গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তী

পণ্ডিত গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তী [১] ছিলেন একজন ধ্রুপদী রাগসঙ্গীত শিল্পী এবং ধ্রুপদী সঙ্গীত শিক্ষার গুরু যিনি মার্গসঙ্গীত কে মুক্তি দিয়েছিলেন রাজা-মহারাজা, জমিদার ও উচ্চবিত্তদের জলসাঘর এবং কোঠাবাড়ির বাইজি দের থেকে এবং সেই গানকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সাধারণ মধ্যবিত্ত ভদ্র বাঙালি সমাজে। শুধুমাত্র সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে নয়, আদর্শ শিক্ষক হিসেবেও তিনি অসাধারণ; তথাকথিত অভিজাত এবং ভদ্র বাঙালি পরিবারের মহিলাদের মধ্যে ধ্রুপদী সঙ্গীত শিক্ষার প্রচলন করেন তিনি । তার অবিস্মরণীয় অবদান রয়েছে বাংলায় খেয়াল ও ঠুমরিকে জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে।

গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তী
জন্ম(১৮৮৫-১২-১৮)১৮ ডিসেম্বর ১৮৮৫
মৃত্যু২৫ এপ্রিল ১৯৪৮(1948-04-25) (বয়স ৯২)
জাতীয়তাভারতীয়
পেশাসঙ্গীতশিল্পী, ধ্রুপদী রাগ সঙ্গীতশিল্পী
উল্লেখযোগ্য কর্ম
'ভুলো না মন তারে’, ‘স্মরণ মে আয়ে হ্যায়’, ‘হেরি মোহে জানে'

প্রাথমিক জীবন সম্পাদনা

গিরিজাশঙ্করের জন্ম বহরমপুরের এক বনেদী পরিবারে ১৮৮৫ সালের ১৮ ডিসেম্বর । সঙ্গীতশিল্পী না হলে, গিরিজাশঙ্কর হয় চিত্রশিল্পী অথবা সুদক্ষ অভিনেতা হতে পারতেন। তার বাবা ভবানীকিশোর ছিলেন সে কালের খ্যাতনামা আইনজীবী এবং উদারপন্থী । বহরমপুরে প্রাথমিক পড়াশোনা শেষ করে, গিরিজাশঙ্কর সরকারি আর্ট স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন এবং নিজের অনন্য শিল্প প্রতিভার পরিচয় দিয়েছিলেন সেখানে। থিয়েটারের প্রতিও তার সমান আগ্রহ ছিল। অভিনয়ে ছিল তার সাবলীল দক্ষতা।

সঙ্গীত শিক্ষা সম্পাদনা

আনুমানিক ১৯০৪ নাগাদ গিরিজাশঙ্কর তালিম নিতে শুরু করেন বিষ্ণুপুর ঘরানার নামী শিল্পী রাধিকাপ্রসাদ গোস্বামীর কাছে। টানা আট বছর চলে তার এই ধ্রুপদ-ধামারের তালিম। শিষ্য গিরিজাশঙ্করের ধ্রুপদাঙ্গের গানে সুর বিস্তারে স্বয়ং রাধিকাপ্রসাদও মুগ্ধ হয়ে যেতেন। ১৯১২ সাল নাগাদ গিরিজাশঙ্করের সঙ্গে যোগাযোগ হয় শ্যামলাল ক্ষেত্রীর যিনি তদানীন্তন কলকাতার অন্যতম নামী একজন সঙ্গীতশিল্পী। সে সময় শ্যামলালের বাড়িতে আসতেন ভাইয়া গণপত রাও সাহেব, মওজুদ্দিন খান, আলাউদ্দিন খান প্রমুখ অন্যান্য বিখ্যাত সঙ্গীতসাধকরা । শোনা যায়[২], গিরিজাশঙ্কর মওজুদ্দিন খানের কাছে তালিম নিয়েছিলেন বন্দিশি বা বোল-বানাও ঠুমরির। বহরমপুরেরে মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্রের পৃষ্ঠপোষকতায় গিরিজাশঙ্কর দিল্লি দরবারে গান গাইতে গিয়েছিলেন এবং সেখানে তার গান শুনে মুগ্ধ হয়ে তাকে শিষ্য রূপে গ্রহণ করেন প্রবাদপ্রতিম শিল্পী মুজফ্ফর খান। এর পর গিরিজাশঙ্কর রামপুরে গিয়ে উস্তাদ মহম্মদ আলি খান ও ছম্মন খাঁ সাহেবের কাছে সঙ্গীত শিক্ষা গ্রহণ করেন। গিরিজাশঙ্কর ধ্রুপদের তালিম নিয়েছিলেন নাসিরুদ্দিন খাঁ সাহেবের কাছে, খেয়াল শিখেছিলেন এনায়েৎ হুসেন খাঁ সাহেবের কাছে আর ঠুমরির তালিম পান গণপৎ রাও সাহেবের কাছে। এ ছাড়াও গান শিখেছিলেন ওয়াজির খান (রামপুর), গ্বালিয়রের এনায়েৎ হুসেন খান, লখনউয়ের বড়ে মুন্নে খানের কাছেও। ১৯১৯ নাগাদ উস্তাদ বদল খান কলকাতায় বসবাস শুরু করেন। সেই সময় গিরিজাশঙ্কর তার কাছে খেয়ালের রাগ বিস্তারের জটিল বিষয়ে তালিম নেন।

কর্মজীবন সম্পাদনা

১৯৩৪ সালে 'অল বেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্স' এর প্রথম অধিবেশনে খেয়াল ও বোলবানাও ঠুমরি গেয়ে আসর মাতিয়েছিলেন গিরিজাশঙ্কর। মধ্য কলকাতায় তার বাড়িতে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সঙ্গীতকলা ভবন এবং ভবানীপুর সঙ্গীত ভারতী। এ ছাড়াও তিনি সঙ্গীত সম্মিলনীর অধ্যক্ষ ছিলেন। দীর্ঘ সময় ধরে তিনি যুক্ত ছিলেন অল ইন্ডিয়া রেডিয়োর সঙ্গে গায়ক এবং প্রশিক্ষক হিসেবে।বিভিন্ন রেকর্ড কোম্পানি থেকে প্রকাশিত তার বেশ কিছু গানের রেকর্ড জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। তার মধ্যে ‘ভুলো না মন তারে’[৩], ‘স্মরণ মে আয়ে হ্যায়’, ‘হেরি মোহে জানে’[৪] উল্লেখযোগ্য।

তবে তার পরিচিতি শুধুমাত্র গায়ক হিসেবে নয়, বরং একজন আদর্শ মার্গসঙ্গীত শিক্ষক হিসেবে। ১৯৩৩-এর এলাহাবাদ সংগীত সম্মেলনে শ্রেষ্ঠ স্থানাধিকারী সকলেই গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তীর ছাত্র-ছাত্রী হওয়ার সুবাদে তিনি 'বেস্ট টিচারস' কাপ' লাভ করেন । কণ্ঠ ও যন্ত্রসংগীতে বিচারকের আসনে ছিলেন উস্তাদ নাসিরুদ্দিন খান এবং উস্তাদ আলাউদ্দিন খান। সেই থেকে প্রতি বছর গিরিজাশঙ্কর সেখানে আমন্ত্রিত থাকতেন। সে বছরই যামিনী গঙ্গোপাধ্যায় ওই সম্মেলনে খেয়াল গেয়ে সাড়া ফেলে দেন। তেমনই অন্যান্যদের মধ্যে রথীন চট্টোপাধ্যায়, শৈলেন বন্দ্যোপাধ্যায়, শান্তিলতা মুখোপাধ্যায় অন্যান্য বিষয়ে পুরস্কৃত হয়েছিলেন।

তার প্রখ্যাত ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে ছিলেন যামিনী গঙ্গোপাধ্যায়, জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, তারাপদ চক্রবর্তী, সুখেন্দু গোস্বামী, সুধীরলাল চক্রবর্তী, নয়না দেবী, এ টি কানন। এ ছাড়াও তার কাছে গান শিখেছিলেন ইভা দত্ত (গুহ), গীতা মিত্র (দাস), আরতি দত্ত (দাস) প্রমুখ ।

কাজের স্বীকৃতি সম্পাদনা

এক আসরে গিরিজাশঙ্করের গান শুনে উচ্ছ্বসিত হয়ে সেতারি এনায়েৎ খান বলেছিলেন, ‘‘জীবনে বহু বার তিনি নামকরা উস্তাদদের গান শুনেছিলেন। তবে এর আগে কারও গানে তিনি এমন স্বর্গীয় আবেগ উপলব্ধি করেননি।’’ শচীনদেব বর্মণ লিখেছিলেন, ‘‘সে যুগে সংগীতের প্রায় সকল ছাত্র-ছাত্রীর স্বপ্ন ছিল গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তীর কাছে গান শেখার।’’

তথ্যসূত্র সম্পাদনা