খারিস্তানের যুদ্ধ

খারিস্তানের যুদ্ধ ৭৩৭ সালের ডিসেম্বরে খারিস্তানের নিকটে উমাইয়া খিলাফততুরগেশের মধ্যে সংঘটিত হয়। খোরাসানের গভর্নর আসাদ ইবনে আবদুল্লাহ আল-কাসরি এই যুদ্ধে উমাইয়াদের নেতৃত্ব দিয়েছেন। উমাইয়ারা যুদ্ধে তুরগেশ ও তাদের আরব মিত্র আল-হারিস ইবনে সুরাইজকে পরাজিত করে।

খারিস্তানের যুদ্ধ
মূল যুদ্ধ: উমাইয়া-তুরগেশ যুদ্ধ এবং মুসলিমদের মাওয়ারাননহর বিজয়

৮ম শতাব্দীতে খোরাসান ও মাওয়ারাননহরের মানচিত্র
তারিখডিসেম্বর ৭৩৭
অবস্থান
খারিস্তান (বর্তমান আফগানিস্তান)
ফলাফল উমাইয়াদের বিজয়
বিবাদমান পক্ষ
উমাইয়া খিলাফত
জুজজান রাজ্য
তুরগেশ খাগানাত
মাওয়ারাননহরের সোগদিয়ান শাসকবৃন্দ
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী
আসাদ ইবনে আবদুল্লাহ আল-কাসরি সুলুক
আল-হারিস ইবনে সুরাইজ
শক্তি
প্রায় ৭,০০০ প্রায় ৪,০০০

৮ম শতাব্দীর শুরুর দিকে উমাইয়ারা মাওয়ারাননহরের অধিকাংশ অঞ্চল জয় করেছিল। কিন্তু ৭২০ এর দশকে তুরগেশদের আক্রমণ ও স্থানীয় শাসকদের বিদ্রোহ বৃদ্ধি পায়। ৭৩১ সালে গিরিপথের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ৭৩৪-৭৩৬ সালে আল-হারিস ইবনে সুরাইজ খোরাসানে একটি বড় আকারের বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন। ইবনে সুরাইজকে দমন করার জন্য আসাদ ইবনে আবদুল্লাহ আল-কাসরিকে খোরাসানের গভর্নর নিয়োগ দেয়া হয়। ৭৩৭ সালে খুত্তালের নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধারের জন্য তিনি চেষ্টা করেন। কিন্তু তুরগেশদের আক্রমণের কাছে পরাজিত হন। এরপর তিনি বলখে চলে আসেন। একই সময় ইবনে সুরাইজের পরামর্শে তুরগেশ শাসক সুলুক তুখারিস্তানে অভিযান চালান। তাদের মোকাবেলা করার জন্য আসাদ ৭,০০০ সৈনিক নিয়ে অগ্রসর হন। সুলুকের বাহিনীতে মাত্র ৪,০০০ সৈনিক ছিল। খারিস্তানের নিকটে সংঘটিত দুই পক্ষের লড়াইয়ে আসাদ তার প্রতিপক্ষকে পরাজিত করেন। সুলুক ও ইবনে সুরাইজ পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও তাদের শিবির আরবদের হাতে এসে পড়ে। বাহিনীর অধিকাংশ সদস্য এসময় নিহত হয়েছিল। এই বিজয়ের ফলে খোরাসানে উমাইয়াদের অবস্থান মজবুত হয় এবং সুলুকের কর্তৃত্ব হ্রাস পায়।

পটভূমি সম্পাদনা

৭ম শতাব্দীর মধ্যভাগে মুসলিমদের পারস্যখোরাসান বিজয়ের পর ৭০৫-৭১৫ সালে কুতাইবা ইবনে মুসলিমের নেতৃত্বে মুসলিমরা মাওয়ারাননহর জয় করে।[১] ৭১৯ সালে মাওরাননহরের স্থানীয় শাসকরা চীনের রাজদরবার ও তুরগেশদের কাছে খিলাফতের বিরুদ্ধে সামরিক সহায়তার আবেদন করে।[২] এতে সায় দিয়ে ৭২০ সালে তুরগেশরা মাওয়ারাননহরের মুসলিমদের উপর ধারাবাহিক আক্রমণ শুরু করে। তাদের সাথে স্থানীয় সোগদিয়ানরা যোগ দেয়। উমাইয়ারা প্রাথমিকভাবে বিদ্রোহ দমন করতে সক্ষম হলেও ফারগানা উপত্যকার নিয়ন্ত্রণ হারায় এবং ৭২৪ সালে এর পুনরুদ্ধার অভিযানের সময় মারাত্মক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। উমাইয়ারা স্থানীয় জনগণের সমর্থন আদায় করতে চাইলেও ৭২৮ সালে তুরগেশদের সহায়তায় একটি বড় আকারের বিদ্রোহ দেখা দেয়। এর ফলে সমরকন্দের আশপাশের এলাকা ছাড়া মাওয়ারাননহরের অধিকাংশ এলাকা উমাইয়াদের হাতছাড়া হয়।[৩][৪]

৭৩১ সালে সংঘটিত গিরিপথের যুদ্ধে মুসলিমরা অনেক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এরপর সমরকন্দও হাতছাড়া হয়ে যায় এবং গুরাকের নেতৃত্বে সোগদিয়ানরা স্বাধীন হয়। এসময় আমুদরিয়ার উত্তরে মুসলিমদের সামরিক কর্তৃত্ব হ্রাস পায়।[৫][৬] অধিকন্তু উমাইরা ৭৩৪ সালে সংঘটিত আল-হারিস ইবনে সুরাইজের বিদ্রোহ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। একপর্যায়ে বিদ্রোহীরা প্রাদেশিক রাজধানী মার্ভে‌র জন্য হুমকি হয়ে উঠে। ইতিমধ্যে খোরাসানের গভর্নর হিসেবে দায়িত্বপালনকারী আসাদ ইবনে আবদুল্লাহ আল-কাসরি এসময় ২০,০০০ সিরিয়ান যোদ্ধা নিয়ে অগ্রসর হন। ফলে ইবনে সুরাইজের বিদ্রোহ দমন করা সম্ভব হয়। তবে ইবনে সুরাইজ পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।[৭][৮]

৭৩৭ সালে আসাদ খুত্তালে অভিযান চালান। এর শাসক তুরগেশ ও ইবনে সুরাইজকে সমর্থন করেছিলেন। আসাদ প্রাথমিকভাবে সফল হয়েছিলেন। এরপর খুত্তালের শাসক তুরগেশদের সহায়তা কামনা করেন। এতে সায় দিয়ে সুলুক প্রায় ৫০,০০০ সৈনিক নিয়ে দক্ষিণে অগ্রসর হন। আসাদ মোটামুটি সময়মত এই খবর পেয়েছিলেন কিন্তু আরব বাহিনীতে এর ফলে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। তারা এরপর নদীর অপর পারে অবস্থান নিতে সক্ষম হয়।[৯][১০][১১] তুরগেশরা তাদের অনুসরণ করে শিবিরে হামলা চালায়। পরেরদিন ৩০ সেপ্টেম্বর সংঘটিত যুদ্ধে তুরগেশরা বিজয়ী হয়।[১১][১২][১৩]

যুদ্ধ সম্পাদনা

এই অভিযানে মুসলিমদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়। আসাদ তার সেনাদের নিয়ে এরপর বলখে ফিরে আসেন। তবে তুরগেশরা তুখারিস্তানে অবস্থান করতে থাকে। ইবনে সুরাইজ এখানে তাদের সাথে যোগ দেন।[১৪][১৫] আরবরা শীতকালে অভিযানে যেত না। তাই আসাদ তার বাহিনীকে মোতায়েন করেননি। অন্যদিকে ইবনে সুরাইজের পরামর্শে তুরগেশরা নিম্ন তুখারিস্তানে হামলার পরিকল্পনা করে। এর ফলে সোগদিয়ানা ও তুখারিস্তানের অধিকাংশ স্থানীয় শাসক তুরগেশদের সাথে যোগ দেয়।[১৫][১৬]

৭ ডিসেম্বর আসাদ সেনা অভিযানের খবর পান। তিনি এরপর সিরিয়ান সেনাদেরকে প্রস্তুত করেন। এদিকে সুলুক খুলমে হামলা চালান। কিন্তু তার হামলা প্রতিহত করার পর তিনি পেরোজ বাখশিনের[ক] দিকে যাত্রা করেন। তুরগেশরা বলখকে এড়িয়ে অগ্রসর হয় এবং জুজজানের রাজধানী অবরোধ করে।[খ] এরপর অশ্বারোহীদেরকে বিভিন্ন দিকে পাঠানো হয়। তাদের মধ্যে কেউ কেউ মার্ভ‌ আল-রুদ পর্যন্ত অগ্রসর হয়। শীতকালে টিকে থাকার জন্য রসদ সংগ্রহের জন্য তাদের প্রেরণ করা হয়েছিল এমন হতে পারে। অবরোধের মুখে জুজজানের শাসক আসাদের পক্ষাবলম্বন করেন।[২০][২১]

এরপর দুইপক্ষের মধ্যে সংঘটিত লড়াইয়ে তুরগেশরা সুবিধা অর্জন করলেও পেছন দিক থেকে আসা একটি আক্রমণের পর তুরগেশ ও তাদের মিত্ররা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। আরবরা যুদ্ধ থেকে প্রচুর সম্পদ অর্জন করেছিল। তাদের হাতে প্রতিপক্ষের অনেকে বন্দী হয়। সুলুক পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।[২২][২৩]

আসাদ যুদ্ধলব্ধ সম্পদ সৈনিকদের মধ্যে বিতরণ করে দেন। যুদ্ধক্ষেত্রে পাঁচদিন অবস্থান করার পর তিনি বলখে ফিরে আসেন। এখান থেকে তিনি সুলুকের সন্ধানে জাজা অভিমুখে যাত্রা করেন। আরবরা পিছু নেয়ার আগে সুলুক পালিয়ে গিয়েছিলেন। এদিকে বৃষ্টি ও তুষারপাতের কারণে আরবদের অগ্রসর হওয়ায় বিপত্তি দেখা দেয়। এই সুযোগে সুলুক ও ইবনে সুরাইজ উচ্চ তুখারিস্তানে পালিয়ে যান। খোরাসানের অবশিষ্ট তুরগেশরা আসাদের কাছে পরাজিত হয়। অল্প কিছু সোগদিয়ান আমুদরিয়া পার হতে সক্ষম হয়।[২২][২৪]

পরবর্তী অবস্থা সম্পাদনা

খারিস্তানের বিজয়ের ফলে খোরাসানে উমাইয়াদের অবস্থান মজবুত হয়েছিল। পরবর্তীকালের অন্তর্দ্ব‌ন্দ্বে তুরগেশ খাগানাত ধ্বংস হয়ে যায়। খারিস্তানের যুদ্ধকে মধ্য এশিয়ায় আরবদের অবস্থানের মোড় পরিবর্তনকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।[২৫][২৬][২৭] আসাদের উত্তরসূরি নাসের ইবনে সাইয়ারের নেতৃত্বে মুসলিমরা মাওয়ারাননহরের অধিকাংশ এলাকা পুনরুদ্ধার করে। ৭৫১ সালে সংঘটিত তালাসের যুদ্ধ এবং আন শি বিদ্রোহের ফলে এই অঞ্চলে মুসলিমদের নিয়ন্ত্রণ সুরক্ষিত হয়।[২৮][২৯]

টীকা সম্পাদনা

  1. প্রকৃত উচ্চারণ অজ্ঞাত[১৭]
  2. বিভিন্ন মুসলিম সূত্রে জুজজানের রাজধানীর নাম আনবার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে[১৮][১৯]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Blankinship 1994, পৃ. 19, 29–30।
  2. Blankinship 1994, পৃ. 109–110।
  3. Blankinship 1994, পৃ. 125–128।
  4. Gibb 1923, পৃ. 61–70।
  5. Blankinship 1994, পৃ. 155–161।
  6. Gibb 1923, পৃ. 72–76, 79।
  7. Blankinship 1994, পৃ. 176–180।
  8. Gibb 1923, পৃ. 76–78।
  9. Blankinship 1994, পৃ. 180।
  10. Blankinship 1989, পৃ. 131–135।
  11. Gibb 1923, পৃ. 82।
  12. Blankinship 1989, পৃ. 135–139।
  13. Blankinship 1994, পৃ. 180–181।
  14. Gibb 1923, পৃ. 82–83।
  15. Blankinship 1994, পৃ. 181।
  16. Gibb 1923, পৃ. 83।
  17. Blankinship 1989, পৃ. 140 (note 503)।
  18. Blankinship 1989, পৃ. 143 (note 514)।
  19. Hartmann 1991, পৃ. 608।
  20. Blankinship 1994, পৃ. 181–182।
  21. Gibb 1923, পৃ. 83–84।
  22. Gibb 1923, পৃ. 84।
  23. Blankinship 1989, পৃ. 145–146।
  24. Blankinship 1989, পৃ. 146–147।
  25. Blankinship 1994, পৃ. 182।
  26. Gibb 1923, পৃ. 84–85।
  27. Hawting 2000, পৃ. 87–88।
  28. Blankinship 1994, পৃ. 182–185।
  29. Gibb 1923, পৃ. 88–98।

উৎস সম্পাদনা