কাঞ্চীপুরম
কাঞ্চীপুরম, (এছাড়াও স্থানীয়ভাবে কাঞ্চী kāñcipuram নামে পরিচিত; [kaːɲd͡ʒipuɾəm])[১] বা কাঞ্চীপুরামবা কাঞ্চিপুরম ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের একটি শহর। এটিকে মন্দিরের শহর বলা হয়। এটি তামিলনাড়ু রাজ্যের রাজধানী চেন্নাই থেকে ৭২ কিমি (৪৫ মা) দুরে অবস্থিত। শহরটি আয়তন ১১.৬০৫ কিমি২ (৪.৪৮১ মা২) এবং এর জনসংখ্যা ছিল ১৬৪,২৬৫ জন।[২] এটি কাঞ্চীপুরম জেলার প্রশাসনিক সদর দফতর। কাঞ্চীপুরম সড়ক ও রেলপথে দেশের অন্যান্য অংশের সাথে সংযুক্ত। চেন্নাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি শহরের নিকটতম অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, যা কাঞ্চীপুরম জেলা তিরুসুলামে অবস্থিত।
কাঞ্চীপুরম কাঞ্চীপুরাম, কাঞ্চী | |
---|---|
পৌরসভা | |
ডাকনাম: কাঞ্চী, সিল্ক সিটি, মন্দিরের শহর | |
স্থানাঙ্ক: ১২°৪৯′ উত্তর ৭৯°৪৩′ পূর্ব / ১২.৮২° উত্তর ৭৯.৭১° পূর্ব | |
দেশ | ভারত |
রাজ্য | তামিলনাড়ু |
অঞ্চল | তোন্দাইনাড়ু |
জনসংখ্যা (২০১১) | |
• মোট | ১,৬৪,২৬৫ |
ভাষা | |
সময় অঞ্চল | আইএসটি (ইউটিসি+০৫:৩০) |
ওয়েবসাইট | kanchi |
ভগবতী নদীর তীরে অবস্থিত এই কাঞ্চীপুরম পল্লব, মধ্যযুগীয় চোলাস দ্বারা শাসিত হয়েছে, পরবর্তীকালে চোলাস, পরবর্তী পাণ্ড্যর, বিজয়নগর সাম্রাজ্য, কর্ণাটিক রাজ্য এবং ব্রিটিশ দ্বারাও শাসিত হয়েছে, যারা এই শহরটিকে "কনজিওরাম" নামে অভিহিত করেছিলেন। শহরের এতিহাসিক নিদর্শনগুলির মধ্যে রয়েছে কৈলাসনাথর মন্দির এবং বৈকুণ্ট পেরুমাল মন্দির । এতিহাসিকভাবে, কাঞ্চিপুরম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একটি কেন্দ্র ছিল[৩] এবং ঘাতিকাস্থানম বা "শিক্ষার স্থান" নামে পরিচিত ছিল।[৪] ১ম এবং ৫ম শতাব্দীর মধ্যে এই শহরটি জৈন ও বৌদ্ধধর্মের উন্নত শিক্ষার একটি ধর্মীয় কেন্দ্রও ছিল।[৫]
ভারত সরকারের -ঐতিহ্য শহর বিকাশ এবং বড় যোজনা প্রকল্পের আওতায় কাঞ্চিপুরমকে ঐতিহ্যবাহী শহরের তালিকাভুক্ত করেছে।
ভূগোল
সম্পাদনাকাঞ্চীপুরম চেন্নাই থকে ৭২ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে, ভগবতী নদীর তীরে অবস্থিত।[৬] ভৌগলিকভাবে এটি ১২.৯৮ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৭৯.৭১ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত। এর আয়তন ১১.৬ বর্গ কিলোমিটার বা ৪.৫ বর্গ মাইল। সমূদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা ৮৩.২ মিটার বা ২৭৩ ফুট।[৬]
কাঞ্চীপুরমের আবহাওয়া সাধারনত স্বাস্থ্যকর। তাপমাত্রা এপ্রিল থেকে জুলাইয়ের মধ্যে গড় সর্বোচ্চ ৩.৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড (৯৯.৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট) থাকে এবং ডিসেম্বর ও ফেব্রুয়ারির মধ্যে সর্বনিম্ন ১° ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড (°১ ডিগ্রি ফারেনহাইট) পৌঁছায়।[৭]
কাঞ্চীপুরম, তামিলনাড়ু-এর আবহাওয়া সংক্রান্ত তথ্য | |||||||||||||
---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|
মাস | জানু | ফেব্রু | মার্চ | এপ্রিল | মে | জুন | জুলাই | আগস্ট | সেপ্টে | অক্টো | নভে | ডিসে | বছর |
সর্বোচ্চ গড় °সে (°ফা) | ২৯.১ (৮৪.৪) |
৩১.২ (৮৮.২) |
৩৩.৪ (৯২.১) |
৩৫.৬ (৯৬.১) |
৩৮.২ (১০০.৮) |
৩৭.২ (৯৯.০) |
৩৫.২ (৯৫.৪) |
৩৪.৭ (৯৪.৫) |
৩৪.১ (৯৩.৪) |
৩২.১ (৮৯.৮) |
২৯.৩ (৮৪.৭) |
২৮.৫ (৮৩.৩) |
৩৩.২ (৯১.৮) |
সর্বনিম্ন গড় °সে (°ফা) | ১৯.২ (৬৬.৬) |
১৯.৮ (৬৭.৬) |
২২.০ (৭১.৬) |
২৫.৪ (৭৭.৭) |
২৭.৩ (৮১.১) |
২৭.০ (৮০.৬) |
২৫.৯ (৭৮.৬) |
২৫.৪ (৭৭.৭) |
২৪.৮ (৭৬.৬) |
২৩.৭ (৭৪.৭) |
২১.৬ (৭০.৯) |
১৯.৯ (৬৭.৮) |
২৩.৫ (৭৪.৩) |
বৃষ্টিপাতের গড় মিমি (ইঞ্চি) | ২৫ (১.০) |
৬ (০.২) |
৪ (০.২) |
১৯ (০.৭) |
৫৯ (২.৩) |
৭৭ (৩.০) |
১০৮ (৪.৩) |
১৭৩ (৬.৮) |
১৩২ (৫.২) |
১৮৫ (৭.৩) |
২০৯ (৮.২) |
১০৭ (৪.২) |
১,১০৪ (৪৩.৪) |
উৎস: Climate-Data.org[৮] |
জনসংখ্যা
সম্পাদনাসপ্তম শতাব্দীতে রাজা নরসিংহ বর্মার শাসনামলে, শহরটি আয়তন প্রায় ১০ বর্গকিলোমিটার (৩.৯ বর্গ মাইল) ছিল এবং এর জনসংখ্যা ছিল ১০,০০০ জন। পরবর্তী বছরগুলিতে জনসংখ্যা বেড়েছে ১৩,০০০ জনে দাড়ায়। শহরটি আয়তক্ষেত্রাকার রাস্তাগুলির সাথে ক্রস প্যাটার্নযুক্ত লিঙ্কগুলোর উন্নয়ন করেছে। শহরের বসতিগুলি বেশিরভাগ বর্ণভিত্তিক ছিল। দ্বিতীয় নন্দীবর্মা পল্লবনের সময়ে, উচ্চ প্ল্যাটফর্ম এবং পোড়া ইটের বাড়িগুলো নির্মিত হয়েছে, যখন তিরুভেক্কা মন্দির এবং কৃষি শ্রমিকদের ঘরগুলি শহরের বাইরে ছিল। শহরের উপকণ্ঠে অশ্বারোহী ও পদাতিক প্রশিক্ষণ দেওয়ার বিধান ছিল।
২০১১ সালের ভারতীয় জনগণনার তথ্য অনুসারে কাঞ্চীপুরমের জনসংখ্যা ছিল ১৬৪,৩৮৪ জন, যার প্রতি পুরুষ ১,০০ জন পুরুষের অনুপাতে ১,০০৫ জন মহিলা ছিল, যা জাতীয় গড় লিঙ্গ অনুপাত ৯৯৯-এর তুলনায় অনেক বেশি। ছয় বছরের কম বয়সী জনসংখ্যা মোট ১৫,৯৫৫ জন, যার মধ্যে ৮,১৫৮ জন পুরুষ এবং ৭,৭৯৭ জন মহিলা ছিল। তফসিলি জাতি এবং তফসিলি উপজাতি জনসংখ্যার যথাক্রমে ৩.৫৫% এবং ০.০৯%। এখানকার সাক্ষরতার হার ৭৯.৫১%, জাতীয় গড় ৭২.৯৯% এর তুলনায় বেশি।
মন্দির নগরী কাঞ্চিপুরম
সম্পাদনাভারতের দক্ষিণে অবস্থিত তামিলনাড়ু (নাড়ু অর্থাৎ রাজ্য বা প্রদেশ)। ঐতিহাসিক দিক থেকে রাজ্যটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রায় সাড়ে ছয় হাজার বছর আগে এই এলাকায় সভ্যতার বিকাশ ঘটে। ভারতবর্ষের দ্রাবিড় সভ্যতার কেন্দ্রভূমি তামিলনাড়ু। এই সভ্যতা আর্য সভ্যতার চেয়েও প্রাচীন। এখানের শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ মানুষেই তামিল ভাষায় কথা বলেন। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে চোল, চেরা ও পাণ্ডাবংশের অধীনে ছিল এই এলাকা। পরে কাঞ্চির পল্লবরা এখানে আধিপত্য বিস্তার করেন। নবম শতাব্দীতে চোল বংশ পল্লবদের আক্রমণ করে এলাকাটি পুনরায় দখল করেন ত্রয়োদশ শতাব্দীতে পাণ্ডা রাজবংশের উত্থান ঘটে। কিন্তু বিজয়নগরের প্রভাব বাড়ার ফলে পাণ্ডা রাজবংশের পতন হয়। কালের প্রবাহে বিজয়নগর সাম্রাজ্য ভেঙে যায়। তামিলনাড়ু ছোট ছোট রাজ্যে ভাগ হয়। ১৬৩৯ সালে মাদ্রাজে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়। সমগ্র তামিল এলাকা ব্রিটিশের অধীনে আসে। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর তামিলভাষী এলাকা নিয়ে গঠিত হয় মাদ্রাজ রাজ্য। ১৯৬৯ সালের ১৪ জুন মাদ্রাজ রাজ্যের নতুন নাম হয় তামিলনাড়ু। রাজধানী ছিল মাদ্রাজ শহর। ১৯৯৬ সালের ১৭ জুলাই মাদ্রাজ শহরের নতুন নাম হয় চেন্নাই। তামিলনাডু রাজধানী এখন চেন্নাই। প্রায় ২০০ বছর ধরে পল্লব রাজারা কাঞ্চিতে রাজত্ব করেছেন। যে সব রাজাদের নাম জানা গেছে তাঁরা হলেন মহেন্দ্রবর্মন, প্রথম নরসিংহ বর্মন (৬২৫-৬৪৫ খ্রিঃ) দ্বিতীয় মহেন্দ্র বর্মন, প্রথম পরমেশ্বর বর্মন, দ্বিতীয় নরসিংহ বর্মন, দ্বিতীয় পরমেশ্বর বর্মন, তৃতীয় মহেন্দ্র বর্মন, প্রথম নন্দী বর্মন (৭১২-৭৮২ খ্রিঃ), দন্তি বর্মন, দ্বিতীয় নন্দী বর্মন প্রমুখ। পল্লবদের শেষ রাজা ছিলেন অপরাজিত পল্লব। নবম শতকে চোল রাজা প্রথম আদিত্য কাঞ্চি আক্রমণ করেন। পরাজিত হন অপরাজিত পল্লব। ফলে পল্লব শাসনের অবসান হয়। পল্লব রাজাদের রাজধানী ছিল কাঞ্চিপুরম। পল্লবরা ছিলেন সংস্কৃতি, শিল্প ও স্থাপত্যের পৃষ্ঠপোষক। কাঞ্চিপুরম নগরীতে শিল্প, স্থাপত্যের - নির্দশন এখনো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। খ্রিস্টিয় সপ্তম শতকে কুমারিল ভট্ট পল্লবদের আমলে বৈদিক আচার-অনুষ্ঠানের প্রাধান্য দেন। সমাজে