জাপানি লিখন পদ্ধতি
আধুনিক জাপানি ভাষা তিনটি ভিন্ন লিখন পদ্ধতি (কানা লিপিগুলিকে আলাদা ধরলে চার ধরনের) ব্যবহার করে লেখা হয়:
- চীনা অক্ষর, যেগুলি জাপানি ভাষায় কাঞ্জি (漢字 কান্জি) নামে পরিচিত। বর্তমানে জাপানি ভাষায় প্রায় দুই হাজারের মতো সরকার-অনুমোদিত কাঞ্জি অক্ষর আছে, যেগুলি গণমাধ্যমগুলিতে ব্যবহৃত হয়। তবে এগুলির বাইরেও আরও বেশ কিছু কাঞ্জি প্রচলিত।
- দুই ধরনের ধ্বনিমূলগত লিখন পদ্ধতি, যার নাম "কানা"। মূলত জাপানি শব্দ লিখতে হিরাগানা (ひらがな) পদ্ধতি ব্যবহার হয়, আর বিদেশী (চীনা বাদে) শব্দ লিখতে কাতাকানা (カタカナ) পদ্ধতি ব্যবহার হয়। এগুলি অনেকগুলি স্বর-ব্যঞ্জন সিলেবলের সম্ভার। হিরাগানা ও কাতাকানা প্রতিটিতে ৪৬টি করে ধ্বনিমূলগত অক্ষর আছে, যাদের প্রতিটি কোনও ব্যঞ্জন+স্বর সমবায় (যেমন - কা, পি, তো, বে, সু, ইত্যাদি) নির্দেশ করে।
- রোমাজি (ローマ字 রোওমাজি) বা পশ্চিম থেকে ধার করা রোমান অক্ষর ও সংখ্যা।
প্রতিটি লিপির নিজস্ব প্রয়োগ আছে। কানজি হল চিত্রভিত্তিক লিপির একটি সেট। হিরাগানা এবং কাতাকানা উভয়েই ধ্বনিগত সিলেবলভিত্তিক বর্ণমালা। লিপিগুলির মূল কাজ নিম্নরূপ।
সাধারণত একটি জাপানি বাক্য কাঞ্জি ও কানার সমন্বয়ে লেখা হয়। কাঞ্জি বিষয়বস্তু-সংবলিত শব্দ (content word) লেখার জন্য ব্যবহৃত হয়। আর হিরাগানা জাপানি ভাষার নিজস্ব কিছু বিষয়বস্তু-সংবলিত শব্দ এবং ব্যাকরণিক ক্রিয়া সম্পাদনকারী শব্দ যেমন পার্টিকল, সংযোজক অব্যয়, ক্রিয়া বা বিশেষণের রূপভেদের বিভক্তি ইত্যাদি লেখার জন্য ব্যবহৃত হয়। কাতাকানা অল্প কিছু বিষয়বস্তু-সংবলিত শব্দ লেখার জন্য, চীনা ভাষা বাদে বাকী সব বিদেশী ভাষার থেকে ঋণ করা শব্দ লেখার জন্য, এবং ধ্বন্যাত্মক শব্দগুলি লেখার জন্য ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও অন্য ভাষায় জোর দেবার জন্য বা অন্য কারণে ইটালিক্স বা বাঁকা হরফে লেখার যে পদ্ধতি আছে, জাপানি ভাষাতে সেটি করার জন্য কাতাকানা লিপি ব্যবহার করা হয়। রোমাজি লিপির ব্যবহার বেশ সীমাবদ্ধ। এগুলি সাধারণত কাঞ্জি লিপির সাথে মিলে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত স্থানে বিভিন্ন সাইনে ব্যবহৃত হয়, মূলত পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণের উদ্দেশ্যে।
জাপানি ভাষার চার রকমের লিপি ব্যবহৃত হলেও এদের মধ্যে তিনটি, যথা কানজি, কাতাকানা ও হিরাগানা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয়।
ইতিহাস
সম্পাদনাআদিতে জাপানি ভাষার কোনও লিখন পদ্ধতি ছিল না। ৫ম শতাব্দীতে চীনা ভাষা থেকে চিত্রভিত্তিক কাঞ্জি বর্ণগুলি ধার করা হয়।
চীনা চিত্রলিপিগুলির ইতিহাস অনেক পুরনো। এগুলি ৩০০০ থেকে ৫০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে প্রচলিত। এগুলি প্রথমে চীনা ভাষা লিখতে ব্যবহৃত হত। পরবর্তীতে এগুলি পার্শ্ববর্তী জাপান, কোরিয়া ও ভিয়েতনামে ছড়িয়ে পড়ে। এই লিপি চীনে 漢字 হান্ ৎস্যি (অর্থাৎ হান লিপি) এবং জাপানে কান্ জি নামে পরিচিত। ৫ম শতকে এসে জাপানে প্রায় সর্বত্র কাঞ্জি লিপি ব্যবহৃত হতে থাকে, যদিও তার আগেও এই লিপির ব্যবহারের নিদর্শন পাওয়া গেছে। এই আদি পর্যায়ে যারা কাঞ্জিতে লিখত, তারা ছিল মূলত চীন ও কোরিয়া থেকে আগত অভিবাসী। এরা জাপানি রাজদরবারে অনুলেখকের কাজ করত। কিছু কিছু অভিজাত জাপানি এই অনুলেখকদের কাছ থেকে লিখতে ও পড়তে শিখে নেন। তবে ৬ষ্ঠ শতকের মধ্যভাগে যখন চীন থেকে জাপানে বৌদ্ধধর্মের প্রসার ঘটে, তখনই সাধারণ জাপানি জনগণ কাঞ্জি পড়তে ও লিখতে বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠে।
কাঞ্জির প্রচলনের কয়েক শত বছর পরে জাপানিরা তাদের নিজস্ব সাহিত্য রচনা শুরু করে। এগুলির মধ্যে ছিল ৭১২ সালের ইতিহাসগ্রন্থ "পূর্বকালিক বিষয়ের নথিপত্র" (古事記 কোজিকি), ৭২০ সালের ইতিহাসগ্রন্থ "জাপানের ইতিকথা" (日本書紀 নিহোং শোকি), ৭৫৯ সালের কাব্যগ্রন্থ "দশ হাজার পত্র" (万葉集 মাং য়োওশুউ), ইত্যাদি। এই গ্রন্থগুলি সম্পূর্ণ কাঞ্জিতে লেখা, তখনও কানা লিপিগুলির উদ্ভব হয় নি।
জাপানে যখন কাঞ্জি ব্যবহার করা শুরু হয়, তখন প্রতিটি কাঞ্জি বর্ণের জন্য এর চীনা উচ্চারণও ধার করা হয়। এই কারণে সমসাময়িক কাঞ্জি দুইভাবে পাঠ করা সম্ভব। এগুলিকে বলে ওন-পাঠ (音 ওং) এবং কুন-পাঠ (訓 কুং)। ওন-পাঠে জাপানি ধ্বনিব্যবস্থার মধ্যে থেকে আদি চীনা উচ্চারণের সাথে যথাসম্ভব সাদৃশ্য রক্ষার চেষ্টা করা হয়। অন্যদিকে, কুন-পাঠে কাঞ্জিগুলি জাপানি নিজস্ব রীতিতে উচ্চারণ করা হয়। ওন-পাঠগুলি আবার তিন রকম হতে পারে। কাঞ্জিগুলি চীন থেকে জাপানে চীনের ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে আমদানি হয়, এবং এগুলির ওন-পাঠ তাই তিন রকম। এগুলি হল গো-ওন (呉音 গো ওং), কান-ওন (漢音 কাং ওং), এবং তো/সো-ওন (唐/宋音 তোও/সোও-ওং)।
কাঞ্জি চীনা লিপির গো-ওন পাঠপদ্ধতি সবচেয়ে প্রাচীন। চীন ও কোরিয়া থেকে যে প্রথম প্রজন্মের অধিবাসীরা জাপানে অভিবাসী হয়েছিল, তারা এই গো (চীনা ভাষাতে উ) উচ্চারণে কথা বলত। তারা মূলত দক্ষিণ চীনের নিম্ন ইয়াংসে নদীর অববাহিকা থেকে এসেছিল। চীনের ইতিহাসের ছয় রাজবংশ পর্বে, ২২২-৫৮৯ খ্রিস্টাব্দ সময়কালে, এই উচ্চারণ প্রচলিত ছিল।
এরপর ৭ম থেকে ৯ম শতক পর্যন্ত জাপানি সন্ন্যাসী ও পণ্ডিতেরা চীন সফরে যান এবং সেখান থেকে কাঞ্জি লিপিগুলির কান-ওন পাঠপদ্ধতি জাপানে নিয়ে আসেন। তারা যখন চীনে গিয়েছিলেন, তখন চীনে চলছিল থাং রাজবংশের রাজত্ব (৬১৮-৯০৭ খ্রিস্টাব্দ)। তাং রাজবংশের রাজধানী চাংগানে যে উচ্চারণে কথা বলা হত, সেগুলিই জাপানি কাঞ্জি লিপির কান-ওন পাঠপদ্ধতির ভিত্তি। কান-ওন প্রচলনের প্রায় সাথে সাথেই জাপানি রাজদরবার এগুলিকে জাপানে কাঞ্জির সরকারি উচ্চারণ পদ্ধতি হিসেবে ঘোষণা দেয়। এর বহু পরে ১৪শ শতকে তৌ/সৌ-ওন পাঠপদ্ধতির প্রচলন ঘটে, এই উচ্চারণগুলি মূলত সাংহাইয়ের আশেপাশের এলাকায় প্রচলিত ছিল। তবে জাপানি কাঞ্জি লিপিতে তৌ/সৌ-ওন পাঠপদ্ধতির ব্যবহার খুব অল্প কিছু শব্দে (বিশেষত জেন পরিভাষাগুলিতে) সীমাবদ্ধ।
এই ঐতিহাসিক কারণগুলির জন্য জাপানি ভাষার প্রতিটি কাঞ্জি লিপি একাধিক ওন পাঠপদ্ধতিতে উচ্চারণ করা সম্ভব। জাপানে এই কাঞ্জি লিপিগুলিই ছিল লিখিত ভাবপ্রকাশের প্রধান বাহন, কেননা এগুলি জাপানি সভ্যতা থেকে সে সময়ে অনেক উন্নত চীনা সভ্যতা থেকে আমদানি করা হয়েছিল। চীনা লিপিভিত্তিক এই কাঞ্জিগুলিকে জাপানে তাই বলা হত মানা (真名), অর্থাৎ আসল লিপি। কাঞ্জিগুলির পাশাপাশি হেই পর্বে (৭৯৪-১১৮৫) জাপানে দুইটি সিলেবলভিত্তিক বর্ণমালার আবির্ভাব ঘটে। এই বর্ণমালাগুলিকে অপ্রধান লিখন পদ্ধতি হিসেবে গণ্য করা হত, তাই এদের নাম দেওয়া হয় কানা (仮名), অর্থাৎ অস্থায়ী লিপি। কাঞ্জি ও কানা লিপির এই মর্যাদাভিত্তিক পার্থক্য আজও বজায় আছে।