কেনিয়ার ইতিহাস

ইতিহাসের বিভিন্ন দিক

পূর্ব আফ্রিকাতে পাওয়া ফসিল পর্যবেক্ষণ করে জানা গেছে আদি মানুষেরা এই এলাকাতে ২০ লক্ষ বছর আগে চরে বেরাত। কেনিয়ার তুর্কানা হ্রদের কাছে প্রাপ্ত সাম্প্রতিক নিদর্শন অনুযায়ী ধারণা করা হয় ২৬ লক্ষ বছর আগেও এখানে হোমিনিডরা বাস করত।

২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে বর্তমান সুদান ও ইথিওপিয়া অঞ্চল থেকে কুশিটীয় ভাষাভাষী লোকেরা বর্তমান কেনিয়া অঞ্চলে অভিবাসন শুরু করে। খ্রিস্টীয় ১ম শতকে আরব বণিকেরা কেনিয়ার উপকূলে যাতায়ার শুরু করে। আরব উপদ্বীপের খুব কাছেই অবস্থিত হওয়ায় ৮ম শতাব্দী নাগাদ কেনিয়ার উপকূলে অনেক আরব ও পারসিক লোকালয় গড়ে ওঠে। খ্রিস্টীয় ১০০০ সালের দিকে নাইলোটীয় ও বান্টু ভাষাভাষী লোকেরা অঞ্চলটিতে অভিবাসন আরম্ভ করে। বর্তমানে কেনিয়ার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ লোক বান্টু গোত্রভুক্ত। বান্টু ভাষার সাথে আরবি শব্দভাণ্ডার মিলে উদ্ভূত সোয়াহিলি নামের একটি ভাষা বর্তমানে কেনিয়া ও তার আশেপাশের অঞ্চলে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রধানতম ভাষা।

১৪৯৮ সালে পর্তুগিজদের আগমনের সাথে কেনিয়ার উপকূলে আরব আধিপত্যের অবসান ঘটে এবং প্রায় ১৫০ বছর ধরে পর্তুগিজরা এখানে আধিপত্য বজায় রাখে।

১৯১১ সালের মানচিত্র

১৯শ শতকের মধ্যভাগে পূর্ব আফ্রিকাতে ব্রিটিশরা অভিযান চালায় এবং ১৮৯৫ সালে কেনিয়া একটি ব্রিটিশ-রক্ষিত রাষ্ট্রে বা প্রোটেক্টোরেটে পরিণত হয়। এর নাম ছিল ব্রিটিশ ইস্ট আফ্রিকা। এই পর্বে কেনিয়ার অভ্যন্তরের উর্বর উচ্চভূমিগুলিতে ইউরোপীয়রা বসতি স্থাপন শুরু করে এবং সেখানকার আদিবাসী কিকুয়ু ও অন্যান্য জাতির লোকদের বাসস্থান থেকে উৎখাত করে।

রিফ্‌ট উপত্যকার কিছু উর্বর ও ভাল সেচ ব্যবস্থাসমৃদ্ধ এলাকাতে মাসাই জাতির লোকেরা বাস করত। পশ্চিমের উচ্চভূমিগুলিতে বাস করত কালেনজিন জাতির লোকেরা। এগুলিও ইউরোপীয় বসতিস্থাপকদের দিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু কেনিয়ার উত্তরের ঊষর অর্ধের ব্যাপারে ব্রিটিশরা তেমন আগ্রহী ছিল না। ১৯২০ সালে কেনিয়া সরকারিভাবে একটি ব্রিটিশ উপনিবেশে পরিণত হয়। তবে তার আগেই ইউরোপীয় বসতিস্থাপকেরা কেনিয়ার সরকার ব্যবস্থার যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণে ছিলেন। ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত আফ্রিকানদেরকে সরাসরি রাজনৈতিক অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়নি। সে বছর হাতে গোনা কয়েকজন আফ্রিকান প্রতিনিধিকে আইনসভাতে বসতে দেওয়া হয়।

১৯৫২ সাল থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত কেনিয়াতে জরুরি অবস্থা বিরাজ করছিল। সে সময় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে, বিশেষ করে এর ভূমি নীতিগুলির বিরুদ্ধে "মাউ মাউ" আন্দোলন সংঘটিত হয়। এটিতে মূলত মধ্য কেনিয়ার কিকুয়ু জাতির লোকেরা অংশ নিয়েছিল। এই বিদ্রোহে বহু হাজার কিকুয়ু যুদ্ধে বা বন্দীশিবিরে বা অবরোধকৃত গ্রামে মারা যায়। প্রায় ৬৫০ ব্রিটিশ সেনাও এতে নিহত হয়। এই সময় কেনিয়ার রাজনৈতিক প্রক্রিয়াতে আফ্রিকানদের অংশগ্রহণ দ্রুত বৃদ্ধি পায়।

১৯৫৭ সালে আইনপ্রনয়ণ কাউন্সিলে প্রথমবারের মত আফ্রিকান প্রতিনিধিরা সরাসরি নির্বাচিত হয়ে আসেন। ১৯৬৩ সালের ১২ই ডিসেম্বর কেনিয়া স্বাধীনতা লাভ করে এবং এর পরের বছর কমনওয়েলথে যোগ দেয়। জাতিগতভাবে কিকুয়ু এবং কেনীয় আফ্রিকান জাতীয় ইউনিয়ন দলের প্রধান কোমো কেনিয়াতা কেনিয়ার প্রথম রাষ্ট্রপতি হন। সংখ্যালঘু দলটির নাম ছিল কেনিয়া আফ্রিকান গণতান্ত্রিক ইউনিয়ন; এটি ছিল ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলির একটি কোয়ালিশন। ১৯৬৪ সালে এটি বিলুপ্ত হয়ে কেনীয় আফ্রিকান জাতীয় ইউনিয়ন দলের সাথে মিশে যায়।

১৯৬৬ সালে কেনিয়া পিপলস ইউনিয়ন নামে একটি ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বামপন্থী বিরোধী দলের আবির্ভাব ঘটে। প্রাক্তন উপ-রাষ্ট্রপতি ও বর্ষীয়ান লুও নেতা জারামোগি ওগিংগা ওদিংগা ছিলেন এর নেতা। তবে কিছুদিন পরেই এটিকে নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৭৮ সালের আগস্টে রাষ্ট্রপতি কেনিয়াতার মৃত্যুর পর উপরাষ্ট্রপতি ড্যানিয়েল আরাপ মোই, যিনি ছিলেন রিফট উপত্যকা প্রদেশের কালেনজিন জাতির একজন নেতা, অন্তর্বর্তীকালীন রাষ্ট্রপতি হন। ১৯৭৮ সালের অক্টোবরে তিনি কেনীয় আফ্রিকান জাতীয় ইউনিয়ন দলের প্রধান নির্বাচিত হন এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের একমাত্র প্রার্থী হিসেবে সরকারিভাবে কেনিয়ার রাষ্ট্রপতিতে পরিণত হন।

১৯৮২ সালের জুন মাসে কেনিয়ার জাতীয় সংসদ সংবিধান সংশোধন করে এবং কেনিয়াকে সরকারিভাবে একটি একদলীয় শাসনে পরিণত করে। দুই মাস পরে তরুণ সামরিক অফিসারেরা কিছু বিরোধী শক্তির সাথে মিলে সরকার পতনের একটি রক্তক্ষয়ী প্রচেষ্টা চালায়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। রাস্তায় প্রতিবাদ ও দাতারাষ্ট্রগুলির চাপের মুখে কেনিয়া ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে একদলীয় শাসন উঠিয়ে নেয় এবং ১৯৯২ সালে কেনিয়াতে প্রথমবারের মত বহুদলীয় সংসদীয় নির্বাচন হয়। বিরোধী দলগুলির অন্তর্কোন্দলের সুযোগে মোই ১৯৯২ সালে এবং আবারও ১৯৯৭ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। তবে ১৯৯৭ সালে কেনীয় আফ্রিকান জাতীয় ইউনিয়ন এককভাবে সরকার গঠন করতে পারেনি, একটি কোয়ালিশনের মাধ্যমে তাদেরকে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে হয়।

২০০২ সালের অক্টোবর মাসে বিরোধী দলগুলি ন্যাশনাল রেইনবো কোয়ালিশন নামের একটি জোট গঠন করে এবং ২০০২ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে এই জোটটি বিজয়ী হয়। জোটের নেতা মোয়াই কিবাকি ৬২% ভোট পেয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন এবং জোট আইনসভার ৫৯% আসন পায়। মোয়াই কিবাকি ছিলেন কনেদ্রীয় প্রদেশের কিকুয়ু জাতির লোক। তিনি কেনিয়েতা এবং মোই সরকারে বিভিন্ন উচ্চপদে, যেমন উপরাষ্ট্রপতি এবং অর্থমন্ত্রী পদে আসীন ছিলেন। ২০০৩ সালে ক্ষমতাসীন জোটে কোন্দল দেখা দেয় এবং ২০০৫ সালের সংবিধান সংশোধনের উপর একটি গণভোটের সময় এই কোন্দল প্রকাশ্য রূপ ধারণ করে। সরকারে কয়েকজন প্রধান প্রধান মন্ত্রী এই সংশোধনের বিরোধিতা করেন এবং সংশোধনীটি পাশ হয়নি।

২০০৭ সালের ডিসেম্বরে কেনিয়াতে আবারও রাষ্ট্রপতি, সংসদ ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। মোয়াই কিবাকি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলেও পর্যবেক্ষকদের কাছে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনটি অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ বিবেচিত হয়। বিরোধী দলীয় লোকেরা নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে এবং দেশজুড়ে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় ১ হাজার কেনীয় মারা যায় এবং ৬ লক্ষ কেনীয় গৃহহীন উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়। জাতিসংঘ এই সংকট মেটাতে এগিয়ে আসে এবং ২০০৮ সালে ফেব্রুয়ারিতে কিবাকি ও বিরোধীদলীয় নেতা ওদিংগা ক্ষমতা অংশীদারির ব্যাপারে চুক্তিতে আসেন। এ লক্ষ্যে ২০০৮ সালের মার্চে সংবিধান সংশোধন করা হয়। এপ্রিল মাসে ওদিংগা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। বর্তমানে দীর্ঘমেয়াদী সংস্কারের বিভিন্ন ইস্যু, সাংবিধানিক সংস্কার, ভূমিনীতি সংস্কার, বিচারবিভাগীয় সংস্কার, দারিদ্র‌্য মোচন ও আর্থসামাজিক বৈষম্যের উপর আলোচনা অব্যাহত আছে।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা