কুন্দুজ মাদ্রাসা হামলা

কুন্দুজ মাদ্রাসা হামলা ছিল কুন্দুজের দস্ত-ই-আরচি জেলার আখুন্দজাদা গোজোর মাদ্রাসায় আফগান বিমান বাহিনী কর্তৃক চালানো একটি বিমান হামলা, যেখানে ৩০ জন শিশুসহ ৩৬ জন বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করে হয়। বিমান হামলার লক্ষ্য ছিল মাদ্রাসার ধর্মীয় সমাবেশ। মাদ্রাসাটিতে একটি স্নাতক সমাপনী অনুষ্ঠান হচ্ছিল এবং বিমান হামলার সময় শত শত লোক অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিল।[৩][৪]

কুন্দুজ মাদ্রাসা হামলা
আফগানিস্তান যুদ্ধ (২০০১–২০২১)-এর অংশ
আফগানিস্তানের কুন্দুজ
স্থানকুন্দুজ
তারিখ২ এপ্রিল ২০১৮
হামলার ধরনবিমান হামলা
নিহত৩৬ জন নিরস্ত্র নাগরিকের মৃত্যু (জাতিসংঘ এর হিসাব মতে)[১][২]
আহত
  • ৭১+ নিরস্ত্র নাগরিক আহত (জাতিসংঘের হিসাবে)[১][২]
হামলাকারী দলআফগানিস্তান আফগানিস্তান বিমানবাহিনী

প্রাথমিকভাবে, আফগান সরকার দাবি করেছিল যে, বিমান হামলায় বহু তালেবান নিহত হয়েছে। তারা হামলায় বেসামরিক মানুষের হতাহতের ঘটনাও অস্বীকার করে। কিন্তু পরবর্তীকালে আফগান সরকার স্বীকার করে যে বিমান হামলায় বেসামরিক মানুষও মারা গেছে।[৫] দাস-ই-আরচির স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন যে, মাদ্রাসায় কোনো তালেবানের উপস্থিতি ছিল না। [৬] তারা আরো বলেন যে, শুধুমাত্র শিশু এবং বেসামরিক লোকদের লক্ষ্য করেই বিমান হামলাটি চালানো হয়েছিল এবং হতাহতদের মধ্যে কোন তালিবান ছিল না।[৭]

আফগানিস্তানে জাতিসংঘের সহায়তা মিশন (ইউএনএএমএ) এর রিপোর্ট অনুযায়ী, হামলায় প্রায় ৩৬ জন (৩০ শিশু এবং ৬ প্রাপ্তবয়স্ক) নিহত এবং ৭১ জন (৫১ শিশু এবং ২০ জন প্রাপ্তবয়স্ক) আহত হয়। ইউএনএএমএ আরো বলে যে, এই সংখ্যা আরো বেশি হতে পারে কারণ তারা কেবলমাত্র তিনটি স্বাধীন সূত্র দ্বারা নিশ্চিত করে হতাহতের সংখ্যা প্রকাশ করেছে। এছাড়া আফগান কর্মকর্তারা যে দাবি করেছিলো 'বিমান হামলার লক্ষ্য ছিল শুধুমাত্র তালেবান', এরও বিরোধিতা করে ইউএনএএমএ।[১]

আফগানিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি বিমান হামলায় নিহতদের জন্য ক্ষমা চান।[৮] অবশ্য, বিমান হামলায় জড়িত অপরাধীদের কেউই শাস্তি পায়নি।

বিমান হামলা সম্পাদনা

আফগানিস্তানে জাতিসংঘের সহায়তা মিশন (ইউএনএএমএ) তাদের প্রতিবেদনে বলে যে, আফগান বিমান বাহিনী একটি ধর্মীয় সমাবেশে রকেট এবং ভারী মেশিনগানের গুলি ব্যবহার করেছিল। আর এজন্যই শিশুদের হতাহতের সংখ্যা এতো বেশি ছিল।[৯] ইউএনএএমএ নিশ্চিত করেছে যে, অনুষ্ঠানটি মোটেও গোপনীয় ছিলো না, বরং অনুষ্ঠানটি ব্যাপকভাবে প্রচার করে হয়ছিল এবং এলাকাটি লাঘমনি গ্রাম নামে পরিচিত ছিল। অনুষ্ঠানের বিজ্ঞাপনের জন্য প্রায় ৪০০ টি পোস্টার ব্যবহার করা হয়েছিল এবং সারা দেশ থেকে বিশেষ অতিথিরা এই অনুষ্ঠানে আসার কথা ছিলো। ইউএনএএমএ দ্বারা সাক্ষাৎকারে ভুক্তভোগী এবং প্রত্যক্ষদর্শীরা ধারাবাহিকভাবে ঘটনার বর্ণনা এভাবে করেছে যে, প্রথমে MD-530F হেলিকপ্টারটি এসে ভিড়ের মধ্যে রকেট ছুড়ে মারছিলো, যা সবার আগে অনুষ্ঠানের পিছনে বসে থাকা শিশুদের আঘাত করে। প্রথম রকেট জনতার উপর আঘাত হানার পর মানুষ কাছাকাছি রাস্তা এবং বাড়ির দিকে পালাতে থাকে, পালাতে থাকা ব্যক্তিদের পথ উদ্দেশ্য করে হেলিকপ্টার রকেট ছুড়তে থাকে এবং মেশিনগান গুলি চালাতে থাকে।[৯]

