জেউক্সিপুস স্নানাগার
বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য এর রাজধানী কনস্টান্টিনোপল এ জেউক্সিপুস স্নানাগার একটি জনপ্রিয় স্নানাগার ছিল। ১০০-২০০ খ্রিষ্টাব্দে এটি নির্মিত হয়েছিল যা ৫৩২ খ্রিষ্টাব্দের নিকা বিদ্রোহে ধ্বংস হয় এবং অনেক বছর পরে স্নানঘরগুলো পুনর্নির্মিত হয়।[১] ওই স্থানে পূর্বে একটি জেউস এর মন্দির থাকায় এর নাম জেউক্সিপুস রাখা হয়। [২] প্রাচীন গ্রিক এক্রোপলিস এর একিলিস এর স্নানঘর হতে ৫০০ ইয়ার্ড দক্ষিণে সেগুলো নির্মিত হয়েছিল। প্রথমদিকে বহুবিধ ভাস্কর্যের কারণে স্নানাগারটি বিখ্যাত ছিল। পরে সেগুলো সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়- ৭ম শতকের দিকে। ১৯২৮ সালে জায়গাটি খনন করে স্নানঘরগুলো আবার বানানো হয়।
বর্ণনা
সম্পাদনারোমান সম্রাট সেভেরাস প্রাচীন স্নানাগারটি নির্মাণ করেন[৩] এবং সম্রাট কন্সন্টান্টিন বহুবিধ মোজাইক এবং ৮০ টি মূর্তি দ্বারা এটিকে সুসজ্জিত করেন।[১] বিভিন্ন দেবতা ও পৌরাণিক চরিত্রসহ [৪] হোমার, হেসয়েড, প্লেটো, এরিস্টটল, জুলিয়াস সিজার, ডেমোসথেন্স, এসচিনেস, ভার্জিল প্রমুখের মূর্তি সেখানে ছিল।[৫] এই মূর্তিগুলো এশিয়া ও আশেপাশের রোম, গ্রিস, এশিয়া মাইনর প্রভৃতি অঞ্চল হতে সংগ্রহ করা হয়।[৬] ঐ সময়ের প্রথামত স্নানঘরগুলো সিনেটভবনের পাশে নির্মিত হয়েছিল। লাউসুস এর প্রাসাদও অনুরূপ পৌরাণিক ও অন্যান্য মূর্তি দ্বারা সজ্জিত ছিল।[৭]
সদস্যরা খুব কম খরচে এতে প্রবেশ করতে পারত। প্রথমত স্নানাগার হিসেবে তৈরি হলেও সেখানে শরীরচর্চা এবং বিনোদনেরও ব্যবস্থা ছিল। কাজকর্ম দেখাশোনা, স্নানাগারের কার্যাবলি, খোলা এবং বন্ধ হওয়ার সময় এবং আচরণবিধি মেনে চলার জন্য অংশগ্রহণকারীদের অর্থ দেওয়া হত। নারী এবং পুরুষ একসাথে প্রবেশের নিয়ম ছিল না। হয় তারা ভিন্ন স্নানঘরে যেত অথবা ভিন্ন সময়ে যেত। [৮] কন্সন্টান্টিনোপল এ বেশ কিছু সাধারণ স্নানাগার থাকলেও জেউক্সিপুস বেশ জনপ্রিয় ছিল, সেখানে বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতা থাকা সত্ত্বেও।[৯] এমনকি সেখানে ধর্মগুরু এবং সাধকদের দেখা যেত যদিও প্রবীণরা সেখানে অধর্মীয় কার্যকলাপের শঙ্কা করতেন।[৮]
অবস্থান
সম্পাদনাদ্বাদশ শতকের বিশেষজ্ঞ জোনারাস বর্ণনা করেন কীভাবে সেভেরাস স্নানঘরের সাথে হিপ্পোড্রোম কে সংযুক্ত করেন এবং তা করতে গিয়ে এটি জুপিটার মন্দিরের পাশে নির্মাণ করেন। আরও বিশদ বর্ণনাদানকারী লেউনতিউস বলেন স্নানাগারটি হিপ্পোড্রোম এর সংলগ্ন ছিল, সংযুক্ত ছিল না-
জেউক্সিপুসের শীতল সতেজ স্নানঘর
এবং বিখ্যাত হিপ্পোড্রোমের মাঝে আমি দাঁড়াই।
পর্যটককে দেখতে দাও যেখানে সে স্নানকরে,
অথবা দেখুক দীর্ঘশ্বাস টানা অশ্বের ক্লান্তি,
