জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর

শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনে স্থাপিত জাদুঘর

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর বা সংক্ষেপে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর ঢাকা শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত একটি বিশেষ জাদুঘর যা বাঙালি জাতির অন্যতম নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতি সংরক্ষণার্থে স্থাপন করা হয়েছে।[] ২০২৪ সালে সংঘটিত ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থান পরবর্তী সহিংসতায় এটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।[]

বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর
মানচিত্র
স্থাপিত১৪ আগস্ট ১৯৯৪; ৩০ বছর আগে (14 August 1994)
অবস্থানবাড়ি ৬৭৭/১০, রোড ৩২/১১, ধানমন্ডি, ঢাকা, বাংলাদেশ
স্থানাঙ্ক২৩°৪৫′০৬″ উত্তর ৯০°২২′৩৬″ পূর্ব / ২৩.৭৫১৭° উত্তর ৯০.৩৭৬৭° পূর্ব / 23.7517; 90.3767
ওয়েবসাইটদাপ্তরিক ওয়েবসাইট

ইতিহাস

সম্পাদনা

ঢাকার ধানমণ্ডি আবাসিক এলাকায় ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে শেখ মুজিব স্বাধীনতাপূর্ব কাল থেকেই বসবাস করতেন। ১৯৫৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মন্ত্রী থাকাকালীন তার একান্ত সচিব নূরুজ্জামান বেগম মুজিবের অনুরোধে ধানমন্ডি এলাকার জমির জন্য গণপূর্ত বিভাগে আবেদনপত্র জমা দেন। ১৯৫৭ সালে ছয় হাজার টাকায় ধানমন্ডিতে এক বিঘা জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়। পরে প্রথমে এখানে দুই কক্ষবিশিষ্ট একতলা বাড়ি ও পরে দোতলা করা হয়। ১৯৬১ সালের ১ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পরিবার-পরিজন নিয়ে নির্মাণাধীন এই বাড়িতে ওঠেন। তখন একতলা বাড়িটিতে মাত্র দু’টি শয়নকক্ষ ছিল, যার একটি কক্ষে বঙ্গবন্ধু দম্পতি থাকতেন। ১৯৬৬ সালে দ্বিতীয় তলার নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত নিচতলার এই কক্ষেই বঙ্গবন্ধু দম্পতি থাকতেন। দ্বিতীয় তলায় বসবাস শুরু হলে এই কক্ষটি তিনি গ্রন্থাগার হিসেবে ব্যবহার করতেন। উত্তর পাশের লাগোয়া কক্ষে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা থাকতেন। এই কক্ষেরই একপাশে থাকতেন শেখ কামাল ও শেখ জামাল। বাড়িতে ঢুকতেই ছিল ছোট একটি কক্ষ, যা ড্রয়িং রুম হিসেবে ব্যবহৃত হতো। শেখ মুজিবুর রহমান এই বাড়ি থেকে ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাক্-কালীন সময়ে জনতার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য ও জরুরি সিদ্ধান্ত দিতেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর এই বাড়ি থেকে যে দিক-নির্দেশনা দেওয়া হতো সেই মোতাবেক দেশ পরিচালিত হতো।[]

তিনি যখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি তখন এই ভবনেই ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫ সামরিক বাহিনীর একদল সশস্ত্র সদস্যের আক্রমণে সপরিবারে নিহত হন। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর বাড়িটি জিয়া সরকার কর্তৃক সিলগালা করে দেওয়া হয়। ১৯৮১ সালে বাড়িটি শেখ হাসিনার পরিবারের নিকট হস্তান্তর করা হয়। পরে বঙ্গবন্ধুর দুই জীবিত উত্তরাধিকারী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ১৯৯৪ সালের ১১ই এপ্রিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট গঠন করে এই বাড়িটি ট্রাস্টের হাতে অর্পণ করেন। ১৯৯৪ সালের ১৪ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের স্মৃতি বিজড়িত কিছু সামগ্রীর সংগ্রহ নিয়ে এ বাড়িতেই "জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর" নামে একটি জাদুঘর স্থাপন করা হয়। এই ট্রাস্টের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর এই বাড়িটি ও টুঙ্গিপাড়ার বাড়িটি দেখাশোনার পাশাপাশি বর্তমানে এর অধীনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর ছাড়াও শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিব মেমোরিয়াল কেপিজে বিশেষায়িত হাসপাতাল এন্ড নার্সিং কলেজটিও পরিচালিত হচ্ছে।[][]

