গোপালপুর গণহত্যা হলো ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দ্বারা সংঘটিত অন্যতম একটি গণহত্যা। এই গণহত্যাটি সংঘটিত হয়েছিল ১৯৭১ সালের ৫ মে নাটোর জেলার লালপুর উপজেলার অন্তর্গত গোপালপুর সদরে। এই গণহত্যার শিকার হয়েছিলেন উত্তরবঙ্গ চিনিকলে কর্মরত বাঙালিরা। [১]

পশ্চাৎপট সম্পাদনা

২৫-শে মার্চ, ১৯৭১ এর মধ্যরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হত্যার মাধ্যমে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি নৃজাতি নির্মূল করার পরিকল্পনা হাতে নেয়, যা অপারেশন সার্চলাইট নামে পরিচিত। এই আক্রমণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটায় যা নয় মাস দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল। [২]

পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ২৫-শে মার্চ রাতেই ঢাকা শহরের উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে। কিন্তু তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে স্থানীয় বাঙালি সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্কল্পবদ্ধ প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়।[৩]

পাবনায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ২৫তম পদাতিক বাহিনী স্থানীয়দের কাছ থেকে নিয়ন্ত্রণ ছিনিয়ে নিতে গিয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ফলশ্রুতিতে, তারা রাজশাহীর ব্যাটেলিয়ন সদরদপ্তর থেকে জনবল ও রসদের যোগান চায়। মেজর রাজা আসলাম পাবনা এসে পৌঁছেন, কিন্তু রাজশাহীর দিকে পশ্চাদপসারণ করতে বাধ্য হন। তাদের বিচলন ব্যাহত হয় স্থানীয় বাহিনীর সাথে সংঘর্ষের ফলে।[৪] স্থানীয় বাঙালি মুক্তিবাহিনী অবরোধক স্থাপন করে এবং নাটোরের ধানাইদহে একটি সেতু ধ্বংস করে আক্রমণ প্রতিহত করেন। গোপালপুর রেলফটকে স্থানীয় স্টেশনকর্তা রেলওয়ে বগিসমূহ দিয়ে অবরোধক তৈরি করেন।

মার্চের ৩০ তারিখে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ওয়ালি ময়না গ্রামের কাছে যাত্রাবিরতি নেয়ার কালে বাঙালি যোদ্ধাদের একটি দল তাদের আক্রমণ করে স্থানীয় সাঁওতালদের সাহায্য নিয়ে। স্থানীয়দের কাছে ময়নার যুদ্ধ নামে পরিচিত এই সংঘর্ষে চল্লিশজন বাঙালি যোদ্ধা নিহত হন। যদিও পাকিস্তানিদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম ছিল, তদাপি তাদের মনোবলে ছেদ পড়ে।

রাতে পাকিস্তানিরা ছোট ছোট উপদলে বিভক্ত হয়ে পালানোর চেষ্টা করে। পরবর্তী দিন, তাদের অনেকেই স্থানীয় বাঙালিদের হাতে ধরা পড়ে; তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তা মেজর আসলাম। সেনাদের স্থানীয় বাঙালি মুক্তিবাহিনীর নেতা ও উত্তরবঙ্গ চিনিকলের সাধারণ ব্যবস্থাপক অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট আনোয়ারুল আজিম এর বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। সংক্ষিপ্ত বিচারকার্যের পরে লালপুর এসএস পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে পাকিস্তানি সেনাসদস্যদের গুলি করে মেরে ফেলা হয়।[১]

গণহত্যা সম্পাদনা

বাঙালি প্রতিরোধের উত্তরে, রাজশাহীতে অবস্থিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সদরদপ্তর থেকে স্থলপথে ও আকাশপথে শক্তিদল দ্রুত প্রেরণ করে। সেনাবাহিনী ত্বরিতগতিতে পাবনা, ঈশ্বরদী ও নাটোরের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণে সক্ষম হয়। ৫ই মে, ১৯৭১ তারা গোপালপুর পৌঁছায় এবং বাঙালিদের শক্ত ঘাঁটি চিনিকল দখল করে ফেলে। প্রায় ২০০ বাঙালি জনগণ যারা মূলত চিনিকলের কর্মচারী ছিল, সবাইকে জড়ো করা হয় ও মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। যোদ্ধাদের নেতা অবসরপ্রাপ্ত লে. আনোয়ারুল আজিম সেনাবাহিনীর হাতে ধরা দেন এবং অনুরোধ করেন যেন নিরীহ লোকজনকে ছেড়ে দেয়া হয়। সেনারা লে. আজিম ও তার পরিবারকে গুলি করে। বন্দী কর্মচারীদের চিনিকলের ভিতরে একটি পুকুরের সামনে লাইনে দাঁড় করানো হয় এবং গুলি করে হত্যা করা হয়। গুলিবিদ্ধ ২০০ জন বন্দির মাঝে মাত্র চারজন- আবদুল জলিল শিকদার, খরশেদ আলম, আবুল হোসেইন, ইমাদ উদ্দিন এবং ইঞ্জিল সর্দার বাঁচতে সক্ষম হন।

