চুয়াড় বিদ্রোহ

১৭৬৬-১৮৩৪ আদিবাসী বিদ্রোহ

চুয়াড় বিদ্রোহ (১৭৬৬ - ১৮৩৪[১]) হল ব্রিটিশ ভারতের অন্যতম বৃহৎ কৃষক বিদ্রোহ। জঙ্গলমহলের ভূমিজ অধিবাসীরা অর্থাৎ মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, সিংভূম, মানভূম ও ধলভূমের স্থানীয় জমিদারদের অধীনে পাইকের কাজ করতেন।[২] সাম্যর কাজের বিনিময়ে তাদের জমি ভোগ করার অধিকার ছিল যাকে পাইকান জমি বলা হত।

মেদিনীপুরে চুয়ার বিদ্রোহের স্মারক।

চুয়াড় বা চোয়াড়রা ছিল বাংলার মেদিনীপুর জেলার জঙ্গলমহলের ভূমিজ অধিবাসী। চাষবাস ও পশুশিকারের সঙ্গে জড়িত থাকলেও যুদ্ধবিগ্রহ ছিল তাদের প্রধান পেশা। বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই অঞ্চলের জমির ওপর চড়া ভূমিরাজস্ব ধার্য করে ফলত তার বিরুদ্ধে জমিদারদের সাথে তাঁদের পাইক চুয়াড়গণও সমগ্র জঙ্গলমহল জুড়ে বিদ্রোহ করেন। ইংরেজরা আদিম ও অন্ত্যজ জনজাতির এই কৃষকবিদ্রোহকে ঘৃনাভরে চূয়াড় বিদ্রোহ নাম দেয়।[৩]

বিদ্রোহের প্রকৃতি সম্পাদনা

বাংলায় বিভিন্ন পর্যায়ে চুয়াড় বিদ্রোহ ঘটে। এই বিদ্রোহ ১৭৬৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চলে বিভিন্ন নেতার হাত ধরে।[৪] ১৭৬৬ খ্রিস্টাব্দে ঘাটশিলায় ধলভূমের ভূমিজ রাজা জগন্নাথ সিংহ প্রথম চুয়াড় বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। চুয়াড়রা এই বিদ্রোহে সক্রিয় ভাবে অংশ নেয়। ১৭৭১ সালে ধাদকার শ্যামগঞ্জনের নেতৃত্বে চুয়াড়রা বিদ্রোহ ঘোষণা করে ও ব্যর্থ হয়। ১৭৯৮-৯৯ খ্রিস্টাব্দে আবার দুর্জন সিংহ নিজেকে স্বাধীন তালুকদার ঘোষণা করেন ও কোম্পানির খাজনা দিতে অস্বীকার করেন ফলত তাকে গ্রেপ্তার করার নির্দেশ দেয় সরকার। ১৭৯৮ সালের মার্চ মাসে রাইপুর পরগনায় শুরু হয় চুয়াড় বিদ্রোহ। ক্রমে তা অম্বিকানগর, সুপুর, বাঁকুড়ার দক্ষিণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। তার নেতৃত্বে এই বিদ্রোহ সবচেয়ে ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল, কিন্তু কোম্পানির সেনাদল নির্মম অত্যাচার করে এই বিদ্রোহ দমন করেছিল। নৃসংশভাবে বিদ্রোহীদের হত্যা করে তারা। গাছের ডালে তাদের ফাঁসি দিয়ে মৃতদেহ ঝুলিয়ে রেখে ত্রাস সৃষ্টি করে গ্রামের সাধারণ মানুষদের মধ্যে।[৫][৬] রাণী শিরোমণির আমলেও চুয়াড় বিদ্রোহ ঘটে এবং নাড়াজোলের রাজা ত্ৰিলোচন খানের দ্বারা চুয়াড়রা পরাজিত হয়। দ্বিতীয় চুয়াড় বিদ্রোহের সময় ইংরেজ সরকার রাণী শিরোমণিকে ওই বিদ্রোহের নেতা ভেবে ১৭৯৯ খ্রীস্টাব্দে বন্দী করে। ১৭৯৮-১৮১০ সালে জগন্নাথ সিংয়ের পুত্র বৈজনাথ সিং এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন। ১৮১০ সালে বৈজনাথ সিংয়ের প্রবল বিদ্রোহ দমন করার জন্য ব্রিটিশ সেনাবাহিনীকে ডাকা হয়।[৭] পরে, জগন্নাথ সিংহের নাতি রঘুনাথ সিং ১৮৩৩ সাল পর্যন্ত বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন।[৮]

১৮৩২-৩৪ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে গঙ্গা নারায়ণ সিংয়ের নেতৃত্বে ভূমিজ বিদ্রোহও চুয়ার বিদ্রোহের অংশ হিসাবে বিবেচিত হয়। বৃটিশরা একে 'গঙ্গা নারাইনের হাঙ্গামা' নামে অভিহিত করেছিল, আবার অনেক ঐতিহাসিক একে চুয়ার বিদ্রোহ বলে লিখেছিলেন।[৯][১০]

নেতৃবৃন্দ সম্পাদনা

রাজা জগন্নাথ সিং, দুর্জন সিংহ, রানী শিরোমনি, সুবল সিং, শ্যাম গঞ্জাম সিং, বৈদ্যনাথ সিং, রঘুনাথ সিং[১১] প্রমুখেরা বিভিন্ন সময় এই কৃষক বিদ্রোহের নেতৃত্ব প্রদান করেন। ১৭৯৮-৯৯ খ্রিস্টাব্দে দুর্জন সিংহের নেতৃত্বে চুয়াড় বিদ্রোহ সবচেয়ে ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল, কিন্তু কোম্পানির সেনাদল নির্মম অত্যাচার করে এই বিদ্রোহ দমন করে।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Indian Book Chronicle (ইংরেজি ভাষায়)। Vivek Trust। ১৯৯৭। 
  2. Bhattacherje, S. B. (২০০৯-০৫-০১)। Encyclopaedia of Indian Events & Dates (ইংরেজি ভাষায়)। Sterling Publishers Pvt. Ltd। আইএসবিএন 978-81-207-4074-7 
  3. "ঘটনা প্রবাহ ১৭৫৭-১৯৪৭"। ১৭ মে ২০১৪। ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭ 
  4. Bhattacherje, S. B. (২০০৯-০৫-০১)। Encyclopaedia of Indian Events & Dates (ইংরেজি ভাষায়)। Sterling Publishers Pvt. Ltd। আইএসবিএন 978-81-207-4074-7 
  5. "ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে রাইপুর"। আনন্দবাজার পত্রিকা। ২১ জানুয়ারি ২০১৫। সংগ্রহের তারিখ ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭ 
  6. প্রথম খন্ড, সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত (২০০২)। সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান। কলকাতা: সাহিত্য সংসদ। পৃষ্ঠা ২১৩। 
  7. India's Struggle for Freedom: Role of Associated Movements (ইংরেজি ভাষায়)। Agam Prakashan। ১৯৮৫। 
  8. Society, Bihar Research (১৯৬০)। The Journal of the Bihar Research Society (ইংরেজি ভাষায়)। 
  9. Indian Book Chronicle (ইংরেজি ভাষায়)। Vivek Trust। ১৯৯৭। 
  10. Basu, Sajal (১৯৯৪)। Jharkhand Movement: Ethnicity and Culture of Silence (ইংরেজি ভাষায়)। Indian Institute of Advanced Study। আইএসবিএন 978-81-85952-15-4 
  11. Jha, Jagdish Chandra (১৯৬৭)। The Bhumij Revolt, 1832-33: Ganga Narain's Hangama Or Turmoil (ইংরেজি ভাষায়)। Munshiram Manoharlal।