খোটান
খোটান মধ্য এশিয়ার একটি উল্লেখযোগ্য শহর। পুর্বতুর্কীস্তানের কুয়েনলুন পর্বতের উত্তর পাদদেশে এবং তারিম বেসিনের তাকলামাকান মরুভূমির দক্ষিণ প্রান্তের মাঝে এর অবস্থান। খ্রিস্টীয় অব্দের প্রথম চার শতকের বা তারও কিছু আগে থেকে এটি একটি সমৃদ্ধ রাজ্যের রাজধানী ছিল। প্রসিদ্ধ রেশমপথের উপর অবস্থিত এই শহরটি প্রাচীন বৌদ্ধ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।[১] স্থানীয় প্রবাদ অনুসারে মৌর্য সম্রাট অশোকের পুত্র কুন্তন (অথবা কুণাল) এখানে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং তার নামানুসারেই রাজ্যটি কুন্তন (বর্তমানে খোটান)বা হোটান নামেও পরিচিত ।
ভৌগোলিক অবস্থান
সম্পাদনাখোটান শহরটির অবস্থান ৩৭°৪' উত্তর অক্ষরেখায় এবং ৮০°২' পূর্ব দ্রাঘিমায়। একদিকে তাকলামাকান মরুভূমি অন্যদিকে কুয়েনলুনের পাদদেশ, এই দুয়ের মাঝের খোটান প্রকৃত অর্থে শুষ্ক, জলহীন। তাই স্বাভাবিক ভাবেই মানুষের বসতি কম। য়ুরুংকাস ও কারাকাশ নামের দুটি নদী খোটানকে জলের যোগান দেয় আর এদের উর্বর পলিমাটির গুণে খোটান ফল ও অন্যান্য দানাশস্য উৎপাদনে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে।[২]
বৌদ্ধ সংস্কৃতি
সম্পাদনা
খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে খোটানে বৌদ্ধধর্মের প্রসার ঘটে এবং তা একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত বিপুল প্রসারের সঙ্গে স্থায়ী ছিলো; যেকারণে খোটানের জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম বৌদ্ধ ।[৩] একটি খরোষ্ঠী লিপিতে খোটানের মহারাজ রাজাতিরাজ দেববিজিত সিংহ-এই নামটি পাওয়া যায়। কাঠের ফলক,চামড়া, কাগজ ও রেশমের ভারতীয় অক্ষরে ও ভারতীয় ভাষায় লিখিত লিপিগুলি থেকে বেশ বোঝা যায় যে একসময় এখানে ভারতীয় সংস্কৃতি ও সভ্যতার প্রসার ঘটেছিলো। খোটানে অনেক বড়ো বড়ো বৌদ্ধ মন্দির ও বিহার ছিলো-এদের মধ্যে গোমতী বিহার এককালে বিশেষ খ্যাতি লাভ করেছিলো। চিনদেশীয় পরিব্রাজক ফা-হিয়েন চতুর্থ শতাব্দীর শেষে এবং হিউয়েন সাঙ সপ্তম শতকের মধ্যভাগে এই বিহারের ও খোটানের সমৃদ্ধির বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। এখানে ভারতীয় সভ্যতার পাশাপাশি একশত বিহার (সংঘারাম) ও পাঁচ হাজার বৌদ্ধ ভিক্ষু ছিলো। অনেক ভারতীয় বৌদ্ধ পণ্ডিত ও ভিক্ষু এখানে বাস করতেন। চিনদেশীয় অনেক পণ্ডিত বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্র পাঠের জন্য ভারতে না গিয়ে এখানেই শিক্ষা লাভ করতেন। গোমতী বিহারে রচিত অনেক গ্রন্থ প্রায় বৌদ্ধ ত্রিপিটকের ন্যায় মর্যাদা লাভ করেছিলো।[৪]
সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবন
সম্পাদনাসপ্তম শতাব্দীর চীনা পর্যটক হিউয়েন সাঙের বিবরণী থেকে জানা যায় যে খোটানে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ ছিলো অত্যন্ত কম ,কিন্তু সেগুলি ছিলো খুবই উর্বর। এইসব উর্বর জমিতে প্রচুর পরিমাণে খাদ্যশস্য ও ফল উৎপন্ন হতো। তিনি আরও উল্লেখ করেছিলেন যে, এ স্থান কার্পেট আর রেশম উৎপাদনে সুপরিচিত ছিল।[৫] এছাড়াও জেড নামে সাদা কালো সিলিকেট ঘটিত এক ধরনের রূপান্তরিত শিলা দিয়ে খোটানীরা সুদৃশ্য অলংকার তৈরি করতো।
এক কথায় বলতে গেলে, খোটানের প্রধান অর্থনৈতিক ভিত্তি ছিলো নদীর জলসেচ দ্বারা উৎপাদিত ফসল এবং উল্লিখিত কুটিরশিল্প। হিউয়েন সাঙ খোটানের মানুষের সংস্কৃতির কথাও উল্লেখ করেছেন। সাহিত্যের প্রতি এদের অনুরাগ যেমন ছিলো তেমনি সংগীত ও নৃত্যকলায় এরা পারদর্শী ছিলো। শহরের মানুষেরা হাল্কা ও সাদা রঙের রেশমের পোশাক পরিধান করতেন।[৫] চিনদেশে প্রথম রেশম চাষ শুরু হয়েছিলো একথা যেমন সত্য তেমনি একথাও সমভাবে সত্য যে চিনদেশের বাইরে প্রথম রেশমের প্রচলন হয়েছিলো খোটানে। মতভেদ থাকলেও খোটানে রেশম চাষ বিষয়ে জনশ্রুতি আছে যে, জনৈক চৈনিক রাজকুমারী খোটানী রাজাকে বিয়ের সময়ে তার কবরীর মধ্যে লুকিয়ে রেশম কীট নিয়ে আসেন। সেখান থেকেই খোটানে রেশমের প্রচলন হয় এবং কালক্রমে রেশমশিল্প খোটানের অর্থনীতির অঙ্গীভূত হয়ে পড়ে।[৬]
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ Stein, M. Aurel (1907). Ancient Khotan. Oxford: Clarendon Press.
- ↑ Charles Higham (2004). Encyclopedia of Ancient Asian Civilizations. Facts on File. p. 143. আইএসবিএন ০-৮১৬০-৪৬৪০-৯.
- ↑ Ehsan Yar-Shater, William Bayne Fisher, The Cambridge history of Iran: The Seleucid, Parthian and Sasanian periods. Cambridge University Press, 1983, page 963.
- ↑ R.C> Majumder, ed., The History and Culture of the Indian People, vol.II. Bombay, 1951.
- ↑ ক খ Hsüan-Tsang (1985). "Chapter 12". In Ji Xianlin. Records of the Western Regions. peking.
- ↑ Hill (2009). "Appendix A: Introduction of Silk Cultivation to Khotan in the 1st Century CE", pp. 466-467.