বিমান হামলায় ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসা করা ডাক্তাররা জানিয়েছিন যে, "টুকরো টুকরো বোমা ও শ্রাপ্নেল দ্বারা আক্রান্তরা আঘাতপ্রাপ্ত হয়"।[১০][১১]

ঘটনা-পরবর্তী সম্পাদনা

২০১৪ সালের ৪ এপ্রিল, দস্ত-ই-আরচি থেকে শত শত বাসিন্দা আফগান বিমান বাহিনীর এই বিমান হামলার প্রতিবাদে কুন্দুজ শহরে মার্চ করে। বিক্ষোভকারীরা হুমকি দিয় যে, সরকার যদি বিমান হামলার তদন্ত না করে, তাহলে দস্ত-ই-আরচির সমস্ত বাসিন্দা তালেবানদের সাথে যোগ দেবে এবং ইসলামী আমিরাত অব তালেবানকে সমর্থন জানাবে।[১২][১৩]

আফগানিস্তানের বিশিষ্ট নাগরিকরা আফগান সরকার কর্তৃক আফগান শিশুদের হত্যাকে সমর্থন দেয়। আফগানিস্তান এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলি থেকে যারাই সরকারি বিবরণকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল কিংবা বলেছিলো এই হামলায় বেসামরিক মানুষ মারা গেছে, সেসব ব্যাক্তিদের তারা নগ্ন সমালোচনা করেছিল। এই অ্যাকাউন্টগুলির মধ্যে ছিল কিছু আফগান সরকারের সাবেক কর্মকর্তা, অন্যরা আফগান সাংবাদিক, এবং বাকিরা বেনামী।[১৪]

প্রতিক্রিয়া সম্পাদনা

পাকিস্তানে তৎকালীন আফগান রাষ্ট্রদূত ওমর জাখিলওয়াল বিমান হামলার নিন্দা জানান। তিনি বলেন, মাদ্রাসায় বিমান হামলা হয়েছে এবং এতে অনেক বেসামরিক নাগরিক ও শিশু নিহত হয়েছে।[৩]

আফগানিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইও এই হামলার নিন্দা জানান। তিনি বলেন, "সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নামে আমাদের বাড়ি, হাসপাতাল এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে এমন অভিযান সকল নীতির পরিপন্থী।"[৩]

আফগানিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি বিমান হামলায় নিহতদের কাছে ক্ষমা চান। যদিও, মাদ্রাসায় বিমান হামলার ৪৪ দিন পর আফগান সরকার ক্ষমা চায়। তিনি দাবি করেন যে "সরকার এবং বিদ্রোহীদের মধ্যে প্রধান পার্থক্য হল যে, একটি বৈধ সরকার সবসময় ভুলের জন্য ক্ষমা চাইবে"।[৮] অবশ্য, তার এই ক্ষমাকে অনেকেই সমালোচনা করেছিল।[১৪]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "Afghan Airstrike Said to Target Taliban Mostly Killed Children, U.N. Finds"New York Times। ৮ মে ২০১৮। 
  2. "UN Afghanistan investigation concludes at least 36 children killed in Kunduz madrassa air raid"The Defense Post। ৭ মে ২০১৮। 
  3. "Afghan air force faces criticism after reports that airstrike killed civilians"Washington Post। ৩ এপ্রিল ২০১৮। 
  4. "আফগানিস্তানে মাদ্রাসায় বিমান হামলায় নিহত ৩০"যুগান্তর। ৩ এপ্রিল ২০১৮। সংগ্রহের তারিখ ২৪ এপ্রিল ২০২১ 
  5. "Afghan Leaders Admit Civilians Were Killed in Anti-Taliban Bombing"New York Times। ৩ এপ্রিল ২০১৮। 
  6. "Carnage as airstrike hits boy's school in Taliban territory"CBS News। ৩ এপ্রিল ২০১৮। 
  7. "Afghan Government Airstrikes Kill At Least 70 at Kunduz Mosque"Democracy Now। ৩ এপ্রিল ২০১৮। 
  8. "Afghan president Ghani apologizes for Kunduz airstrike that killed 30 children"The Defense Post। ১৬ মে ২০১৮। 
  9. "UN Afghanistan investigation concludes at least 36 children killed in Kunduz madrassa air raid"The Defense Post। ৭ মে ২০১৮। 
  10. "Afghan forces killed 36 at religious ceremony, says UN"TRT world। ৭ মে ২০১৮। 
  11. "UN: Afghan gunships killed, injured 107 in madrasa attack last month"Dhaka Tribune। ৮ মে ২০১৮। 
  12. "Hundreds of residents from Dasht-e-Archi protest against the airstrike"Ariana News। ৪ এপ্রিল ২০১৮। 
  13. "Demonstration in Northern Afghanistan against the airstrike"Tasnim News (ফার্সি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ১০ এপ্রিল ২০১৮ 
  14. "A Weak Apology After Afghan Airstrike Killed 30 Children"New York Times। ২৩ মে ২০১৮।