আনন্দ পেতে অন্তত একবার ঘুরে যাক সে;
আমার কাছে সে উষ্ণ অভ্যর্থনা পাবে।
অথবা যদি পুরুষোচিত ক্রীড়া তার অভিলাষ,
অমসৃণ সড়কটিতে সে তাও চর্চা করতে পারবে।[২]
এছাড়াও জেউক্সিপুস স্নানাগারটি কন্সন্টান্টিনোপল এর বৃহৎ প্রাসাদ (Great Palace of Constantinople) এর নিকটবর্তী ছিল।[১০] এগুলো থেকে স্নানাগারটির জনপ্রিয়তা অনুধাবন করা যায়। এমন একটি স্থানে বহু লোকসমাগম হত এবং স্নানাগারটিও সবার নজরে আসত। আউগুস্তায়েম চত্বর এবং হাজিয়া সোফিয়ার ব্যাসিলিকাও স্নানাগারের আশেপাশে ছিল।
ডানদিকের মানচিত্রে খননকার্য অনুযায়ী কন্সন্টান্টিনোপল এ স্নানাগারটির আনুমানিক অবস্থান দেখানো হয়েছে। স্নানাগারটি প্রায় চতুর্ভুজাকার এবং প্রাসাদের সাথে সংযুক্ত বা খুবই নিকটবর্তী অবস্থানে ছিল।
ধ্বংস এবং পরবর্তী সময়
সম্পাদনা৫৩২ খ্রিষ্টাব্দের নিকা বিদ্রোহে, যা তখনকার কন্সন্টান্টিনোপলকে গুড়িয়ে দিয়ে অর্ধেক শহর ধূলিসাৎ করে এবং সহস্র লোকের প্রাণ কেড়ে নেয়, তাতে জেউক্সিপুসের স্নানাগারটিও পুড়ে ধ্বংস হয়ে যায়। [১] জাস্টিনাইন যখন স্নানাগারটি পুনর্নিমাণের উদ্যোগ নেন তখন নষ্ট হয়ে যাওয়া মূর্তিগুলো আর পুনর্নিমাণ বা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। [৫]
৭ম শতকের শুরুর দিকে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যে চরম সামরিক ও রাজনৈতিক চাপ পড়ায় সাধারণ স্নানাগার বিরল এবং কম জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বিভিন্ন সাধারণ উন্মুক্ত স্থান সামরিক কাজে ব্যবহৃত হতে থাকে। [৮][১১] জানা পর্যন্ত ৭১৩ খ্রিষ্টাব্দে এটি অন্য কিছুতে রূপান্তরিত হওয়ার আগে শেষ স্নানাগার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। স্নানাগারের একাংশ নউমেরা কারাগার এবং অন্য অংশ রেশমের কারখানা হিসেবে ব্যবহৃত হয়।[১২]
প্রায় হাজার বছর পর ১৫৫৬ সালে ওটোম্যান স্থপতি মিমার সিনান এই স্থানে ‘হাসেকি হারেম সুলতান হামাম’ নির্মাণ করেন। আরও পরে ১৯২৭-১৯২৮ সালে মাটি খুঁড়ে বহু প্রত্নসম্পদ যেমন মৃৎপাত্র উদ্ধার করা হয় যেগুলো সেই সময়ের কন্সন্টান্টিনোপলের স্থাপত্য, সমাজ, সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে। [১২][১৩] বিশেষত ওই স্থানে দুটি মূর্তি পাওয়া গেছে, পাদদেশে হেকাবি এবং এয়েসচেনেস লেখা তাতে বোঝা যায় কীভাবে ক্রিস্টোডোরাস স্ন্নাগারের মূর্তিগুলো নিয়ে ‘দি সিক্স এপিগ্রামস’ লিখেছিলেন এবং জোনারাস ও লেউনতিউস এর লেখার সাথেও মিল পাওয়া যায়।[১৪]
সাহিত্যে জেউক্সিপুস
