জেমস লঙ
জেমস লঙ (৪ জুন ১৮১৪ তাঁর সেন্টপিটার্স চার্চে ব্যাপটিজম হয় – ২৩ মার্চ ১৮৮৭)[১] ছিলেন লেন একজন অ্যাংলো-আইরিশ মিশনারী সোসাইটির ধর্মযাজক। একজন প্রাচ্যবিশারদ, শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক, এবং মানবতাবাদী ব্যক্তিত্ব হিসাবে তার সমধিক পরিচিতি ছিল। তিনি ভারতে চার্চ মিশনারী সোসাইটির সদস্য হিসাবে কলকাতায় আসেন এবং ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দ হতে ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কলকাতার উপকণ্ঠে ঠাকুরপুকুরের মিশনের প্রধান ছিলেন।
জেমস লঙ ক্যালকাটা স্কুল-বুক সোসাইটি, বেথুন সোসাইটি, বেঙ্গল সোস্যাল সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন, এশিয়াটিক সোসাইটির সাথে ঘনিষ্টভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি দীনবন্ধু মিত্রের নীল দর্পণ নাটকটি ইংরেজীতে প্রকাশ করেন যেটি অনুবাদ করেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। সেকারণে তাঁকে মানহানির মামলায় জরিমানা সহ স্বল্প সময়ের কারাবাস ভোগ করতে হয়।
জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবন
সম্পাদনাজেমস লঙ আয়ারল্যান্ডের কাউন্টি কর্কের ব্যান্ডনে জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা জন লঙ এবং মাতা অ্যানে। তিনি বারো বৎসর বয়সে সদ্য প্রতিষ্ঠিত ব্যান্ডন এন্ডোয়েড স্কুলে ভর্তি হন। তিনি সেখানে হিব্রু, গ্রীক, লাতিন ও ইংরাজী ভাষা এবং ইউক্লিড, বীজগণিত, লজিক, পাটিগণিত, হিসাবশাস্ত্র, ইত্যাদিতে সম্যক জ্ঞান, ইতিহাস ভূগোল পরিচয়ে শিক্ষা লাভ করেন[২] অতিশয় মেধাবী ছাত্র ছিলেন তিনি এবং তার বিশেষ প্রিয় বিষয় ছিল ধর্মতত্ত্ব এবং ক্লাসিক।
ইতোমধ্যে ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে চার্চ মিশনারি সোসাইটিতে যোগদানের জন্য তার আবেদন গৃহীত হয় এবং তিনি ইসলিংটনের চার্চ মিশনারি সোসাইটি কলেজে যোগ দেন।[৩] ইসলিংটনে দুবৎসরের প্রশিক্ষণের পর রেভারেন্ড লঙ ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় আসেন চার্চ মিশনারি সোসাইটিতে যোগ দিতে। ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে অল্পসময়ের জন্য ইংল্যান্ডে আসেন উইলিয়াম ওরমের কন্যা এমিলি ওরমাকে বিবাহ করতে।[৪]
১৮৪০ খ্রিস্টাব্দ হতে ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি কলকাতার আমহার্স্ট স্টীটস্থ সিএমএস-এর ভবনে অ-খ্রিস্টান ছাত্রদের শিক্ষা দিতেন।[৫] ১৮৪৮ খ্রিটাব্দে বিবাহের পরে ভারতে প্রত্যাবর্তনের সাথে তাকে ঠাকুরপুকুরের সিএমএস মিশনের প্রধান করা হয়। ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তিনি স্থানীয় বাংলা ভাষায় ছেলেদের জন্য একটি স্কুল এবং তার স্ত্রী এমিলিও ওই সময়ে মেয়েদের জন্য স্কুল স্থাপন করেন। ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে শিক্ষা পরিষদের এফ জে হ্যালিডে কে লেখা এক চিঠিতে তিনি জানালেন যে, হিন্দু, মুসলমান ও খৃস্টান মিলিয়ে প্রায় একশত ছাত্র ক্লাসে আসে।[৬] ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে তার রচিত ব“বাংলা প্রবাদ” বাংলা সাহিত্যে এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন হিসাবে পরিগণিত হয়েছে।[৭] পরবর্তী দুই দশক ধরে তিনি বাংলা প্রবাদ বাক্য এবং লোকসাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেন এবং ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দেA Catalogue of Bengali Newspapers and Periodicals from 1818 to 1855 এবং ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে Descriptive Catalogue of Vernacular Books and Pamphlets শীর্ষক গ্রন্থ প্রকাশ করেন যেটি ভারত সরকার ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে প্যারিসে আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে প্রেরণ করে।
১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় নীল বিদ্রোহের উপর তার আমহার্স্ট স্টীটের সিএমএস স্কুলের ছাত্র দীনবন্ধু মিত্রের বাংলায় লেখা নাটকের একটি বই পান। নাটকের বইটি বিগত বছর ঢাকা থেকে নীল চাষের জমির রায়ত ও মজুরদের উপর নীলকরদের অত্যাচার ও দাস হিসাবে তাদের উপর নিপীড়ন মূলক শোচনীয় অবস্থার পটভূমি নিয়ে বেনামে প্রকাশিত হয়েছিল।।[৮]
জেমস লঙ বিষয়টি বাংলার গভর্নরের সচিব ও ইন্ডিগো কমিশন বা নীল কমিশনের সাবেক সভাপতি হেনরি সেটন করের নজরে আনেন।
তিনি "নীলদর্পণ"-এ বর্ণিত বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে লেফটেন্যান্ট গভর্নর জন পিটার গ্রান্টের সাথে কথা বলেন। গ্রান্ট তখন এটির ইংরাজী অনুবাদ এবং এর বন্ধুদের মধ্যে বিতরণের জন্য কিছু ব্যক্তিগত কপি দেখতে চাইলেন। জেমস লঙ "বাই এ নেটিভ" বেনামে স্বরচিত ভূমিকাসহ ইংরাজীতে অনুবাদ করেন। লঙ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ট্রায়াল কোর্টে অনুবাদকের নাম প্রকাশ করতে অস্বীকার করেছিলেন। ফলে পরে মাইকেল মধুসূদন দত্তকে অনুবাদক হিসাবে ধরা হলে, বিতর্ক রয়ে যায়।[৯] ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল বা মে মাসে মুদ্রিত এই অনুবাদের ভূমিকায় লেখা ছিল লেখকের আন্তরিক ইচ্ছা এই যে, নীল চাষী এবং রায়তদের মধ্যে দ্রুত সম্প্রীতি গড়ে উঠতে পারে ...."[১০] লঙ অনুবাদের পাণ্ডুলিপি ক্যালকাটা প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিশিং প্রেসের ক্লিমেন্ট হেনরি ম্যানুয়েল কাছে পাঠান তিন শত টাকায় পাঁচশত কপি ছাপানোর জন্য। লঙ সেগুলি সরকারি "মহামান্য রাণীর সেবায়" শীর্ষক খামে দেশে ও বিদেশে বিশিষ্ট ইউরোপিয়ানদের পাঠাতে শুরু করেন এবং এ বিষয়টি লেফটেনান্ট গভর্নরের অবগতিতে ছিল না[১১]
নাটকটির ইংরাজী অনুবাদ দেশে বিদেশে প্রচারের ফলে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিল। অনুবাদকর্মে প্রকাশিত নীলকরদের অত্যাচারের ধরন আর জেমস লঙ-এর প্রতিক্রিয়া ও সহমত প্রশাসনকে এতই ক্ষুব্ধ করে যে, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সংবাদপত্রে অনুবাদক ও প্রকাশকের ( ক্লিমেন্ট হেনরি ম্যানুয়েলের) বিরুদ্ধে প্রচার শুরু হয়। "ইংলিশম্যান" পত্রিকা ও "বেঙ্গল হুরকারু এবং ক্রনিকল" পত্রিকার সম্পাদকদের নাটকের ভূমিকায় অপবাদ দেওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দুর্নাম করার কারণে অনুবাদক ও প্রকাশকের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা রুজু করে।[১২]
১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের ১৯ শে জুলাই থেকে ২৪ শে জুলাই সংক্ষিপ্ত সময়ের কলকাতা সুপ্রিম কোর্ট চলা শ্বেতাঙ্গদের নিয়ে গঠিত জুরি বোর্ডের বিচারক এম এল ওয়েলস জেমস লঙ-কে দোষী সাব্যস্ত করে রায় প্রদান করে।[১৩] তাঁকে এক হাজার টাকা জরিমানা ও এক মাসের (১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের জুলাই-আগস্টের মধ্যে) কারাদণ্ড দেওয়া হয়।[১৪] বাংলার কালীপ্রসন্ন সিংহ তাৎক্ষনিকভাবে আদালতে জরিমানার টাকা জমা দেন।
পরবর্তী জীবন এবং উত্তরাধিকার
সম্পাদনানীলদর্পণ কাণ্ডের পর তিন বৎসর বাড়িতে কাটিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে কলকাতায় আসেন। পরে ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি লণ্ডন যাত্রার সময় আমাশয়ে আক্রান্ত হয়ে তার স্ত্রী মারা যান।[১৫] স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি কলকাতায় তার দীর্ঘদিনের বন্ধু ও সহকারী বিপত্নীক রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে একই বাসায় থাকতেন। ওই বছরেই তার স্ত্রীও মারা যান। সেসময় তারা দুজনে মিলে ইন্দো-ব্রিটিশ সায়েরি এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন যাতে ব্রিটিশ উপনিবেশকারীদের সাথে এ দেশীয় মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা যায়। সেখানে তারা অন্যান্যদের সাথে কলকাতার বিশপ জর্জ এডওয়ার্ড লিঞ্চ কটন এবং কেশবচন্দ্র সেন অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
জেমস লঙ যতদিন শিক্ষার কাজে লিপ্ত ছিলেন, তিনি রাশিয়া সম্পর্কে অতি উৎসাহী ছিলেন। তিনি ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে প্রথমবার এবং ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে অবসরে পর দুবার রাশিয়া ভ্রমণ করেন। তিনি ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনে প্রকাশিত তার "রাশিয়া, মধ্য এশিয়া এবং ব্রিটিশ ভারত" শীর্ষক এক রচনায় (সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় কৃষি শ্রমিকের অবস্থা) তিনি "সার্ফ" মুক্তি তথা দাসত্ব মুক্তি সম্পর্কে আশাবাদী ছিলেন। রাশিয়া সম্পর্কে প্যারানোয়ার বর্তমান মনোভাবের বিরুদ্ধে রাশিয়ার সরকার এবং অর্থোডক্স চার্চের ভূমিকা, মধ্য এশিয়ায় খ্রিস্টধর্ম প্রচারের ইসলামের বিরুদ্ধে এক বড় কাজ হিসাবে দেখেছেন।
১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে রেভারেন্ড জেমস লঙ চার্চ মিশনারি সোসাইটি থেকে অবসর নেন এবং চিরকালের জন্য কলকাতা তথা ভারত ত্যাগ করেন। বাকি জীবন তিনি লণ্ডনে অতিবাহিত করেন এবং জীবদ্দশায় বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন। ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ শে মার্চ তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তবে ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে প্রাচ্যের ধর্ম সম্পর্কে বৃটেনের কিছু শিক্ষা কেন্দ্রে তিনি মৃত্যুর পৃর্বে একটি অথবা তার বেশি "লঙ লেকচারশিপ ইন ওরিয়েন্টাল রিলিজিয়ন" শীর্ষক বক্তৃতা আয়োজনের জন্য এক বৃত্তি প্রবর্তন করে যান।[১৬]
কলকাতা মহানগরীতে ঠাকুরপুকুর সংযোগকারী এক প্রধান সড়ক রেভারেন্ড জেমস লঙ এর নামে নামাঙ্কিত করে জেমস লঙ সরণি রাখা হয়েছে।
বিশিষ্ট লোকসংস্কৃতি গবেষক শঙ্কর সেনগুপ্ত জেমস লঙ এর জীবনী, বাংলা সাহিত্যে ও বাঙালীর জীবনে তার যে অবদান তাই নিয়ে ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে রচনা করলেন- পাদরী লঙ বাঙলা সাহিত্য ও বাঙালী জীবন।
আরও পড়ুন
সম্পাদনা- ক্লিং, ব্লেয়ার বি : দ্য ব্লু মিউটিনি: দ্য ইন্ডিগো ডিসটার্বান্সেস ইন বেঙ্গল, ১৮৫০-১৮৬২। পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস, 1977।আইএসবিএন ৯৭৮-০-৮৩৬৪-০৩৮৬-২আইএসবিএন 978-0-8364-0386-2
- লাল, আনন্দ এড। দ্য অক্সফোর্ড কম্প্যানিয়ন টু ইন্ডিয়ান থিয়েটার। নয়াদিল্লি: অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০৪।আইএসবিএন ৯৭৮-০-১৯-৫৬৪৪৪৬-৩আইএসবিএন 978-0-19-564446-3
- ওডি, জিওফ্রে এ । ভারতে সামাজিক প্রতিবাদ: ব্রিটিশ প্রোটেস্ট্যান্ট মিশনারি এবং সামাজিক সংস্কার, ১৮৫০-১৯০০। নয়াদিল্লি: মনোহর, ১৯৭৯।আইএসবিএন ৯৭৮-০-৮৩৬৪-০১৯৫-০আইএসবিএন 978-0-8364-0195-0
- রায়, সমরেন। কলকাতা: সোসাইটি অ্যান্ড চেঞ্জ ১৬৯০-১৯৯০। কলকাতা: আই ইউনিভার্স, ২০০৫।আইএসবিএন ৯৭৮-০-৫৯৫-৩৪২৩০-৩আইএসবিএন 978-0-595-34230-3
বহিঃ সংযোগ
সম্পাদনাতথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ সেনগুপ্ত, শঙ্কর (১৯৮০)। পাদরী লঙ বাঙলা সাহিত্য ও বাঙালী জীবন। ইন্ডিয়ান পাবলিকেশন, কলিকাতা। পৃষ্ঠা মুখবন্ধ।
- ↑ Oddie, p.5
- ↑ Oddie, p.14
- ↑ Oddie, p.35
- ↑ Oddie, p. 25
- ↑ "To the Hon'ble F. J. Halliday", Issue no.22 of Selections from the records of the Bengal Government, (Calcutta Gazette Office, 1855) p.74
- ↑ নূরুল হোসেন চৌধুরী (২০১২)। "লং, রেভারেন্ড জেমস"। ইসলাম, সিরাজুল; মিয়া, সাজাহান; খানম, মাহফুজা; আহমেদ, সাব্বীর। বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। আইএসবিএন 9843205901। ওএল 30677644M। ওসিএলসি 883871743।
- ↑ Bhatia, p.24
- ↑ Preface to Nil Durpan by Sudhi Pradhan, p.xxv
- ↑ Introduction to Nil Durpan by James Long ed. Pradhan, p.xiv
- ↑ Oddie,p.119
- ↑ Bhatia pp.21-22
- ↑ Nil Durpan ed. Pradhan, p.115-116
- ↑ Bhatia p.22
- ↑ Oddie, p.143
- ↑ Oddie, p.178