কিতাসাতো শিবাসাবুরো

জাপানি চিকিৎসক ও ব্যাকটেরিয়া বিজ্ঞানী যিনি ধনুষ্টংকার ও ডিপথেরিয়া রোগের জীবাণু ও প্রতিরোধক

কিতাসাতো শিবাসাবুরো (জাপানি: 北里 柴三郎; ১৮৫২-১৯৩১) একজন জাপানি চিকিৎসক ও ব্যাকটেরিয়া বিজ্ঞানী ছিলেন। তিনি ধনুষ্টংকারডিপথেরিয়া রোগ প্রতিরোধ করার পদ্ধতি উদ্ভাবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এছাড়া তিনি ফরাসি-সুইজারল্যান্ডীয় ব্যাকটেরিয়া বিজ্ঞানী আলেক্‌সঁদ্র ইয়েরসাঁ-র সাথে প্রায় একই সময়ে বিউবনিক প্লেগ রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুটি (ব্যাকটেরিয়াটি) আবিষ্কার করেন। কিতাসাতো ১৮৫৩ সালের ২৯শে জানুয়ারি তারিখে জাপানের হিগো প্রদেশের কিতানোসাতো (বর্তমান কুমামোতো) জেলাতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি প্রথমে ইগাকুশো হাসাপাতালে (বর্তমান কুমামোতো চিকিৎসা বিদ্যালয়) চিকিৎসাবিজ্ঞানে পড়াশোনা শুরু করেন। যখন তাঁর গুরু ওলন্দাজ চিকিৎসক ফান মান্‌সফেল্ট বিদ্যালয়টি ত্যাগ করেন, তখন কিতাসাতো টোকিও চিকিৎসাবিজ্ঞান বিদ্যালয়ে (বর্তমানে টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশ) ছাত্র হিসেবে যোগ দেন। ১৮৮৩ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর উপাধি (এম ডি) অর্জনের পরে তিনি জাপানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য দফতরে ব্যাকটেরিয়া বিজ্ঞান সম্পর্কিত গবেষণাকর্ম সম্পাদন করেন।

কিতাসাতো শিবাসাবুরো
কিতাসাতো শিবাসাবুরো
জন্ম(১৮৫৩-০১-২৯)২৯ জানুয়ারি ১৮৫৩
মৃত্যু১৩ জুন ১৯৩১(1931-06-13) (বয়স ৭৮)
টোকিও, জাপান
জাতীয়তাজাপান
পরিচিতির কারণধনুষ্টংকারডিপথেরিয়ার জীবাণু আবিষ্কার ও প্রতিরোধক উদ্ভাবন, বিউবনিক প্লেগ রোগের জীবাণু আবিষ্কার
বৈজ্ঞানিক কর্মজীবন
কর্মক্ষেত্রব্যাকটেরিয়া বিজ্ঞানী
প্রতিষ্ঠানসমূহটোকিও সাম্রাজ্যিক বিশ্ববিদ্যালয়
যাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেনরোবের্ট কখ

১৮৮৫ সালে কিতাসাতো জার্মান ব্যাকটেরিয়া বিজ্ঞানী রোবের্ট কখের গবেষণাগারে যোগ দেওয়ার জন্য বার্লিন শহরে গমন করেন। সেখানে ১৮৯১ সাল পর্যন্ত তিনি কখের অধীনে এবং এমিল ফন বেরিংয়ের সহযোগী হিসেবে ধনুষ্টংকার ও ডিপথেরিয়া রোগসৃষ্টিকারী ব্যাসিলাস ব্যাকটেরিয়াগুলির উপরে গবেষণাকর্ম সম্পাদন করেন। ব্যাকটেরিয়াগুলি বংশবিস্তার করে বিষাক্ত পদার্থ নিঃসরণ করত, যার ফলে রোগের বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দিত। ১৮৮৯ সালে তিনিই প্রথম ব্যক্তি হিসেবে ধনুষ্টংকার সৃষ্টিকারী টিটেনাস ব্যাসিলাস নামক ব্যাকটেরিয়ার একটি বিশুদ্ধ ফলন (Pure culture) সৃষ্টি করতে সক্ষম হন। বেরিংয়ের সাথে একত্রে মিলে তিনি রোগ প্রতিরোধে বিষক্রিয়ারোধকের (Antitoxin) গুরুত্ব ব্যাখ্যা করেন। তারা প্রমাণ করেন যে ব্যাকটেরিয়াঘটিত বিষের বিরুদ্ধে কোনও আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তে যে বিষক্রিয়ারোধকের সৃষ্টি হয়, সেই বিষক্রিয়ারোধক বহনকারী রক্তরস বা সিরাম (Serum) যদি একজন অনাক্রান্ত ব্যক্তির দেহে সূচিপ্রয়োগের মাধ্যমে প্রবিষ্ট করানো যায়, তাহলে ধনুষ্টংকারের বিরুদ্ধে অনাক্রম্যতা অর্জন করা সম্ভব। ১৮৯০ সালে কিতাসাতো ও ফন বেরিং ডিপথেরিয়া রোগের জন্যও একই পদ্ধতিতে (রক্তরস চিকিৎসা বা "সিরাম থেরাপি") সফলভাবে একটি কার্যকরী বিষক্রিয়ারোধক প্রস্তুত করেন। ১৯০১ সালের চিকিৎসাবিজ্ঞানে সর্বপ্রথম নোবেল পুরস্কারের জন্য কিতাসাতো ও ফন বেরিং উভয়কেই মনোনীত করা হলেও ফন বেরিং পুরস্কারটি জিতে নেন, কিতাসাতোকে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়নি।[১] সব মিলিয়ে কিতাসাতো তিনটি গুরুত্বপূর্ণ রোগসৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া আলাদা করতে সফল হন; এগুলি হল ধনুষ্টংকার (১৮৮৯), অ্যানথ্রাক্স (১৮৮৯) এবং আমাশয় (১৮৯৮)।

১৮৯২ সালে জাপানে ফিরে আসার পরে কিতাসাতো টোকিও নগরীর কাছে "সংক্রামক রোগসমূহের উচ্চতর গবেষণা কেন্দ্র" নামের একটি পরীক্ষাগার প্রতিষ্ঠা করেন ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে সেটির পরিচালনা শুরু করেন। পরবর্তীতে ১৮৯৯ সালে এটিকে জাপান সাম্রাজ্যের সংক্রামক রোগব্যাধির উচ্চতর গবেষণা কেন্দ্রের অঙ্গীভূত করে নেওয়া হয়। সেখানে তিনি তাঁর সহযোগীদেরকে দেখান কীভাবে মৃত ফলনকে টীকা তৈরিতে ব্যবহার করা যায়। এছাড়া তিনি যক্ষ্মা রোগের সংক্রমণের কর্মপদ্ধতি নিয়েও গবেষণা করেন। ১৯০০ সালে কিতাসাতো যক্ষ্মারোগীদের জন্য ইয়োজোয়েন নামের একটি স্বাস্থ্যোদ্ধার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেটিরও ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। এছাড়া তিনি টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়, কেইও বিশ্ববিদ্যালয় ও জাপান সাম্রাজ্যের উচ্চতর গবেষণা কেন্দ্রে বিভিন্ন উচ্চশিক্ষায়তনিক, গবেষণা-সংক্রান্ত ও প্রশাসনিক পদে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি কেইও বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাবিজ্ঞান বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম মহাধ্যক্ষ (ডিন) ছিলেন (১৯১৭ থেকে ১৯২৮ পর্যন্ত)। ১৯১৪ সালে তিনি জাপান সাম্রাজ্যের উচ্চতর গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে নিজস্ব গবেষণামূলক পরীক্ষাগার প্রতিষ্ঠা করেন, যার নাম ছিল কিতাসাতো উচ্চতর গবেষণা কেন্দ্র। ১৯২৩ সালে যখন জাপানি চিকিৎসক সংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়, তিনি সেটির প্রথম সভাপতি ছিলেন। ১৯২৪ সালে জাপানের সম্রাট তাকে ব্যারনের উপাধি প্রদান করেন।

১৮৯৪ সালে হংকংয়ে বিউবনিক প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাব ও মহামারী দেখা যাওয়ার পরে সেটির ব্যাপারে অনুসন্ধান করতে কিতাসাতোকে জাপান সরকার হংকংয়ে প্রেরণ করে। এর এক মাসের মধ্যে টোকিওতে গবেষণা চলাকালে তিনি বিউবনিক প্লেগ রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুটি আবিষ্কার করেন, যার নাম দেওয়া হয় ব্যাসিলাল পাস্টরেলা পেস্টিস। তবে একই সময়ে হংকংয়ে ফরাসি-সুইজারল্যান্ডীয় ব্যাকটেরিয়া বিজ্ঞানী আলেক্‌সঁদ্র ইয়েরসাঁ-ও (Alexandre Yersin) একই জীবাণু আবিষ্কার করেছিলেন; বর্তমানে তাই জীবাণুটিকে ইয়েরসাঁ-র নামানুসারে ইয়েরসিনিয়া পেস্টিস নামে ডাকা হয়।

কিতাসাতো ১৯৩১ সালের ১৩ই জুন তারিখে টোকিও নগরীতে মৃত্যুবরণ করেন।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা