জয়শ্রী স্বাধীনতা সংগ্রামী দেশনেত্রী লীলা নাগ (পরবর্তীতে বিবাহের পর লীলা রায়) প্রতিষ্ঠিত-সম্পাদিত বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক মাসিক পত্রিকা।[১] বর্তমানে পত্রিকাটি কলকাতার 'জয়শ্রী প্রকাশন' হতে প্রকাশিত হয়।[২]

প্রেক্ষাপট সম্পাদনা

পুরুষ-নারীর বৈষম্য দূর করতে, মহিলাদের কল্যাণে লীলা নাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরাজী সাহিত্যে এমএ পাশের পরই ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে গঠন করেন দীপালী সংঘ। সংঘের উদ্যোগে মেয়েদের জন্য যেমন কতকগুলি উচ্চ ও প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপিত হয়, তেমনি মহিলাদের একটি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ঢাকা শহরের কতিপয় শিক্ষিত মহিলা লীলা নাগের নেতৃত্বে। সাহিত্য-চর্চা ছাড়াও নারী আন্দোলনের মুখপত্র হিসাবে মহিলাদের মধ্যে "দেশাত্মবোধ ও শঙ্কাহীন দেশসেবার ভার জাগ্রত করা" ছিল অন্যতম উদ্দেশ্য। পত্রিকাটির নামকরণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং প্রথম সংখ্যাটির প্রচ্ছদ এঁকে দেন নন্দলাল বসু। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে ঢাকা শহরে পত্রিকাটি আত্মপ্রকাশ করে। কবিগুরু পত্রিকাটির জন্য আশীর্বাণী পাঠিয়েছিলেন:[৩]

বিজয়িনী নাই তব ভয়,
দুঃখে ও বাধায় তব জয়।
অন্যায়ের অপমান,
সম্মান করিবে দান,
জয়শ্রীর এই পরিচয়।।

ইতিহাস সম্পাদনা

অবিভক্ত বাংলার শ্রেষ্ঠ লেখকেরা সকলেই পত্রিকাটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।[১] পত্রিকাটিতে যেমন বীণা ভৌমিক, কল্পনা দাশগুপ্ত, শান্তিসুধা ঘোষ, হেমচন্দ্র ঘোষ, ভূপেন্দ্রকিশোর রক্ষিত রায়, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, নলিনীকান্ত গুপ্ত প্রমুখ বহু স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আত্মকথন বা স্মৃতি কাহিনী প্রকাশিত হয়েছে, তেমনি বাংলার প্রখ্যাত কবি ও সাহিত্যিক জীবনানন্দ দাশ , সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, বিনয় সরকার, প্রেমেন্দ্র মিত্র, রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতো অন্যান্যদের রচনাও স্থান পেয়েছে। কবিগুরুর বেশ কয়েকটি গান ও কবিতা পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে। সঙ্কোচের বিহ্বলতায় - গানটি দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বরলিপিসহ ছাপা হয়েছিল। বিভিন্ন সময়ে যুগান্তরবন্দেমাতরম যেমন ব্রিটিশ শাসকের রোষের কারণ হয়ে উঠেছিল, ঠিক তেমনই ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধতার জন্য একাধিক বার জয়শ্রী পত্রিকা রাজরোষে পড়েছিল। শেষপর্যন্ত ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের সরকারি নিষেধাজ্ঞায় ঢাকা শহর হতে এটির প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে পত্রিকাটির পুনরায় প্রকাশনা শুরু হয় কলকাতা শহরে।[৪] নতুন উদ্যমে দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রকাশনাকে উপলক্ষ করে সুভাষচন্দ্র বসু ৩০ মে লেখেন -

জয়শ্রী'র পুনরাবির্ভাবে আমি পরম সমাদরে সম্বর্ধনা করিতেছি। গত কয়েক বৎসর সমস্ত দেশের উপর দিয়া যে ঝড় বহিয়া গিয়াছে, "জয়শ্রী"র প্রতিষ্ঠাত্রীমণ্ডলও তাহা হইতে নিস্তার পান নাই। আজ সেই ঝটিকা শেষে দেশ আবার আত্মপ্রতিষ্ঠ হইতে সচেষ্ট। নূতন কালের, নতুন পরিবেশের উপযোগী চিন্তাধারা ও কর্মধারাও সন্ধান করিতেছে। জয়শ্রী দেশের এই পরমক্ষণে সেই আত্ম প্রতিষ্ঠার ও আত্মসন্ধানের সাধনাকে জয়যুক্ত ও শ্রীমণ্ডিত করুক ইহাই আমার নিবেদন।"

পরবর্তীতে জয়শ্রী পত্রিকায় সাহিত্য ইতিহাস ছাড়াও বিজ্ঞান, দর্শন, অর্থনীতি আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি নিয়ে বহু বিষয় যুক্ত হয়েছে। প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক লীলা রায় ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে প্রয়াত হলে, সম্পাদনা ভার নেন তার ঘনিষ্ঠ সহকর্মী বিপ্লবী সুনীল দাস। তিনিও আমৃত্যু পত্রিকার সম্পাদনা করে গেছেন এবং বেশ কয়েকটি অমূল্য সম্পদ রেখেছেন, তন্মধ্যে - জয়শ্রী সূবর্ণ জয়ন্তী সংখ্যাজয়শ্রী হীরকজয়ন্তী সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। [৫] সুনীল দাসের ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুর পর, বর্তমানে ২০০২ খ্রিস্টাব্দ হতে সম্পাদনার দায়িত্বে আছেন বিজয়কুমার নাগ। [৩]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. শিশিরকুমার দাশ (২০১৯)। সংসদ বাংলা সাহিত্যসঙ্গী। সাহিত্য সংসদ, কলকাতা। পৃষ্ঠা ৮৩। আইএসবিএন 978-81-7955-007-9 
  2. "Jayasree Prakashan in College Street, Kolkata 700009(ইংরাজীতে)"। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৩-০৯ 
  3. "'বিজয়িনী নাই তব ভয়' - কলকাতার কড়চা"। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৩-০৮ 
  4. ""লীলা নাগ ও তাঁর জীবনসাধনা" - প্রতিচিন্তা"। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৩-০৯ 
  5. "Revolutionary Sunil Das - Jayasree Patrika (ইংরাজীতে)"। ২০২২-০৩-০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৩-০৭