হামলা ও ক্ষয়ক্ষতি

সম্পাদনা

১৯৭১ সালে হামলা ও দখল

সম্পাদনা

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার পর রাত ১টা ৩০ মিনিট তথা ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে প্রথমে ঢাকা সেনানিবাস ও পরে পাকিস্তানের পাঞ্জাবের মিওয়ানওয়ালি কারাগারে আটক রাখা হয়। মুজিব পরিবারকে ধানমন্ডির ১৮ নম্বর সড়কের ২৬ নম্বর বাড়িতে গৃহবন্দি করে রাখা হয়। বাংলাদেশ বিজয় লাভ করার আগ পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাড়িটি দখল করে রাখে। পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর গুলির আঘাতে ভবনটি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ১৯৭২ সালে শেখ মুজিবুর রহমান স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর বাড়ির মেরামত কাজ শেষ হলে ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে তিনি এই বাড়িতে পরিবার নিয়ে বসবাস করতে থাকেন।[]

১৯৭৫ সালে হত্যাকান্ড ও লুট

সম্পাদনা

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর বাড়িটি লুট করা হয়।[] হত্যা মামলায় ২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল ১২ জন সামরিক কর্মকর্তার মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়।[]

১৯৮৯ সালে হামলা

সম্পাদনা

১৯৮৯ সালের ১০ আগস্ট রাতে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে অবস্থান কালে শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ১৫/২০ জনের একদল অস্ত্রধারী ভবনটি লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ ও গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। এসময় নিরাপত্তারক্ষীরা পাল্টা গুলি চালায় এবং আওয়ামী লীগের উপস্থিত নেতাকর্মীরা ধাওয়া করলে অস্ত্রধারীরা বাংলাদেশ ফ্রিডম পার্টির পক্ষে স্লোগান দিয়ে গুলি ছুড়তে ছুড়তে ধানমন্ডি ২৬ নম্বরের দিকে পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় ধানমন্ডি থানায় দুটি পৃথক মামলা দায়ের করা হয়। ২০১৭ সালের ২৯ অক্টোবর মামলার ঘোষিত রায়ে ফ্রিডম পার্টির ১১ জনের সাজা হয়।[]

২০২৪ সালে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুট

সম্পাদনা

২০২৪ সালের আগস্ট মাসে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালীন ৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পর বিক্ষোভকারীদের একটি অংশ জাদুঘরটিতে অগ্নিসংযোগ করে ও লুটপাট চালায়। এতে জাদুঘরে সংরক্ষিত প্রায় সকল নিদর্শনের পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দলিল-নথিপত্র ধ্বংস হয়।[] এছাড়াও জাদুঘরের পাশাপাশি পার্শ্ববর্তী কয়েকটি স্থাপনায়ও হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।[] পরবর্তীতে পুড়ে যাওয়া স্থাপনা থেকে অজ্ঞাত ৪ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।[১০] পরের দিন ভবনটি দেখতে উৎসুক জনতা ঘটনাস্থলে ভীড় করেন এবং জাদুঘরে হামলার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। দেয়ালে প্রতিবাদী গ্রাফিতি আঁকা হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনীর সাথে ছাত্ররাও যোগদান করে। তারা ঘটনাস্থল থেকে লুটপাট ঠেকানোর চেষ্টার পাশাপাশি ধ্বংসস্তূপ পরিচ্ছন্নতার কাজে অংশ নেয়। ভবনের পাঠাগার থেকে উদ্ধারকৃত বই সমূহ কেন্দ্রীয় পাঠাগারে স্থানান্তর করা হয় এবং সেনাবাহিনী ভবনটি নিয়ন্ত্রণে নেয়।[][১১]

 
ধ্বংসপ্রাপ্ত স্মৃতিস্তম্ভে ছাত্রদের আঁকা গ্রাফিতি

ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান আবদুল কাদের সিদ্দিকী বলেন,

"আজকে ৩২ এর বাড়ি যেভাবে জ্বলতে, পুড়তে, ধ্বংস হতে দেখলাম, তার আগে আমার মৃত্যু হলে অনেক ভালো হত।... আজকের এই ধ্বংস ভবিষ্যত ইতিহাসে বাঙালি জাতির জন্যে একটা কলঙ্কের হয়ে থাকবে।"[১২]

২০২৪ সালের ১৫ আগস্ট, শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীতে কিছু মানুষ শ্রদ্ধা জানাতে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করার চেষ্টা করলে লাঠিসোঁটা হাতে একদল লোক তাদের বাধা দেয় ও আক্রমণ করে।[১৩] এতে একজন নিহত ও শতাধিক আহত হন।[১৪][১৫] এসময় অভিনেত্রী রোকেয়া প্রাচীও হামলার শিকার হন এবং কাদের সিদ্দিকীর গাড়ি ভাংচুর করা হয়।[১৬][১৭] হামলাকারীরা স্থানটিতে প্রবেশের পথ অবরুদ্ধ করে রাখে এবং সাংবাদিকদের ছবি তুলতে বাধা প্রদান করে।[১৮]

চিত্রশালা

সম্পাদনা

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকায় ১৪ আগস্ট ২০১০ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদন[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  2. "ধানমন্ডি ৩২ এখন ধ্বংসস্তূপ"বাংলা ট্রিবিউন। ৬ আগস্ট ২০২৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৬ আগস্ট ২০২৪ 
  3. Hasan, Mahbub (১৫ আগস্ট ২০২০)। ধানমন্ডি-৩২ এর সেই বাড়িটি যেভাবে হয়ে উঠলো 'বঙ্গবন্ধু জাদুঘর' [How that house in Dhanmondi-32 became 'Bangabandhu Museum']। Bangla Tribune। ১৪ আগস্ট ২০২২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৪ আগস্ট ২০২২ 
  4. "অফিসিয়াল ওয়েবসাইট"। ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ 
  5. "বঙ্গবন্ধু ভবন যেন বাংলাদেশের হৃদয়"Newsbangla24। ২০২১-০৯-০৮। ২০২৩-১১-০৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-১১-০৮ 
  6. "প্রত্যক্ষদর্শীদের জবানবন্দি"দৈনিক প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৮-১৫ 
  7. "News Details" (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৭-০৩-১৫ [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  8. "'৮৯ সালের ১০ আগস্ট গ্রেনেড গুলিতে কেঁপে ওঠে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর"Cumillar Dhoni। ২০২১-০২-১৮। 
  9. "Bangabandhu museum on Dhanmondi 32: Torching an integral part of country's history"দ্য ডেইলি স্টার। ২০২৪-০৮-০৭। 
  10. "ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের সামনে ৪ লাশ"বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। সংগ্রহের তারিখ ৬ আগস্ট ২০২৪ 
  11. "Students step up to clean streets after Hasina's ouster"Daily Sun। ২০২৪-০৮-০৮। 
  12. "Torching Bangabandhu Museum will be a 'dark chapter' in Bengali history, says Kader Siddique"বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। ২০২৪-০৮-০৭। 
  13. "ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর প্রাঙ্গণে যেতে বাধা, মারধর"বণিক বার্তা। সংগ্রহের তারিখ ১৬ আগস্ট ২০২৪ 
  14. "১৫ আগস্ট ৩২ নম্বরে গিয়ে হামলায় আহত আওয়ামী লীগ নেতার মৃত্যু"দৈনিক প্রথম আলো। ২০২৪-০৮-৩০। 
  15. "Dhanmondi 32: More than 100 hospitalised after beatings, 30 taken away by security forces"বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। ২০২৪-০৮-১৫। 
  16. "Crowd paying homage to Bangabandhu at Dhanmondi 32 assaulted with sticks"Crowd paying homage at Dhanmondi 32 attacked (ইংরেজি ভাষায়)। ২০২৪-০৮-১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৮-১৯ 
  17. Mojid, Muhammad Ibrahim (১৬ আগস্ট ২০২৪)। "Vandalism, media harassment and citizens' humiliation"ঢাকা ট্রিবিউন। সংগ্রহের তারিখ ১৯ আগস্ট ২০২৪ 
  18. "ধানমন্ডি ৩২: হ্যান্ড মাইকে ঘোষণা 'ছবি তোলা যাবে না ভিডিও করা যাবে না'"দ্য ডেইলি স্টার। ১৫ আগস্ট ২০২৪। ১৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৬ আগস্ট ২০২৪ 

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা