায়ও এর প্রভাব উপলব্ধ (কোন উপাদানগুলি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং আমাদের গবেষণার ভিত্তি তৈরি করে এবং কোন উপাদানগুলিকে অপ্রাসঙ্গিক হিসাবে দেখা হয়? এটি কি আধিপত্যের বৈধতা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে? আমরা কি আমাদের বিশ্লেষণের ইউনিটগুলি স্বতন্ত্র ও বিচ্ছিন্ন বা সর্বদা ঐতিহাসিকভাবে আন্তঃসম্পর্কিত ও জড়িত হিসাবে উপলব্ধি করি?)। গবেষণা পদ্ধতির স্তরে আমরা এটিকে গবেষণার বিষয় ও বস্তুগুলির মধ্যে বিদ্যমান ক্ষমতার সম্পর্কের মধ্যে দেখি (কাকে জ্ঞান উৎপাদনে সক্ষম হিসাবে দেখা হয়? গবেষণার উদ্দেশ্য কে নির্ধারণ করে? গবেষণার জন্য কে উপাত্ত সরবরাহ করে এবং কে এই ভিত্তিতে তত্ত্ব গঠন এবং ক্যারিয়ার তৈরিতে জড়িত?)। একাডেমির স্তরে আমরা এটিকে পাঠ্যক্রমে দেখতে পাই (কোন ধরনের জ্ঞান এবং কোন লেখকদের লেখা বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পড়ানো হচ্ছে?)। এর পাশাপাশি পণ্ডিতদের নিয়োগেও এর প্রভাব রয়েছে (উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে কে জ্ঞানের উৎপাদক হবেন তা নির্ধারণ করতে শিক্ষা ব্যবস্থায় বর্জনের কোন পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়?)। [২৪]

— ডি বেন্ডিক্স; এফ মুলার; আরাম জিয়াই, বিয়োন্ড দ্য মাস্টার্স টুলস, ২০২০

প্রভাব সম্পাদনা

উইলিয়াম এমপোফুর মতে, জ্ঞানের ঔপনিবেশিকতা উপনিবেশের শিকার জনগোষ্ঠীকে "সত্তার ঔপনিবেশিকতার শিকারে" পরিণত করে, যা তাদের "নিকৃষ্টকরণ, প্রান্তিকীকরণ ও অমানবিককরণের শর্তে" যাচাই করে। এটি তাদের ঔপনিবেশিকতার দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা ও ভাষার উপর এর প্রভাবের বিষয়টি প্রাথমিকভাবে উল্লেখ করে।[২৫] [১৫] জ্ঞানের ঔপনিবেশিকতা জোর দিয়ে বলে যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি "ঔপনিবেশিকতা, ক্ষমতা ও জ্ঞানের অহং-রাজনীতির জটকে প্রতিফলিত করার মাধ্যমে" এমন এক "পক্ষপাতকে" নির্দেশ করে যা পাশ্চাত্য জ্ঞান উৎপাদনকে নিরপেক্ষ ও সর্বজনীন হিসেবে উপস্থাপন করে। অন্যদিকে, "আর্থ-রাজনৈতিক অবস্থান, যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতা ও সামাজিক সম্পর্ক" দ্বারা প্রভাবিত জ্ঞান উৎপাদনকে "নিকৃষ্ট ও ছদ্ম-বৈজ্ঞানিক" হিসাবে প্রত্যাখ্যান করে।[২৬] পোলোমা ও অন্যরা যুক্তি দিয়েছেন যে আমেরিকান-ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয় মডেলের বিশ্বব্যাপী আধিপত্য জ্ঞানের ঔপনিবেশিকতার প্রতীক, যা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে পশ্চিমা পাঠ্যক্রমের অন্ধ অনুকরণ, নির্দেশনা ও গবেষণায় ইংরেজি ভাষার প্রাধান্য, বৈশ্বিক র‍্যাংকিংয়ের প্রতি দুর্বলতা এবং ইউরোপ-আমেরিকা দেশীয় সনদের গুরুত্ব প্রদানের মাধ্যমে শক্তিশালী হয়।[২৬]

সিলোভা ও তার সহযোগীরা দাবি করেন যে জ্ঞান উৎপাদনের ঔপনিবেশিকতা অনিচ্ছাকৃতভাবে একাডেমিক পরিচয় তৈরি করেছে, যা "অ-পশ্চিমী বা পশ্চিম ঘেঁষা" উভয় ধরনের গবেষকদের পশ্চিমা চিন্তাধারা গ্রহণ করতে বাধ্য করে। অন্যথায়, জ্ঞান সৃষ্টির প্রক্রিয়ায় তাদের প্রান্তিকীকরণের শিকার হতে হয়।[২৭] ফলস্বরূূপ, "একাডেমিক ভাঁড়ামি" বা "বুদ্ধিবৃত্তিক অনুকরণ" সৃষ্টি হয়।[২৮] জ্ঞানের ঔপনিবেশিকতা একটি জ্ঞান-বাধা তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে যা অ-পশ্চিমা ধারণাগুলি গ্রহণ করে ছাত্র ও শিক্ষাবিদদের নতুন জ্ঞান তৈরির পথে বাঁধা দেয়। এটি মূলধারার পাঠ্যক্রমের উপরও উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে, যা একইভাবে পশ্চিমা ধ্যান-ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত, যে কারণে শিক্ষার্থীদের জন্য পশ্চিমা জ্ঞানতাত্ত্বিক কাঠামোর বাইরে অগ্রসর হওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।[২]

সমালোচনামূলক মূল্যায়ন সম্পাদনা

পল অ্যান্থনি চেম্বার্স জ্ঞানের ঔপনিবেশিকতার তত্ত্বকে কিছু ক্ষেত্রে, বিশেষ করে কার্তেসীয় জ্ঞানতত্ত্বের সমালোচনায়, "সমস্যামূলক" বলে বিবেচনা করেন, যা উপনিবেশবাদের উত্তরাধিকার এবং জ্ঞানের উৎপাদন, বৈধতা ও স্থানান্তরের মধ্যে একটি যোগসূত্র প্রস্তাব করে। যদিও চেম্বার্স জ্ঞানের ঔপনিবেশিকতা তত্ত্বের অনেক দাবির সাথে একমত পোষণ করেন, তিনি কার্তেসীয়/পাশ্চাত্য জ্ঞানতত্ত্বের সাথে বৈশ্বিক জ্ঞান উৎপাদনের অসাম্যপূর্ণ নিদর্শনগুলি এবং আধিপত্যের বৃহত্তর রূপ ও শোষণের সম্পর্ককে এই তত্ত্ব "পর্যাপ্তভাবে প্রদর্শন করতে ব্যর্থ" হওয়ার জন্য সমালোচনা করেন।[৯] চেম্বার্স "জ্ঞান উৎপাদনের সমস্যাযুক্ত রাজনৈতিক ও সমাজতাত্ত্বিক মাত্রা" স্বীকার করেন, যে বিষয়ে উপনিবেশ নিরোধী চিন্তাবিদরাও জোর দেন বলে তিনি মত দেন। কিন্তু তিনি এই ধারণার কিছু অন্তর্নিহিত যুক্তির বিষয়ে আপত্তি করেন, যা তার মতে কার্তেসীয় জ্ঞানতত্ত্বকে "বৈশ্বিক জ্ঞানের অন্যায্য কাঠামোর" জন্য দায়ী করে। তিনি যুক্তি দিয়েছেন যে ধারণাটি কার্তেসীয় জ্ঞানতত্ত্বের বৈশ্বিক প্রভাব ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হয়েছে।[৯] চেম্বার্সের মতে,

"কিহানোর দাবিগুলি জ্ঞানতাত্ত্বিক শ্রেণিবিভাগের বিষয় ও বস্তুর মধ্যে একটি সন্দেহজনক সংযোগ এবং ইউরোপের আদর্শগত ও বর্ণবাদী বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত যা ইউরোপীয়দের স্বাভাবিকভাবেই ভারতীয় ও অন্যান্য উপনিবেশিত সম্প্রদায়ের থেকে উচ্চতর বলে ধরে নেয়। যদিও সকল ইউরোপীয়দের চিন্তায় এর ছাপ পাওয়া যায় না। কিহানোর মতে, এই ধারণা অন্যদের নিকৃষ্ট বলে মনে করে। কারণ, তারা "যৌক্তিক চিন্তাভাবনা করতে অক্ষম ও শিশুদের সমতুল্য এবং একারণে কার্যকরভাবে অ-স্বায়ত্তশাসিত বস্তু"৷[৯]

— পল এন্থনি চেম্বার্স, এপিস্টেমোলোজি এন্ড ডোমিনেশন, ২০২০

চেম্বার্স যুক্তি দেন যে "যদিও কান্টের মধ্যে এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি পাওয়া যায়, তবে দেকার্তের দর্শনে এর কোন প্রমাণ নেই"।[৯] অন্যদিকে, সারাহ লুসিয়া হোগল্যান্ড এই মতের বিপরীতে বলেন যে, কার্তেসীয় পদ্ধতি "অত্যন্ত পরিশীলিত এক ইউরোপকেন্দ্রিকতার" জন্ম দিয়েছে যা এর ইন্দ্রিয় সীমার বাইরে থাকা সমস্ত জ্ঞানধারা ও জ্ঞানসত্ত্বাকে বরখাস্ত করেছে। হোগল্যান্ডের মতে, এই ধারা "প্রান্তিক, নিম্নবর্গীয়, ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা হয়েছে এমন সম্প্রদায় কিংবা অপরাধীকরণের শিকার জনগোষ্ঠীর" জ্ঞানতাত্ত্বিক বিশ্বাসযোগ্যতা অস্বীকার করার মাধ্যমে অসম শক্তি সম্পর্ক বজায় রাখে, এবং এর ফলে পারস্পরিক আন্তঃসম্পর্ককে অস্বীকার করে।"[২৯]

টীকা সম্পাদনা

  1. পোলোমা ও অন্যরা: "জ্ঞানের ঔপনিবেশিকতা ঔপনিবেশিকতার তত্ত্ব থেকে উদ্ভূত একটি ধারণা যা শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলিতে ঔপনিবেশিকতা, ক্ষমতা ও জ্ঞানতাত্ত্বিক অহং-রাজনীতির জটিলতাকে নির্দেশ করে।"[৩]
  2. লেসেম ও অন্যরা: "ঔপনিবেশিকতার কেন্দ্রে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা রয়েছে: 'ক্ষমতার ঔপনিবেশিকতা'; 'জ্ঞানের ঔপনিবেশিকতা'; এবং 'সত্তার ঔপনিবেশিকতা'।" [৪] স্টেইন ও এমপোফু: "ঔপনিবেশিকতা তিনটি স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে আছে: জ্ঞানের ঔপনিবেশিকতা, ক্ষমতার ঔপনিবেশিকতা এবং সত্তার ঔপনিবেশিকতা।"[৫] বেনিয়েরা ও অন্যরা: "তিনটি উপাদান নিয়ে বৈশ্বিক ঔপনিবেশিকতা গঠিত। সেগুলো হল, ক্ষমতার ঔপনিবেশিকতা, সত্তার ঔপনিবেশিকতা ও জ্ঞানের ঔপনিবেশিকতা।[৬]
  3. পল এন্থনি চেম্বার্স: "জ্ঞানের ঔপনিবেশিকতার ধারণার সূত্রপাত হয়েছে মূলত পেরুর সমাজবিজ্ঞানী এনিবা কিহানো দ্বারা ১৯৯২ সালে স্প্যানিশ ভাষায় প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রের মাধ্যমে, যেখানে তিনি "ক্ষমতার ঔপনিবেশিকতা" ধারণাটি তৈরি করেছিলেন।"[৭]
  4. কারেন টাকার: "যেহেতু আমি "ঐতিহ্যগত জ্ঞানের" বিভিন্ন পদ্ধতির মধ্যে সংযোগ এবং সংযোগ বিচ্ছিন্নতা বুঝতে চেয়েছি, তাই আমি "জ্ঞানের ঔপনিবেশিকতার" ধারণার আলোকে চিন্তা করা দরকারী বলে মনে করেছি। ধারণাটি পেরুর সমাজবিজ্ঞানী এনিবা কিহানোর সাথে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত, যিনি পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ল্যাটিন আমেরিকার ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতার আলোকে ক্ষমতা, জ্ঞান, জাতিগত শ্রেণিবিন্যাস এবং পুঁজিবাদী বৈশ্বিক কাঠামোর উপর একটি বিস্তৃত প্রতিফলনের অংশ হিসাবে এটি ধারণাবদ্ধ করেছিলেন।"[৮]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Beer ও Mackenthun 2015, পৃ. 13।
  2. Fregoso Bailón ও De Lissovoy 2018
  3. Poloma ও Szelényi 2018, পৃ. 3।
  4. Mamukwa, Lessem এবং Schieffer 2016, পৃ. 23।
  5. Steyn ও Mpofu 2021, পৃ. 115।
  6. Benyera এবং অন্যান্য 2020, পৃ. 53।
  7. Chambers 2020, পৃ. 3-36।
  8. Tucker 2018, পৃ. 219।
  9. Chambers 2020
  10. Tucker 2018
  11. Dreyer 2017
  12. Ndlovu 2018
  13. Ibarra-Colado 2006
  14. Conway 2013
  15. Maldonado-Torres 2007
  16. Salazar 2012
  17. Haynes 2020
  18. Quijano 2000
  19. Chambers 2020, পৃ. 4-36।
  20. Chambers 2020, পৃ. 10-36।
  21. Hoagland 2020
  22. Hoagland 2020, পৃ. 54।
  23. Shepherd, Nick (২০১৯)। "Epistemic Decolonization"ECHOES: European Colonial Heritage Modalities in Entangled Cities। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১০-২৬ 
  24. Bendix, Müller এবং Ziai 2020, পৃ. 6।
  25. Mpofu 2020
  26. Poloma ও Szelényi 2018
  27. Silova, Millei এবং Piattoeva 2017
  28. Ndlovu-Gatsheni 2013
  29. Hoagland 2012

সূত্র সম্পাদনা

আরও পড়ুন সম্পাদনা

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা