ঘনযন্ত্র (ইংরেজি: Idiophone) বলতে এমন এক ধরনের বাদ্যযন্ত্রকে বোঝায় যেটিতে স্বয়ং বাদ্যযন্ত্রটির দেহটিকে কম্পিত করে ধ্বনি উৎপাদন করা হয়। অন্য ভাষায় এগুলিতে শুষিরযন্ত্রগুলির মত বায়ুপ্রবাহ ব্যবহার করে, ততযন্ত্রগুলির মত তার টেনে, ঘষে বা আঘাত করে, আনদ্ধযন্ত্রগুলির মতো চামড়ার পর্দায় আঘাত করে কিংবা বৈদ্যুতিক বাদ্যযন্ত্রগুলির মত বিদ্যুৎ ব্যবহার করে ধ্বনি উৎপাদন করা হয় না। পাশ্চাত্যের হর্নবস্টেল-জাখস বাদ্যযন্ত্র শ্রেণীকরণ পদ্ধতির প্রথম সংস্করণে বাদ্যযন্ত্রগুলিকে যে চারটি প্রধান শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে ঘনযন্ত্র একটি। ভিক্তর-শার্ল মাইয়ো (Victor-Charles Mahillon) যে শ্রেণীকরণ পদ্ধতিটি প্রস্তাব করেন, সেটির প্রাথমিক সংস্করণে এগুলিকে "স্বতঃযন্ত্র" (Autophone) নাম দেওয়া হয়। ঘনযন্ত্রগুলির মধ্যে সবচেয়ে প্রচলিতগুলি হল ঘাত ঘনযন্ত্র (struck idiophone বা concussion idiophone), যেগুলিকে কাঠি বা হাত দিয়ে সরাসরি আঘাত করে ধ্বনি উৎপাদন করা হয়। উদাহরণ হিসেবে কাঠখণ্ড (বাদ্যযন্ত্র), সুরেলা বাটি (singing bowl), ইস্পাতজিহ্বা ঢোল (steel tongue drum), ত্রিভুজ (বাদ্যযন্ত্র) বা মারিম্বা-র নাম উল্লেখ্য। অন্যদিকে কিছু ঘাত ঘনযন্ত্রগুলিকে পরোক্ষভাবে যন্ত্রের একাংশে সাথে আরেক অংশ ঘষে কিংবা যন্ত্রটিকে ঝাঁকিয়ে ধ্বনি উৎপাদন করা হতে পারে, যেমন মারাকা বা ফ্লেক্সাটোন যন্ত্রগুলিতে। বিভিন্ন ধরনের ঘণ্টাজাতীয় বাদ্যযন্ত্রগুলিও উপরোক্ত দুই ধরনের সরাসরি বা পরোক্ষ ঘাত ঘনযন্ত্রের শ্রেণীতে পড়ে। ইহুদির হার্প হল প্রচলিত একটি টেনে বাজানো ঘনযন্ত্র (plucked idiophone)।

খৌশিয়েন (kouxian), একটি টান মেরে বাজানো ঘনযন্ত্র
একগুচ্ছ ঘণ্টা পাত (bell plates), C2–E4 পরিসরের; এক ধরনের আঘাত করে বাজানো ঘনযন্ত্র (ম্যালেট হাতুড়ি দিয়ে বাজানো) বা ঘর্ষণ ঘনযন্ত্র (ছড় দিয়ে বাজানো)
ক্লেভ (পুরোভাগে), একটি আঘাত করে বাজানো ঘনযন্ত্র

কার্ট সাকসের মতে[১] ঘনযন্ত্রগুলি

হল সেইসব যন্ত্র সেগুলিই প্রাকৃতিকভাবেই সাঙ্গীতিক স্বর উৎপাদনকারী উপাদান দিয়ে তৈরি এবং যেগুলিকে ততযন্ত্রের তার বা ঢোলের চামড়ার পর্দার মতো অতিরিক্ত টানটান অবস্থায় রাখার প্রয়োজন পড়ে না। এই শ্রেণীর যন্ত্রগুলিতে বাদকের ক্রিয়া যন্ত্রগুলির আকৃতিদান করেছে, কেননা এগুলি করতালি বা মাটিতে পায়ের দাপানির একটি সম্প্রসারিত রূপ হিসেবে উদ্ভূত হয়েছে। সুতরাং মূল প্রশ্নটি হল কীভাবে এগুলিকে কম্পিত করা হয়।

শ্রেণিবিভাগ সম্পাদনা

যেসব ঘাত বাদ্যযন্ত্র ঢোল বা ড্রাম জাতীয় নয়, সেগুলির সিংহভাগই ঘনযন্ত্র। হর্নবস্টেল ও জাখস ঘনযন্ত্রগুলিকে চারটি প্রধান উপশ্রেণীতে ভাগ করেছেন।

প্রথমটি হল "ঘাত ঘনযন্ত্র"। পাশ্চাত্যে ড্রাম ব্যতীত অন্য প্রায় সব ধরনের ঘাত বাদ্যযন্ত্র এই শ্রেণীতে পড়েছে। এগুলিকে কাঠি বা হাত দিয়ে সরাসরি আঘাত করে কম্পিত করে ধ্বনি উৎপাদন করা হতে পারে, যেমন কাষ্ঠখণ্ড, সুরেলা বাটি, ইস্পাতজিহ্বা ড্রাম, ত্রিভুজ বা মারিম্বা। আবার এগুলিকে ঘষে বা ঝাঁকিয়ে পরোক্ষভাবে ধ্বনি উৎপাদন করা হতে পারে, যেমন মারাকা বা ফ্লেক্সাটোন। বিভিন্ন ধরনের ঘণ্টা বাদ্যযন্ত্রও এই শ্রেণীতে পড়ে।

অন্য তিনটি শ্রেণী অপেক্ষাকৃত বিরল। এগুলি হল "টানা ঘনযন্ত্র" যেমন ইহুদির হার্প, বিবর্ধিত ক্যাকটাস, খৌশিয়েন, দান মোই, সঙ্গীতবাক্স, এমবিরা (বৃদ্ধাঙ্গুলির পিয়ানো); "শুষির ঘনযন্ত্র" যেমন আয়েলোসক্লাভিয়ে; এবং "ঘর্ষ ঘনযন্ত্র", যেমন সুরেলা বাটি, কাচের হারমোনিকা, কাচের হার্প, ফোনোগ্রাম, কাচবাদ্যযন্ত্র, ড্যাক্সো-বাদ্যযন্ত্র, স্টাইরো-বাদ্যযন্ত্র, সাঙ্গীতিক করাত, পেরেক বেহালা, ইত্যাদি।[২]

অন্যান্য শ্রেণীকরণ পদ্ধতিতে ছয়টি প্রধান উপশ্রেণী ব্যবহার করা হয়।

  • স্বঘাতী ঘনযন্ত্রগুলিতে একটি দিয়ে আরেকটিকে আঘাত করে ধ্বনি উৎপাদন করা হয়।
  • ঘাত (percussion) ঘনযন্ত্রগুলিকে কোনও বহিরাগত বস্তু দিয়ে যেমন হাতুড়ি, ম্যালেট, বা কাঠি দিয়ে আঘাত করা হয় ।
  • ঝুমঝুমি ঘনযন্ত্রগুলিকে ঝাঁকিয়ে ধ্বনি উৎপাদন করা হয়।
  • ঘষটানো ঘনযন্ত্রগুলিকে কাঠি বা বহিরাগত অন্য কোনও বস্তু দিয়ে ঘষে ধ্বনি উৎপাদন করা হয়।
  • টানমারা ঘনযন্ত্রগুলিতে যন্ত্রটির অংশ হিসেবে বিদ্যমান একটি স্থিতিস্থাপক জিহ্বা টেনে টেনে ধ্বনি উৎপাদন করা হয়।
  • ঘর্ষন ঘনযন্ত্রগুলিকে ঘষে ঘষে কম্পন ও ধ্বনির তীব্রতা বৃদ্ধি করা হয়।[৩]


নকশা সম্পাদনা

বেশিরভাগ ঘনযন্ত্রই কাচ, ধাতু, দগ্ধমৃত্তিকাকাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়। ঘনযন্ত্রগুলিকে একটি ঐকবাদনদলের ঘাতযন্ত্র বিভাগের অংশ হিসেবে গণ্য করা হয়।

কিছু কিছু ঘনযন্ত্র আছে, যেগুলি সাধারণত আঘাত করে ধ্বনি উৎপাদন করা হলেও এগুলিকে ছড় দিয়ে ঘষেও বাজানো হতে পারে, যেমন ভাইব্রাফোন দণ্ড ও সিম্বাল।

আরও দেখুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Sachs, Curt (1940). The History of Musical Instruments, p.455. W. W. Nortan & Company, Inc. আইএসবিএন ০-৩৯৩-০২০৬৮-১
  2. Don Michael Rendel, ed., The New Harvard Dictionary of Music, 1986.
  3. "Idiophones", The Most Comprehensive Music Technology Glossary. ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২০০৯-১২-১৭ তারিখে

বহিঃসংযোগবিদ্যা সম্পাদনা