দৃষ্টিগত প্রত্যক্ষণ

(চাক্ষুষ জ্ঞান থেকে পুনর্নির্দেশিত)

দৃষ্টিগত প্রত্যক্ষণ বলতে কোনও প্রাণীর দেহে সংঘটিত সেই প্রক্রিয়াকে বোঝায়, যার মাধ্যমে পরিবেশের বস্তু দ্বারা নিঃসৃত বা প্রতিফলিত ও প্রাণীটির দৃশ্যমান বর্ণালীর মধ্যে অবস্থিত আলোকরশ্মিসমূহের বিন্যাস প্রাণীটির দর্শনেন্দ্রিয়-সংশ্লিষ্ট অঙ্গ তথা চোখের অক্ষিপটের আলোক-সুবেদী কোষগুলিকে উদ্দীপ্ত করার ফলে সেগুলিতে যে দৃষ্টিগত স্নায়বিক প্রতিক্রিয়াগুলির সৃষ্টি হয়, সেই প্রতিক্রিয়াগুলি দৃষ্টিস্নায়ুর মাধ্যমে মস্তিষ্কের দৃষ্টি-সংশ্লিষ্ট অংশগুলিতে পরিবাহিত হয়ে ও সেখানে যাচাইবাছাই, সুবিন্যস্ত ও প্রক্রিয়াজাত হয়ে ও পুনর্ব্যাখ্যালাভ করে প্রাণীটির মনের ভেতরে পারিপার্শ্বিক পরিবেশ সম্পর্কে এক ধরনের অর্থবহ উপলব্ধি তথা মানসিক উপস্থাপনার সৃষ্টি করে। দৃষ্টিগত প্রত্যক্ষণকে দৃষ্টি, দর্শন, ইত্যাদি নামেও ডাকা হতে পারে। দৃষ্টিগত প্রত্যক্ষণের ফলে প্রাণীর মস্তিষ্কে বা মনে যে উপলব্ধির সৃষ্টি হয় তাকে চাক্ষুষ উপলব্ধি বলে। চাক্ষুষ উপলব্ধির সাহায্যে মানুষ বা প্রাণী তার চারপাশের ভৌত পরিবেশের মধ্য দিয়ে সফলভাবে নড়াচড়া ও চলাচল করতে পারে এবং পরিবেশের বিভিন্ন জীবন্ত ও জড় বস্তুর সাথে কীভাবে আন্তঃক্রিয়া সম্পাদন করতে হবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে।

মানুষের দৃষ্টিগত প্রত্যক্ষণের গতিপথের সরলীকৃত রেখাচিত্র

প্রাণীদেহে যে ক্ষমতাবলে এই দৃষ্টিগত প্রত্যক্ষণ প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়, তাকে ঐ প্রাণীর দর্শনশক্তি বা দৃষ্টিশক্তি বলে। একে দেখার ক্ষমতা, দৃক্‌শক্তি, দর্শনেন্দ্রিয়, ইত্যাদি নামেও ডাকা হতে পারে। দর্শনশক্তির মধ্যে সালোক দর্শনশক্তি (উজ্জ্বল আলোয় বা দিনের আলোয় দেখার ক্ষমতা), নিরালোক দর্শনশক্তি (রাত্রিবেলায় বা অন্ধকারে দেখার ক্ষমতা), ক্ষীণালোক দর্শনশক্তি (যেমন প্রত্যুষ বা গোধূলির আবছা বা মৃদু আলোতে দেখার ক্ষমতা), বর্ণ দর্শনশক্তি (রঙ দেখার ক্ষমতা), ইত্যাদি ক্ষমতাগুলি অন্তর্ভুক্ত।

দৃষ্টিগত প্রত্যক্ষণ একটিমাত্র সরল প্রক্রিয়া নয়, বরং বহুসংখ্যক ভৌত, শারীরতাত্ত্বিক ও মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়ার এক জটিল ও নিয়ত-পরিবর্তনশীল সমন্বয়। প্রাণীর অক্ষিপটে যে প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল আলোকরশ্মির বিন্যাসগুলি আপতিত হয়, সেগুলিকে মস্তিষ্কের ভেতরে যাচাইবাছাই করে, সুবিন্যস্ত করে ও সেগুলিকে অন্যান্য প্রত্যক্ষণজাত তথ্য, পরিস্থিতি, পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের সাথে তুলনা করে সামগ্রিক অর্থবহ ব্যাখ্যাপ্রদানের মাধ্যমে এই প্রক্রিয়াটি সম্পাদিত হয়।[১] মানুষের ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক পটভূমি ও অপর কোনও ব্যক্তির দেয়া নির্দেশনাও দৃষ্টিগত প্রত্যক্ষণে প্রভাব ফেলতে পারে।

দৃষ্টিগত প্রত্যক্ষণ প্রক্রিয়াটি অনেকগুলি ধাপে ঘটে। প্রথম ধাপে পরিবেশ থেকে আলোকরশ্মির আকারে অশোধিত দৃষ্টিগত উপাত্তগুলি চোখ দ্বারা গৃহীত হয়। দ্বিতীয় ধাপে চোখের অক্ষিপটে আলোকরশ্মির ভৌত তড়িৎচৌম্বকীয় শক্তি স্নায়ুকোষে পরিবহনযোগ্য তড়িৎ-রাসায়নিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়, যাতে দৃষ্টিগত উপাত্তগুলি মস্তিষ্ক প্রক্রিয়াজাত করতে পারে। তৃতীয় ধাপে চোখ থেকে দৃষ্টিগত উপাত্তগুলি তড়িৎ-রাসায়নিক সংকেতরূপে মস্তিষ্কে প্রেরণ করা হয়। মানুষের ক্ষেত্রে সংকেতগুলি দৃষ্টিস্নায়ু ও মস্তিষ্কের পার্শ্বিক জানুবৎ স্নায়ুকেন্দ্র হয়ে মানবমস্তিষ্কের পশ্চাৎকরোটি খণ্ডকে অবস্থিত মুখ্য দৃষ্টি-বহিঃস্তরে বাহিত ও প্রক্রিয়াজাত হয় এবং সবশেষে দৃষ্টি-বহিঃস্তর থেকে অগ্রললাটীয় খণ্ডকে সংকেত প্রেরিত হয়ে সম্পূর্ণ দৃষ্টিগত প্রক্রিয়াজাতকরণ সম্পন্ন হয়। মস্তিষ্কের দৃষ্টি-সংশ্লিষ্ট অংশগুলিতে দৃষ্টিগত উপাত্তগুলির বৈশিষ্ট্যগুলি প্রথমে যাচাই-বাছাই করা হয়, সেগুলিকে দৃষ্টিগত প্রত্যক্ষণের কিছু মূলনীতি অনুসরণ করে পুনর্বিন্যস্ত করা হয় এবং সবশেষে সেগুলির একটি অর্থবহ ব্যাখা প্রদান করা হয়। এই পুরো প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত দ্রুতগতিতে (১ সেকেন্ডের এক দশমাংশ সময়ে বা ক্ষেত্রবিশেষে তার চেয়েও কম সময়ে) সম্পাদিত হয়।

তবে দৃষ্টিগত প্রত্যক্ষণকে কেবলমাত্র দর্শনেন্দ্রিয় দ্বারা প্রাপ্ত তথ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে মানসিক চিত্র উৎপাদনের একটি বিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া হিসেবে গণ্য করা উচিত নয়। বরং এটি প্রাণীর "কার্যসাধন-প্রত্যক্ষণ চক্রের" একটি অংশবিশেষ, যেখানে দৃষ্টিগত প্রত্যক্ষণ প্রাণীর কর্মকাণ্ডকে প্রভাবিত করে এবং সেই কর্মকাণ্ডগুলি আবার দৃষ্টিগত প্রত্যক্ষণকে প্রভাবিত করে এবং এভাবে অবিরত একটি চক্র চলমান থাকে, যেখানে প্রাণীর কর্মকাণ্ড ও দৃষ্টিগত প্রত্যক্ষণের মধ্যে কোনও সুস্পষ্ট সীমানা টানা সম্ভব নয়। দৃষ্টিগত প্রত্যক্ষণ তাই সদাসক্রিয় ও চলমান একটি প্রক্রিয়া। গবেষকেরা বের করেছেন যে মানুষের চোখ প্রতি সেকেন্ডে ১ কোটি বিট বা ১.২৫ মেগাবাইট পরিমাণ দৃষ্টিগত উপাত্ত মস্তিষ্কে প্রেরণ করে।

দর্শনশক্তির সাথে জড়িত বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় উপাদানকে সম্মিলিতভাবে দৃষ্টিতন্ত্র (Visual system) হিসেবে উল্লেখ করা হয়। যে অঙ্গটি পরিবেশ থেকে আগত দৃষ্টিগত তথা আলোকীয় উপাত্তগুলি আহরণ করে ও মস্তিষ্কে প্রেরণ করে, তাকে দর্শনেন্দ্রিয়স্থান বলে। যেমন মানবচক্ষু মানুষের দর্শনেন্দ্রিয় সংশ্লিষ্ট বিশেষ অঙ্গ। ভাষাবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান , সংজ্ঞানাত্মক বিজ্ঞান, স্নায়ুবিজ্ঞানআণবিক জীববিজ্ঞানের এগুলির উপরে বহু বিভিন্ন ধরনের গবেষণা চালানো হয়। এগুলিকে কখনও কখনও সম্মিলিতভাবে দৃষ্টি বিজ্ঞান হিসাবে উল্লেখ করা হয়।

দৃষ্টিগত প্রত্যক্ষণের সাথে দৃষ্টিতীক্ষ্মতা বা দৃষ্টিসূক্ষ্মতা নামক ধারণাটির পার্থক্য আছে। দৃষ্টিতীক্ষ্মতা বলতে কোনও ব্যক্তি কতটুকু পরিস্কার দেখতে পারেন, সে ব্যাপারটিকে নির্দেশ করা হয়; একে চলতি ভাষায় "দৃষ্টিশক্তি" হিসেবেও ডাকা হতে পারে। কোনও ব্যক্তির দৃষ্টিতীক্ষ্মতা নিখুঁত হলেও (যাকে ২০/২০ দৃষ্টিশক্তি হিসেবে ডাকা হয়) তার দৃষ্টিগত প্রত্যক্ষণে অন্যান্য সমস্যা থাকতে পারে।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Daniel Chandler; Rod Munday (২০২০), A Dictionary of Media and Communication (৩য় সংস্করণ), Oxford University Press