সম্পাদনাজেউক্সিপুস স্নানাগারের মূর্তিগুলোর গৌরবে অনুপ্রাণিত হয়ে মীশরীয় কবি ক্রিস্টোডোরাস হেক্সামিটার (ষাণ্মাত্রিক) ছন্দে ৪১৬ লাইন দীর্ঘ একটি কাব্য রচনা করেন[১৫] এতে ছয়টি স্তবক বা এপিগ্রাম আছে, প্রতিটি স্নানাগারের একগুচ্ছ মূর্তিকে কেন্দ্র করে লেখা, যেগুলো একত্রে একটি সাহিত্যকর্ম হিসেবে রচিত হয়েছে। অনেকে মনে করেন ক্রিস্টোডোরাসের এপিগ্রামগুলো মূর্তির পাদস্তম্ভে খোদিত ছিল, তবে তা বোধ হয় ঠিক নয় কেননা তার লেখায় অতীতকাল ব্যবহৃত হয়েছে।[১৪]
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ ক খ গ Ward-Perkins, B. p. 935
- ↑ ক খ Gilles, P. p. 70
- ↑ Wornum, R.N.
- ↑ Müller, K.O.; Welcker, F.G. p. 208
- ↑ ক খ Bury, J.B. p. 55
- ↑ Evans, J.A.S. p. 30
- ↑ Gregorovius, F.; Hamilton, A. p. 80
- ↑ ক খ গ Rautman, M.L. p. 77
- ↑ Matthews, W. p. 230
- ↑ Tafur, P. p. 225
- ↑ Gibbon, E. p. 950
- ↑ ক খ Kazhdan (1991), p. 2226
- ↑ Zeuxippus Ware
- ↑ ক খ Johnson, S.F. p. 170
- ↑ Bowersock, G.W.; Grabar, O. p. 6
উৎস
সম্পাদনা- Bryan Ward-Perkins The Cambridge Ancient History: Empire and Successors, A.D. 425-600. Cambridge University Press, 2000.
- John Bagnell Bury A History of the Later Roman Empire from Arcadius to Irene (395 A.D. -800 A.D.) Adamant Media Corporation, 2005. আইএসবিএন ১-৪০২১-৮৩৬৯-০
- Pierre Gilles The Antiquities of Constantinople. Italica Press, Incorporated, 1998. আইএসবিএন ০-৯৩৪৯৭৭-০১-১
- Kazhdan, Alexander, সম্পাদক (১৯৯১), Oxford Dictionary of Byzantium, Oxford University Press, আইএসবিএন 978-0-19-504652-6
- Marcus Louis Rautman Daily Life in the Byzantine Empire. Greenwood Press, 2006. আইএসবিএন ০-৩১৩-৩২৪৩৭-৯
- Edward Gibbon The History of the Decline and Fall of the Roman Empire. Penguin Classics, 1995. আইএসবিএন ০-১৪-০৪৩৩৯৪-৫
- Ralph Nickolson Wornum The epochs of painting characterized, a sketch of the history of painting, ancient and modern. 1847.
- Pero Tafur Travels and Adventures 1435-1439 Routledge, 2004.
- Scott Fitzgerald Johnson Greek Literature in Late Antiquity: Dynamism Didacticism Classicism Ashgate Publishing, Ltd., 2006. আইএসবিএন ০-৭৫৪৬-৫৬৮৩-৭
- Karl Otfried Müller, Friedrich Gottlieb Welcker Ancient Art and Its Remains: Or, A Manual of the Archaeology of Art. 1852.
- J. A. S. Evans The Age of Justinian. আইএসবিএন ০-৪১৫-০২২০৯-৬
- Ferdinand Gregorovius, Annie Hamilton History of the City of Rome in the Middle Ages
- William Matthews An historical and scientific description of the mode of supplying London with water. 1841