ব্রাহ্মণদের প্রতিপত্তি বাড়ে। অষ্টম শতকে শঙ্করাচার্যের আর্বিভাব ঘটে। তিনি প্রচার করেন অদ্বৈতবাদ। তাঁর মতে- 'ব্রহ্ম এক ও অদ্বিতীয়; ব্রহ্মই সত্য জগৎ মিথ্যা'। পল্লব রাজধানী কাঞ্চিপুরমেও তিনি মঠ স্থাপন করেন। শংকরাচার্য সন্ন্যাসীদের সংগঠিত করেন। প্রচার করেন অদ্বৈত বেদান্ত দর্শন। পরে তিনি বাসব শৈব ধর্মও প্রচার করেন। তাঁর শিষ্যদের বলা হত বীর শৈব। আবার রামানুজ ও মাধবাচার্য প্রচার করেন বৈষ্ণব ধর্ম। বৈষ্ণব সাধুদের আলওয়ার ও শৈব্য সাধুদের বায়নার বলা হত।
কাঞ্চিপুরম শৈব, বৈষ্ণব, জৈন ও বুদ্ধ ধর্মের পীঠস্থান ছিল। সংস্কৃত ও তামিলভাষী বহু পণ্ডিত এই এলাকায় বসবাস করতেন। দক্ষিণ ভারতীয় শিল্পরীতি প্রধানত পল্লব আমলে গড়ে ওঠে। বৃহৎ আকারের পাথর কেটে মন্দির তৈরি করা হয়। পাথরের উপর দেবদেবীর মূর্তির খোদাইয়ের কাজ নিখুঁত ও সুন্দর। পল্লব রাজত্বের পর চোল ও বিজয় নগর রাজত্বেও প্রাদেশিক রাজধানী ছিল কাঞ্চিপুরম। এই সব বংশের রাজাদের আমলে বহু ছোট বড় মন্দির নির্মিত হয়েছে। অনেক মন্দির ধ্বংস হয়ে গেছে। এখনো প্রায় ১০০টি মন্দির এই কাঞ্চিপুরম এলাকাতে রয়েছে। চোল শিল্পরীতি ছিল বিদেশী প্রভাবমুক্ত। ঢোল আমলেও বড় বড় পাথর কেটে তা সঠিক স্নানে স্থাপন করে মন্দির তৈরী করা হত। এছাড়াও ছিল সুক্ষ্ম কারুকার্য। অনেক মন্দিরে ব্রোঞ্জ ও তামার মূর্তি চোল্ ভাস্কর্যের চিহ্ন বহন করছে। মন্দির গাত্রে পৌরাণিক কাহিনীর দৃশ্য ছাড়াও খোদাই করা হত সাধারণ জীবনের দৃশ্য। মূর্তিপূজার পাশাপাশি মন্দিরের মধ্যে বিদ্যাচর্চা ও নৃত্যগীত চর্চাও হত। পল্লব, চোল আমলের তথা দক্ষিণ ভারতীয় মন্দির স্থাপত্যের কয়েকটি বৈশিষ্ট। এই রকম, দেবালয়ের উপরের অংশকে বলা হয় শিখর। এগুলি কয়টি তলার সমন্বয়। দ্বিতীয় অংশ থাম যুক্ত বড় ঘর, যার নাম মণ্ডপ। এছাড়া থাকে প্রবেশ দ্বার যা উঁচু তোরণ। এর নাম 'গোপুরম'। অনেক মন্দিরে চারদিকে চারটি গোপুরমও দেখা যায়। মূল মন্দির প্রাঙ্গণে অনেক ছোট ছোট মন্দির, পুকুর, যাঁড়ের মূর্তি (নন্দী) ইত্যাদি দেখা যায়।[৯]
কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্দির
সম্পাদনাকাঞ্চিপুরম শহর এক সময় শিবকাঞ্চি, বিষ্ণুকাঞ্চি ও জৈনকাঞ্চি নামে তিন ধর্মীয় গোষ্ঠীর তিনটি অংশে বিভক্ত ছিল। এখন কাঞ্চিপুরম বিষ্ণুকাঞ্চি যা বরদারাজ পেরুমল মন্দির দিয়ে ঘেরা এবং শিবকাঞ্চি যা একাম্বরেশ্বর মন্দির দিয়ে ঘেরা রয়েছে। এর মাঝে শক্তির দেবী হিসেবে মন্দিরে বিরাজ করছেন কামাক্ষী মাতা।
