চীন-নেপাল যুদ্ধ

চীন ও নেপাল যুদ্ধ

চীন-নেপাল যুদ্ধ (চীনা: 平定廓爾喀, নেপালি: चीन-नेपाल युध्द) বলতে ১৭৮৮ থেকে ১৭৯২ খ্রিষ্টাব্দে সংগঠিত নেপাল দ্বারা তিব্বতে আক্রমণ অভিযান বোঝানো হয়ে থাকে। নেপাল ও তিব্বতী সেনার মধ্যে এই যুদ্ধ মূলতঃ তিব্বতে পাঠানো নেপালে্র নিম্নমানের ধাতুনির্মিত মুদ্রা থেকে বাণিজতিক বিবাদ থেকে শুরু হয়। প্রথমদিকে নেপালীদের সাফল্য লাভ হলেও চিং রাজবংশ আসরে নামলে নেপালীরা তাদের অধিকৃত জমি থেকে বিতাড়িত হয় এবং একটি শান্তি চুক্তি স্থাপন করতে বাধ্য হয়।

প্রথম আক্রমণ
তারিখ১৭৮৯ - ১৭৯১
অবস্থান
ফলাফল তিব্বতীদের ক্ষতিপূরণ প্রদান ও গোর্খা সৈন্যদের প্রত্যাবর্তন
বিবাদমান পক্ষ
চিং রাজবংশচিং সাম্রাজ্য নেপাল রাজ্য
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী
চিং রাজবংশ চিয়ানলোং বাহাদুর শাহ
শক্তি
১০,০০০ ১০,০০০
হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি
অজানা অজানা
দ্বিতীয় আক্রমণ
তারিখ১৭৯২ - ১৭৯৩
অবস্থান
ফলাফল চিং সাম্রাজ্যের বিজয়, নেপালের পরাজয় ও ক্ষতিপূরণ প্রদান, বেত্রবতী চুক্তি
বিবাদমান পক্ষ
চিং রাজবংশচিং সাম্রাজ্য নেপাল রাজ্য
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী
চিং রাজবংশ চিয়ানলোং
চিং রাজবংশ ফুক'আংগান
বাহাদুর শাহ
শক্তি
৭০,০০০ ২০,০০০ - ৩০,০০০
হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি
অজানা অজানা

বাণিজ্যিক প্রেক্ষাপট সম্পাদনা

মল্ল রাজাদের আমল থেকে তিব্বতীরা নেপালী রৌপ্য মুদ্রা ব্যবহার করে এসেছেন। নেপালকে একত্রীভূত করার প্রচেষ্টায় গোর্খা রাজ্যের পৃথ্বী নারায়ণ শাহ কাঠমাণ্ডু উপত্যকার ওপর অর্থনৈতিক বাঁধা আরোপ করলে জয় প্রকাশ মল্ল অর্থনৈতিক সঙ্কটের সম্মুখীন হয়ে নিম্নমানের তাম্রমুদ্রার প্রচলন শুরু করেন। ১৭৬৯ খ্রিষ্টাব্দে পৃথ্বী নারায়ণ শাহ কাঠমাণ্ডু উপত্যকা অধিকার করে শাহ রাজবংশের শাসন শুরু করে পুনরায় রৌপ্য মুদ্রার প্রচলন করেন। তিব্বতে চালু সমস্ত পুরাতন নেপালী তাম্রমুদ্রার বদলে নূতন রৌপ্য মুদ্রা বদলে নেওয়ার দাবী তিব্বতীরা নেপাল সরকারের কাছে জানান। পৃথ্বী নারায়ণ শাহ নবপ্রতিষ্ঠ রাজ্যের ওপর এই ধরনের ভারী আর্থিক দায়ভার চাপাতে রাজী ছিলেন না। এরফলে বাজারে দুই ধরনের মুদ্রা চালু থাকে। পৃথ্বী নারায়ণ শাহের মৃত্যুর পর নেপালী বণিকদের সঙ্গে তিব্বতীদের বিবাদ শুরু হয়। নেপালীদের সঙ্গে তিব্বতীদ্রের নিম্নমানের লবণ সরবরাহ নিয়েও বিবাদ বাধে। তিব্বতীদের পাঠানো নিম্নমানের লবণের প্রতিবাদের নেপালী প্রতিনিধিরা দরবার করলেও তিব্বতীরা তা অগ্রাহ্য করে।

প্রথম আক্রমণ সম্পাদনা

১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দে বাহাদুর শাহ তিব্বত আক্রমণ করার জন্য দামোদর পাণ্ডে এবং বম সিংহের নেতৃত্বে গোর্খা সেনাবাহিনী পাঠান। এই সৈন্যবাহিনী কুতি হয়ে ৪১০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে ব্ক্রা-শিস-ল্হুন-পো পৌছয়। শিকারজোং নামক স্থানে একটি ভয়ঙ্কর যুদ্ধ ঘটে যাতে তিব্বতীরা সাংঘাতিকভাবে পরাজিত হয়। সপ্তম পাঞ্চেন লামা শান্তির জন্য মধ্যস্থতা করলে গোর্খা বাহিনী শিকারজোং ছেড়ে কুতি ও গ্যিরোং চলে যায়। চিং সম্রাট চিয়ানলোং নেপালের আক্রমণের সংবাদ পেলে তিনি সেনাপতি চাঞ্চুর নেতৃত্বে একটি বিশাল চীনা সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন। ১৭৯০ খ্রিষ্টাব্দে খিরু নামক স্থানে তিব্বতী ও নেপালী প্রতিনিধিরা শান্তির জন্য বৈঠক করতে সম্মত হয়। এই বিবাদের সূত্রপাতের জন্য তিব্বতীদের দায়ী করা হয় এবং যুদ্ধের জন্য নেপালকে ক্ষতিপূরণ দিতে বলা হয়। এই যুদ্ধে সকল অধিকৃত এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার পরিবর্তে নেপালীরা প্রতিবছর ৫০,০০১ টাকা দিতে বাধ্য থাকে। প্রথম বছর নেপালীদের এই অর্থ প্রদান করা হলে নেপালীরা অধিকৃত এলাকা ফিরিয়ে দিয়ে প্রত্যাবর্তন করে। কিন্তু পরের বছর থেকে তিব্বতীরা অর্থ প্রদানে অসম্মত হলে লড়াইয়ের সম্ভাবনা বজায় থাকে।

দ্বিতীয় আক্রমণ সম্পাদনা

 
১৭৯২ সালে গুর্খা অভিযানের একটি দৃশ্য (নেপাল)

তিব্বতীরা অর্থপ্রদানে অসম্মত হলে বাহাদুর শাহ ১৭৯১ খ্রিষ্টাব্দে দামোদর পাণ্ডের অধীনে একটি সেনাবাহিনী কুতির দিকে এবং অভিমান সিং বস্নেতের অধীনে অপর একটি সেনাবাহিনী কেরুংয়ের দিকে প্রেরণ করেন। দামোদর পাণ্ডে দিগর্চে আক্রমণ করে স্থানীয় বৌদ্ধবিহারের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে নেন। এই সংবাদ পেয়ে চিং সম্রাট চিয়ানলোং তিব্বত প্রতিরক্ষার উদ্দেশ্যে ফুক'আংগানের নেতৃত্বে ৭০,০০০ সৈন্যের একটি বাহিনীকে প্রেরণ করেন। ফলে নেপালের সঙ্গে তিব্বতের যুদ্ধ নেপালের সঙ্গে চিং রাজবংশের যুদ্ধে পরিণত হয়ে যায়। বৌদ্ধবিহারের লুঠ করা সম্পত্তি ফেরত এবং নেপালে আশ্রিত মি-ফাম-ছোস-গ্রুব-র্গ্যা-ম্ত্শোকে প্রত্যার্পণ - এই মর্মে চিং সাম্রাজ্যের পক্ষ থেকে দাবী জানানো হয়, যা নেপালীরা সম্পূর্ণ রূপে অগ্রাহ্য করে। এর উত্তরে চিং সেনাবাহিনী ত্রিশূলী নদীর তীর বরাবর যাত্রা করে নুওয়াকোটে পৌছলে নেপালীদের সঙ্গে তাদের যুদ্ধ বাধে। দুই পক্ষে প্রচুর পরিমাণে ক্ষয়ক্ষতি হলেও চিং সেনাবাহিনী নেপালীদের রাজধানী পর্যন্ত পিছু হঠিয়ে দিতে সক্ষম হয়। এই সময় নেপাল অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ক্ষেত্রে বেশ কিছু শত্রুদের সম্মুখীন থাকায় বাহাদুর শাহ চীনাদের বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিকট হতে অস্ত্র সাহায্য প্রার্থনা করেন। কোম্পানির পক্ষ থেকে ক্যাপ্টেন উইলিয়াম কার্কপ্যাট্রিক কাঠমাণ্ডু পৌছন[১] কিন্তু তিনি অস্ত্রের সরবরাহের পরিবর্তে বাণিজ্য চুক্তিতে আগ্রহী থাকায় অস্ত্রলাভ না করে বাহাদুর শাহের পরিস্থিতি সঙ্গীন হয়ে ওঠে। বেশ কয়েকটি জয়লাভের পর চিং সেনাবাহিনী বর্ষাপ্লাবিত বেত্রবতী পেরনোর সময় ১৭৯২ খ্রিষ্টাব্দের ১৯শে সেপ্টেম্বর ২০০ জন নেপালী সৈন্যের একটি দল তাদের প্রতি-আক্রমণ করে তাদের পরাজিত করে কিন্তু নেপাল থেকে তাদের হঠিয়ে দিতে সক্ষম হয় না। এই পরিস্থিতে নেপাল সরকার চিং রাজবংশের শর্তে চুক্তি স্বাক্ষর করতে সম্মতি প্রদান করে।

ফলশ্রুতি সম্পাদনা

 
১৭৯২ তে গুর্খা অভিযানের বিজয়ী সেনাবাহিনীর জন্য জয়ের আনন্দোৎসব(নেপাল)

১৭৯২ খ্রিষ্টাব্দে বেত্রবতীতে নেপাল ও চিং রাজবংশের মধ্যে যে চুতি সম্পাদিত হয়, তার শর্তগুলি ছিল নিম্নরূপ-

  1. নেপাল ও তিব্বত উভয় রাষ্ট্র চিং সম্রাটের আধিপত্য স্বীকার করে নেবে।
  2. তিব্বত সরকার তিব্বতীদের দ্বারা লুঠ হওয়া নেপালী বণিকদের ক্ষতিপূরণে বাধ্য থাকবে।
  3. নেপালী নাগরিকদের তিব্বত ও চীনের যে কোন অংশে ভ্রমণ, ব্যবসা এবং শিল্প প্রতিষ্ঠার অধিকার থাকবে।
  4. নেপাল ও তিব্বতের মধ্যে কোন বিবাদ উপস্থিত হলে চিং সরকার হস্তক্ষেপ করে মীমাংসা করবে।
  5. চিং সরকার নেপালকে বৈদেশিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রক্ষা করতে সহায়তা করবে।
  6. নেপাল ও তিব্বত উভয় রাষ্ট্রকে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর বিং রাজসভায় নজরানা পাঠানোর জন্য প্রতিনিধি পাঠাতে হবে।
  7. চিং সম্রাট উভয় রাষ্ট্রকে বন্ধুত্বপূর্ণ উপহার প্রেরণ করবে।

এই যুদ্ধের পরে তিব্বত চিং রাজবংশের সম্পূর্ণ অধীনস্থ হলেও নেপাল তার স্বায়ত্তশাসন বজায় রাখতে সক্ষম হয়। তিব্বত অধীনস্থ হওয়ার ফলে মধ্য এশিয়ায় চীনের প্রভাব বিস্তৃত হয়।[২] কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীতে চিং সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়লে এই চুক্তির শর্ত পালনে অসঙ্গতি শুরু হয়। ১৮১৪ থেকে ১৮১৬ খ্রিষ্টাব্দে ইঙ্গ-নেপাল যুদ্ধে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নেপাল আক্রমণ করলে চিং সাম্রাজ্য নেপালকে শর্তানুযায়ী সাহায্য করতে ব্যর্থ হয়। য়াবার, ১৮৫৫ খিষ্টাব্দে নেপাল-তিব্বত যুদ্ধে চীন হস্তক্ষেপ না করে শর্ত লঙ্ঘন করে।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Kirkpatrick, Colonel (১৮১১)। An Account of the Kingdom of Nepaul। London: William Miller। সংগ্রহের তারিখ ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ 
  2. Peter Perdue, China Marches West: The Qing Conquest of Central Eurasia (Cambridge: Belknap Press, 2005).

আরো পড়ুন সম্পাদনা

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা