কালো মথুরা

পাখির প্রজাতি

কালো মথুরা (বৈজ্ঞানিক নাম Lophura leucomelanos) (ইংরেজি: en:Kalij pheasant), কালা মথুরা, কালো ময়ূর বা শুধুই মথুরা Phasianidae (ফ্যাসিয়ানিডি) গোত্র বা পরিবারের অন্তর্গত Lophura (লোফুরা) গণের এক প্রজাতির পাখি।[১][২] কালো মথুরার বৈজ্ঞানিক নামের অর্থ চূড়াধারী পাকড়া ময়ূর (গ্রিক lopos =চূড়া, oura =লেজ, lenkos =সাদা ও melanos =কালো)।[২] প্রজাতিটি রূপালি মথুরার (Lophura nycthemera) সাথে একটি মহাপ্রজাতির সৃষ্টি করেছে। আই. ইউ. সি. এন. এই প্রজাতিটিকে Least Concern বা বিপদমুক্ত বলে ঘোষণা করেছে।[৩] বাংলাদেশে এরা বিপন্ন (Endangered) বলে বিবেচিত। বাংলাদেশের ১৯৭৪[২] ও ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনে এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত।[৪] চাকমা ভাষায় কালো মথুরার নাম সানগ্রু। আবার খাসিয়া, মারমাত্রিপুরা ভাষায় এর নাম যথাক্রমে খ্রুট, রই রাতাটকরু[৫]

মথুরা
Lophura leucomelanos
L. leucomelanos hamiltoni
পুরুষ (সামনে) ও স্ত্রী মথুরা (পেছনে), হাওয়াই
বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস
জগৎ: প্রাণীজগৎ
পর্ব: কর্ডাটা
শ্রেণী: পক্ষী
বর্গ: Galliformes
পরিবার: Phasianidae
উপপরিবার: Phasianinae
গণ: Lophura
প্রজাতি: L. leucomelanos
দ্বিপদী নাম
Lophura leucomelanos
(Latham, 1790)
প্রতিশব্দ

Phasianus leucomelanos (Latham, 1790)

বিস্তৃতি সম্পাদনা

কালো মথুরার মূল আবাস বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, চীন এবং থাইল্যান্ড। ১৯৬২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে এদের অবমুক্ত করা হয়েছে।[৩]

উপপ্রজাতি সম্পাদনা

কালো মথুরার মোট নয়টি উপপ্রজাতি শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে।[৬] এগুলো হল:

 
পুরুষ L. leucomelanos lathami, কাজিরাঙ্গা জাতীয় উদ্যান, ভারত
  • L. l. hamiltoni (J.E. Gray, 1829) – পশ্চিম হিমালয়
  • L. l. leucomelanos (Latham, 1790) – পশ্চিম ও পূর্ব-মধ্য নেপাল
  • L. l. melanota (Hutton, 1848)সিকিম ও পশ্চিম ভুটান
  • L. l. moffitti (Hachisuka, 1938) – মধ্য মিয়ানমার
  • L. l. lathami (J.E. Gray, 1829) – পূর্ব ভুটান, বাংলাদেশ ও উত্তর-পূর্ব ভারত হয়ে মিয়ানমার
  • L. l. williamsi (Oates, 1898) – পশ্চিম মিয়ানমার
  • L. l. oatesi (Ogilvie-Grant, 1893) – দক্ষিণ মিয়ানমার
  • L. l. crawfurdi (J.E. Gray, 1829) – দক্ষিণ-পূর্ব মিয়ানমার থেকে থাই উপদ্বীপ
  • L. l. lineata (Vigors, 1831) – দক্ষিণ মিয়ানমার থেকে উত্তর-পশ্চিম থাইল্যান্ড।
 
স্ত্রী কালো মথুরা, ভারত

oatesi, lineata and crawfurdi উপপ্রজাতিগুলো কালো মথুরার না রূপালি মথুরার সে বিষয়ে বিতর্ক রয়েছে। এই দু'টি প্রজাতি নিজেদের মধ্যে উর্বর সংকর জন্ম দিতে সক্ষম। তবে ইরাবতী নদী প্রজাতি দু'টির মধ্যে প্রাকৃতিক বাধা হিসেবে কাজ করে। সাধারণত ইরাবতী নদীর পশ্চিম পার্শ্বে কালো মথুরার আবাস আর পূর্ব পার্শ্বে রূপালি মথুরার। উল্লিখিত তিনটি উপপ্রজাতির আবাস ইরাবতী নদীর পূর্ব পাশে হওয়ায় এদের নামকরণ নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।[৬]

 
পুরুষ কালো মথুরা

বিবরণ সম্পাদনা

কালো মথুরা কালচে ভূচর পাখি। এদের দৈর্ঘ্য কমবেশি ৬২ সেন্টিমিটার, ডানা ২২ সেন্টিমিটার, ঠোঁট ৩.৫ সেন্টিমিটার, পা ৭.৫ সেন্টিমিটার, লেজ ২৩ সেন্টিমিটার ও ওজন ১.৩ কেজি।[২] স্ত্রী ও পুরুষ পাখির মধ্যে পার্থক্য বিস্তর। পুরুষ মথুরার পিঠ উজ্জ্বল নীল ও কালোয় মেশানো। কোমর ও পেছনের পালকের প্রান্ত সাদা। মাথার চূড়ার পালক খাড়া ও পেছনমুখী। মুখ পালকহীন, মুখের চামড়া ও গলায় ঝুলন্ত লতিকা উজ্জ্বল লাল।[১] দেহতলে পুরো কালো রঙের উপর ইস্পাত-নীল ও বেগুনী চাকচিক্য। স্ত্রী মথুরার দেহে অনুজ্জ্বল বাদামি পালকের ধূসর প্রান্ত আঁশের মত দেখায়। মাথার চূড়া ও লেজের পালক প্রায় বাদামি। গলা পীতাভ-বাদামি। কোমর ও পায়ের পালকের প্রান্তদেশ ফিকে। চোখের আশেপাশের অল্প একটু অংশ পালকহীন ও উজ্জ্বল লাল। স্ত্রী ও পুরুষ মথুরার উভয়ের চোখ পিঙ্গল থেকে কমলা-বাদামি। উভয়ের লেজ মোরগের লেজের মত। ঠোঁট সবুজাভ ও শিঙ-বর্ণের, ঠোঁটের গোড়া কালচে ও আগা ফিকে। পা ও পায়ের পাতা বাদামি। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখি দেখতে প্রায় স্ত্রী মথুরার মত, তবে পিঠে কালচে-বাদামি ও পীতাভ ডোরা দেখা যায়।[২] উপপ্রজাতিভেদে কালো মথুরার মধ্যে ব্যাপক বিভিন্নতা দেখা যায়।

স্বভাব সম্পাদনা

 
কালো মথুরার ছানা, অঙ্কিত চিত্র

কালো মথুরা বনের প্রান্তে ও বনসংলগ্ন খোলা জায়গায় বিচরণ করে। সাধারণত জোড়ায় জোড়ায় বা পারিবারিক ছোট দলে থাকে। মাটিতে ঘুরে ঘুরে খাবার খুঁজে বেড়ায়। এদের খাদ্যতালিকায় রয়েছে বাঁশবীজ, ডুমুর, বটফল, পিঁপড়া, উইপোকা, ছোট সাপ ও গিরগিটি। ভোরে ও গোধূলিতে এরা বেশি সক্রিয় থাকে। দিনের বেলা গাছের নিচু ডালে বিশ্রাম নেয়। সকাল ও সন্ধ্যায় নিচু স্বরে মুরগীর মত ডাকে: কুড়ড়-কুড়ড়-কুড়চি-কুড়ড়...[২] এরা খুব লাজুক পাখি, মানুষের আনাগোনা টের পেলে দ্রুত লুকিয়ে পড়ে।[৫]

প্রজনন সম্পাদনা

 
অঙ্কিত চিত্র

মার্চ থেকে অক্টোবর এদের প্রধান প্রজনন ঋতু। এসময় পুরুষ কালো মথুরার ডাকাডাকি বেড়ে যায়। স্ত্রী মথুরা ঘন ঝোপের নিচে নখ দিয়ে মাটি আঁচড়ে পাথর, লতাপাতা বা ঘাসের গোছা দিয়ে বাসা বানায়। বাসা বানানো শেষে ৬-৯টি ডিম পাড়ে। ডিমগুলো ফিকে-পীতাভ বা পীতাভ-সাদা থেকে লালচে পীত বর্ণের হয়। ডিমের মাপ ৪.৯ × ৩.৭ সেন্টিমিটার। স্ত্রী মথুরা একাই ডিমে তা দেয়। ২০-২১ দিনে ডিম ফোটে।[২]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. রেজা খান, বাংলাদেশের পাখি (ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ২০০৮), পৃ. ১১২।
  2. জিয়া উদ্দিন আহমেদ (সম্পা.), বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ: পাখি, খণ্ড: ২৬ (ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ২০০৯), পৃ. ৯।
  3. Lophura leucomelanos ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৫ মে ২০১২ তারিখে, The IUCN Red List of Threatened Species এ কালো মথুরা বিষয়ক পাতা।
  4. বাংলাদেশ গেজেট, অতিরিক্ত, জুলাই ১০, ২০১২, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, পৃষ্ঠা-১১৮৪৪৯
  5. রাজকীয় রূপের মথুরা ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭ তারিখে, সৌরভ মাহমুদ, তারিখ: ২০-১২-২০১০, দৈনিক প্রথম আলো।
  6. Lophura leucomelanos, The Internet Bird Collection এ কালো মথুরার বিষয়ক পাতা।

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা