খাড়ি গ্রাম হল পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার অন্তর্ভুক্ত একটি পুরাতাত্ত্বিক স্থান। উত্তর-পশ্চিম সুন্দরবনের অন্তর্গত এই গ্রামটি হিন্দুযুগের প্রাচীন ঐতিহাসিক স্থান 'খাড়ি-মণ্ডল' বা 'খাড়ি বিষয়'-এর ভৌগোলিক স্মৃতি আজও বহন করে চলেছে। এই অঞ্চলের নিকট দিয়েই প্রাচীন ভাগীরথী বা 'আদিগঙ্গা' অজস্র সংকীর্ণ ধারায় প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিলিত হত৷ প্রাচীন ভাগীরথীর পশ্চিমতীর ছিল 'পশ্চিমখাড়ি' (এর অন্তর্ভুক্ত ছিল বর্তমান হাওড়া জেলার 'বেতড়') এবং পূর্বতীর ছিল 'পূর্বখাড়ি' (বর্তমান খাড়ি গ্রাম)। এই পূর্বখাড়ি ছিল পাল ও সেনযুগের পৌণ্ড্রবর্ধনভুক্তির অধীনে। 'ডাকার্ণব' গ্রন্থে খাড়িকে চৌষট্টি শক্তিপীঠের অন্যতম বলে উল্লেখ করা হয়েছে।[]

পুরাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য

সম্পাদনা

সাবেক চব্বিশ পরগনা অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত সেনরাজা বিজয়সেনলক্ষ্মণসেন-এর দুটি তাম্রপট্টলিপিতে খাড়িকে একটি 'বিষয়' (বিজয়সেনের বারাকপুরলিপি) এবং 'মণ্ডল' (লক্ষণসেনের সুন্দরবনলিপি) বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই 'বিষয়' বা 'মণ্ডল' অনেকটা আধুনিক 'মহকুমা'র মত ছিল বলে অনুমিত হয়।
লক্ষ্মণসেনের সুন্দরবনলিপি থেকে জানা যায়, দ্বাদশ শতকের শেষে (১১৯৬ খ্রিষ্টাব্দ) অযোধ্যা থেকে আগত পালবংশের 'মহারাজাধিরাজ' উপাধিধারী শ্রীমদ্ ডোম্মনপাল নামে এক সামন্ত রাজা 'পূর্বখাড়ি'তে (বর্তমান খাড়ি গ্রাম) স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করেন।
লক্ষ্মণসেনের রাজত্বের শেষদিকে তার অধীন সামন্তরাজারা বিদ্রোহ ঘোষণা করে স্বাধীনতা করায় কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা শিথিল হয়ে পড়ছিল। এখানকার জাতিভেদ-বর্ণপ্রথা জর্জরিত পৌণ্ড্রক্ষত্রিয়মাহিষ্যপ্রধান হিন্দুসমাজ শ্রীমদ্ ডোম্মনপালের নেতৃত্বে সামাজিক বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেছিল বলে অনুমান করা হয়।[]

ঐতিহাসিক নিদর্শন

সম্পাদনা

খাড়ি গ্রামের নারায়ণীতলায় একটি সাধারণ ইটের ঘরে শক্তিমূর্তি 'নারায়ণী'র অধিষ্ঠান; মূর্তিটি চতুর্ভূজা, ত্রিনয়না ও সিংহবাহিনী। ষোড়শ-সপ্তদশ শতাব্দীতেই এই ধরনের তান্ত্রিক পীঠস্থানের উৎপত্তি বলে মনে করা হয়।[] নারায়ণী মূর্তির পাশেই ঘোড়ার পিঠে আসীন ধর্মযোদ্ধা গাজীসাহেবের (পীর বড়খাঁ গাজী) মূর্তি অবস্থিত। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে গাজীসাহেবের পূজারী ভক্ত বিদ্যমান। সেনরাজত্বকালের শেষে এখানকার জাতিভেদ-বর্ণপ্রথা জর্জরিত নিম্নবর্গীয় হিন্দুসমাজের মুসলমান পীর-গাজী সাহেবদের থেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের স্পষ্ট আভাস মেলে। ইংরেজ আমলে পাদরী সাহেবদেরও খ্রিস্টধর্ম প্রচারের অন্যতম ক্ষেত্র ছিল এটি৷ ১৮৫৭ সালেই খাড়ি গ্রামে একটি গির্জা, একটি ইংরেজি স্কুল এবং বহু বাঙালি খ্রিস্টানের (ধর্মান্তরিত) বিবরণ পাওয়া যায়।[] সমাজ ও সংস্কৃতির বিভিন্ন সময়ের স্তর আজও খাড়ি গ্রামে সুবিন্যস্ত।[]

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. ঘোষ, বিনয়, "পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি", তৃতীয় খন্ড, প্রথম সংস্করণ, প্রকাশ ভবন, পৃষ্ঠা: ২৬১-২৬৪
  2. The Sakta Pithas: Dr. D.C. Sirkar: J.A.S.B. Letters, Vol. 14, Ne 1948
  3. Hunter: Statistical Account of Bengal, Vol. 1, page-235