মৃতদেহগুলোকে পুকুরে নিক্ষেপ করা হয়। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে পুকুরটির নামকরণ করা হয় 'শহীদ সাগর।' গোপালপুর রেলওয়ে স্টেশনের নাম পরিবর্তন করা হয় 'আজিমনগর স্টেশন,' অবসরপ্রাপ্ত লে. আজিমের স্মরণে।[১]

১৫ ডিসেম্বর, ২০০৯ তারিখে প্রকাশিত দৈনিক প্রথম আলোর "বধ্যভূমি থেকে ফেরা তাঁরা চারজন" শীর্ষক প্রতিবেদনে প্রত্যক্ষদর্শী খন্দকার জালাল আহমেদের ভাষ্যে,[৫]

"১৯৭১ সালের ৫ মে সকাল সাড়ে ১০টায় দায়িত্ব পালন করছিলাম। দুজন পাকিস্তানি সেনা আমার দুই পাশে এসে দাঁড়াল। একজন পিঠে রাইফেল ঠেকিয়ে বলল, ‘ইয়ে বাঙালি, মিটিং মে চল’। এ সময় মাথায় সাদা রুমাল বাঁধা মঞ্জুর ইমান নামের একজন অবাঙালি কর্মচারী বাঙালিদের শনাক্ত করে দিচ্ছিল। এর মধ্যে মিলের কর্মকর্তা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট আনোয়ারুল আজিমকেও ধরে আনা হয়। একজন পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা আজিমকে বলে, ‘কিসনে মেজর আসলামকে মারা হায়’? তিনি বলেন, জানি না। আজিম এ সময় হানাদারদের সঙ্গে তর্ক শুরু করেন। পরে নরপশুরা আমাদের মিলের অফিসার্স কোয়ার্টারের পুকুরঘাটে নিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করায়। কয়েক মিনিটের মধ্যে ঘাতকদের ১৩টি স্বয়ংক্রিয় এলএমজি একসঙ্গে আমাদের ওপর গর্জে ওঠে। মুহূর্তের মধ্যে পুকুরঘাট লাশের স্তুপে পরিণত হয়। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন মিলে কর্মরত প্রায় ২০০ শ্রমিক কর্মকর্তা-কর্মচারী। মৃত্যু নিশ্চিত করতে আমাদের বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে পানির মধ্যে গড়িয়ে দেয় পাকিস্তানি সেনারা। একসময় জ্ঞান ফিরে পেয়ে দেখি, আমার মাথাটা ঘাটের ওপর এবং দেহের অর্ধেক অংশ পানির মধ্যে ডুবে আছে। লাশের স্তূপের মধ্যে উল্টে-পাল্টে জীবন্ত কাউকে খুঁজছিলেন আমার সহকর্মী মেহমান আলী বুঝলাম, তিনিই আমাকে লাশের স্তুপ থেকে উদ্ধার করেছেন। বহু কষ্টে উঠে বসতেই দেখতে পেলাম, পাশে পড়ে আছে ছোট ভাই মান্নানের লাশ। হত্যার আগে ও আমাকে পালিয়ে যেতে বলেছিল।”

এ প্রতিবেদনে আরো বলা হয়,

"জালাল আহমেদ জানান, ব্রাশফায়ারের আগ মুহূর্তে মান্নান নামের মিলের এক হিসাব সহকারী শায়িত অবস্থায় মাথাটা সামান্য উঁচু করে পবিত্র কোরআন পাঠ করছিলেন। তাঁকে দেখে হানাদারেরা বলে, ‘তুম মৌলবি হু? ছোড় দাও।’ তখন তিনি বলেন, ‘আমি একা যাব না। সবাইকে ছাড়।’ হানাদারেরা তখন মান্নানকে পৈশাচিক নির্যাতন চালিয়ে গুলি করে হত্যা করে। মিলের প্রশাসনিক কর্মকর্তা পুকুরে অর্ধেক ডুবন্ত অবস্থায় কোরআন তেলাওয়াত করছিলেন। পরে পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে বাঁশ দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে।"

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Locals still have nightmare about supreme sacrifices of Lt. Azim, 200 others ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৪ জুন ২০১১ তারিখে, The New Nation, আন্তর্জালিক সংস্করণ; ৮-ই মে, ২০০৯।
  2. Salik, Siddiq, Witness To Surrender, p63, p228-9 id = আইএসবিএন ৯৮৪-০৫-১৩৭৩-৭
  3. PAKISTAN: The Battle of Kushtia ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৪ সেপ্টেম্বর ২০১০ তারিখে TIME magazine, April 19, 1971
  4. A great victory yet to get any recognition The Daily Star, 30 March, 2009
  5. "বধ্যভূমি থেকে ফেরা তাঁরা চারজন"www.prothom-alo.com। ১৫ ডিসেম্বর ২০১৯। ১৯ আগস্ট ২০২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১২ জানুয়ারি ২০১৪