কামাক্ষীমাতার মন্দির: ভারতবর্ষের মোট তিনটি শহরে শক্তিরূপ দেবীর আরাধনা হয়। কাঞ্চিপুরম, মাদুরাই এবং কাশী। কাঞ্চিপুরমে দেবী কামাক্ষী, মাদুরাইয়ে দেবী মীনাক্ষী, এবং কাশীতে দেবী বিশালাক্ষী পূজিতা হন। চতুর্দশ শতাব্দীতে চোল রাজারা কামাক্ষী মাতার মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এই মন্দিরের সাথে যোগাযোগ ছিল আদি শঙ্করাচার্যের। মন্দির এলাকা প্রায় পাঁচ একর। কামাক্ষী মাতা (পার্বতী বা কালী) এখানে প্রথম অবস্থায় উগ্র স্বরূপিনী হিসেবে বিারজ করছিলেন। আদি শঙ্করাচার্য শ্রীচক্র প্রতিষ্ঠিত করায় মাতা হয়ে উঠেন শান্ত স্বরূপিনী। কামাক্ষী মাতার মন্দিরের গঠনশৈলী বৈচিত্রময় ও বেশ জটিল। মন্দিরের বাইরে আছে পুকুর ও কয়েকটি মণ্ডপ। এর মধ্যে ১০০ থাম দিয়ে তৈরী হলঘর খুবই উল্লেখযোগ্য।
একাম্বরেশ্বর মন্দিরঃ কাঞ্চিপুরমের এই শিবমন্দির খুবই প্রসিদ্ধ। নদীর বালি দিয়ে তৈরি শিব লিঙ্গ এখানে পূজিত হন। মন্দির এলাকা প্রায় ২০একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত। মন্দিরের গোপুরম প্রায় এগারো তলা উঁচু যা ১৯২ ফুট। এতে আছে বিভিন্ন মূর্তির কারুকার্য। দক্ষিণ ভারতের অন্যতম উচ্চতম এই গোপুরম। বৃহদাকার শিব মন্দির পল্লব রাজাদের আমলে তৈরি। পরবর্তী পর্যায়ে চোল ও বিজয়নগর রাজারা মন্দিরের সংস্কার করেন। মন্দির এলকায় দুটি পুকুর আছে নাম কম্প নদী এবং শিবগঙ্গা। কথিত আছে এখানে শিব ও পার্বতী একটি আম গাছের তলায় মিলিত হয়েছিলেন। সেই জন্য সে শিবকে বলা হয় 'একাম্বরনাথ' বা একম্বরেশ্বর। (একা = এক, আম্র=আম, নাথ = দেব বা ঈশ্বর) পবিত্র আমগাছ এখানে আছে।এই আমগাছের চারটি শাখা চার বেদের প্রতীক। এই শিব মন্দিরের মধ্যেও বিষ্ণুমন্দিরও আছে। রূপো ও সোনার পাত দিয়ে মন্দিরের উঁচুতলা বা বিমান ঢাকা রয়েছে। ফাল্গুন মাসের মধ্যে একটি দিনে বেশ জাঁকজমক সহকারে শিব ও পার্বতীর বিবাহ অনুষ্ঠান এখানে পালন করা হয়।
বরদারাজ পেরুমল মন্দির: বিষ্ণুকাঞ্চি বা ছোট কাঞ্চিতে অবস্থিত এই মন্দির। বরদারাজ পেরুমল (পেরুমল> বিষ্ণু) দাঁড়ানো অবস্থায় পশ্চিমদিকে মুখ করে এখানে বিরাজ করছেন। এই মন্দিরকে অনেকেই দেবরাজ স্বামী মন্দিরও বলেন। বিজয়নগর আমলের রাজারা এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। মন্দির এলাকায যে পবিত্র পুকুর আছে তার নাম অনন্তসারস পুষ্করিনী। 'আদি হস্তিগিরি বরদারাজ' জলের নীচে অবস্থান করছেন। ৪০ বছর অন্তর পুকুর থেকে তুলে বরদারাজকে মণ্ডপে স্থাপন করে প্রদর্শন করানো হয়। তারপর আবার তাঁকে পুকুরের জলে অবস্থান করানো হয়। এই দুর্লভ উৎসব উদযাপিত হয়েছিল বিগত ১৯৭৯ সালে। তার ৪০ বছর বাদে অর্থাৎ ২০১৯ সালে আবার এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। বরদারাজ পেরুমল মন্দির দৃষ্টিনন্দন ও কারুকার্য মণ্ডিত। বৃহৎ প্রস্তর খণ্ড থেকে শত স্তম্ভের মণ্ডপ স্থাপিত হয়েছে। মণ্ডপের চারদিকে পাথরের বেড়ি দিয়ে ঘেরা। শ্রীরামানুজও এই মন্দিরের সাথে যুক্ত ছিলেন বলে জানা যায়। দেবস্থানের ছাদের নীচে সোনার পাতে মোড়া একটি পবিত্র বড় টিকটিকি ও রুপোর পাতে মোড়া পবিত্র ছোট টিকটিকি অবস্থান করছে। এর কাছে রয়েছে সূর্য ও চাঁদের প্রতিকৃতি। এই নিদর্শনগুলি স্পর্শ করলে সুখ ও শান্তি বজায় থাকে বলে অনেকের বিশ্বাস।
কৈলাশনাথের মন্দির: দক্ষিণ ভারতের অন্যতম প্রাচীন মন্দির এটি। রাজসিংহ পল্লব এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। মন্দির নির্মাণ সম্পূর্ণ হয় তাঁর পুত্র মহেন্দ্র বর্মন পল্লবের আমলে (অষ্টম শতাব্দী)। এই মন্দিরের স্থাপত্য ও ভাস্কর্য সত্যিই দেখার মতো। শহরের মূল কেন্দ্র থেকে এক কিলোমিটার পশ্চিমে এই মন্দির অবস্থিত। মূল মন্দিরকে ঘিরে রয়েছে অনেক ছোট ছোট মন্দির। শিবের ৬৪ রকম রূপ এখানে প্রদর্শিত হয়েছে। শিবরাত্রির দিন এই মন্দিরে ভক্ত সমাগম সবচেয়ে বেশি হয়।
কুমার কোট্টম সুব্রাহ্মণ্যম স্বামী মন্দিরঃ গুরুত্বপূণ দর্শনীয় মন্দির এটি। এই পবিত্র মন্দিরে বিরাজ করছেন মুরুগন বা সুব্রহ্মণ্যম স্বামী (কার্তিকেয়)। এছাড়া অন্যান্য অনেক দেবতা এখানে বিভিন্ন রূপে প্রদর্শিত হচ্ছেন।
কচ্ছপেশ্বর মন্দির: এই অপূর্ব সুন্দর মন্দিরটি কুমার কোট্রম মন্দিরের দক্ষিণে অবস্থিত। সম্ভবত পল্লব রাজারা এই মন্দির নির্মাণ করেন। এখানে মুখ্য দেবতা শিব। শিব পূজিত হচ্ছেন কচ্ছপরূপ বিষ্ণুর দ্বারা। তাই শিবকে বলা হচ্ছে 'কচ্ছপ ঈশ্বর'। এখানে ব্রহ্মা এবং সরস্বতী বর প্রার্থনা করছেন। অনেকে আবার এই মন্দিরকে 'কাঞ্চিশ্বর মন্দির' বলেন। দেবতার নাম কাঞ্চি। এই মন্দিরের প্রবেশদ্বারের পর একটি বড় পবিত্র পুকুর আছে। এই পবিত্র পুকুরের নাম 'ইষ্টসিদ্ধিতীর্থম'। পুকুরে মোট চারটি স্নানের ঘাট আছে। রবিবার এই পুকুরে ডুবে স্নান করলে সুস্থ শরীর ও দীর্ঘজীবন লাভ হয় বলে ভক্তদের ধারণা।
উলহলণ্ডা পেরুমল মন্দির: কামাক্ষী মাতার মন্দিরের কাছাকাছি এই মন্দির। কাঞ্চি পুরমের এই মন্দির খুবেই প্রাচীন। মন্দিরে বিষ্ণু বামনরূপে বিরাজমান। রাক্ষসরাজ মহাবলীর হাত থেকে দেবতাদের রক্ষা করছেন বিষ্ণু। উলহলণ্ডা পেরু মূর্তির আকার বেশ বড় উচ্চতা ৩৫ ফুট প্রস্থ ২৪ ফুট।
পাণ্ডবদূত পেরুমল মন্দির: একাম্বরেশ্বর মন্দিরের কাছেই এই মন্দির অবস্থিত। পাণ্ডবদের দূত হিসাবে ভগবান কৃষ্ণ দুর্যোধনের কাছে গেছলেন। তিনি চেয়েছিলেন পঞ্চপাণ্ডবের জন্য পাঁচটি আবাসস্থল। দুর্যোধন চক্রান্ত করে বাঁশের তৈরি একটি সিংহাসন রেখেছিলেন কৃষ্ণের বসার জন্য। সিংহাসনের তলদেশে সৈন্য রাখা হয়েছিল কৃষ্ণকে বধ করার জন্য। কৃষ্ণ সিংহাসনে বসেন। বিশ্বরূপ দর্শন দিয়ে সৈন্যদের হত্যা করেন। মন্দির এলাকায় যে পবিত্র পুকুর আছে তার নাম 'মৎস্য তীর্থম'। বিমানের নাম 'চক্র বিমান'।
'বৈকুণ্ঠ পেরুমল মন্দিরঃ এই মন্দির ভগবান বিষ্ণুর প্রতি উৎসর্গীকৃত। মন্দিরের প্রবেশ পথের মধ্যে সিংহমূর্তির স্তম্ভ দেখা যায়। সপ্তম শতাব্দীতে রাজা পরমেশ্বর বর্মন পল্লব এই মন্দির নির্মাণ করেন। বিমানের তিনটি অংশ আছে। ভূমিতলে ভগবান বিষ্ণু 'আসন' বা বসা অবস্থায় আছেন। তারপরের তলে 'স্থানাঙ্ক' বা দাঁড়ানো অবস্থায় এবং সব শেষের তলে 'শয়ন' অবস্থায় তিনি বিরাজ করছেন। আর দেবীমূর্তি আছেন বৈকুণ্ঠবল্লী মাতা'। পবিত্র রাত্রি বৈকুণ্ঠ একাদশীতে এই মন্দিরের গুরুত্ব অপরিসীম।
অষ্টভুজ পেরুমল মন্দির: এই মন্দিরের গঠন শৈলী খুবই সুন্দর। মন্দিরের সম্মুখে পবিত্র পুকুর আছে। পুকুরের নাম গজেন্দ্র পুষ্করিণী। এখানে ভগবান বিষ্ণু আটটি হাত নিয়ে বিরাজমান। হাতে আছে বিভিন্ন অস্ত্র। এই মন্দিরে ব্রহ্মোৎসব এবং গজেন্দ্রমোক্ষ উৎসব পালন করা হয়।
কামকোটী পীঠ: শ্রী আদিশংকর ভারতবর্ষের বিভিন্ন এলাকা পরিভ্রমণ করতে করতে কাঞ্চিতে আসেন। বহুবছর ধরে কাঞ্চিতে অবস্থান করেছিলেন। তিনি কাঞ্চি শহরকে নতুনভাবে সাজিয়ে তোলেন। তিনটি মুখ্য মন্দিরের পুর্ননির্মাণ তিনিই করেন। এই মন্দিরগুলি হল কামাক্ষীমাতার মন্দির, একাম্বরেশ্বর মন্দির এবং বরদারাজ পেরুমন্দির। ৪৮২ সালে শ্রীআদি শংকর কাঞ্চিতে কামকোটী পীঠ স্থাপন করেন। পরবর্তী পর্যায়ে এই পীঠে কমপক্ষে ৭০ জন আচার্য বা আধ্যাত্মিক গুরু কাজ করেছেন। এই পীঠ আধ্যাত্মিক ও সামাজিক ক্রিয়াকলাপের সাথে যুক্ত।[১০] [১১]
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ Malalasekera 1973।
- ↑ Kanchipuram : Census 2011।
- ↑ Rao 2008।
- ↑ K.V. 1975।
- ↑ Thapar 2001।
- ↑ ক খ About City 2011।
- ↑ Ministry of Water Resources, Government of India 2007, পৃ. 6।
- ↑ "CLIMATE: KANCHEEPURAM"। সংগ্রহের তারিখ ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬।
- ↑ কৃষ্টি কিরণ, সম্পাদক: তুষারকান্তি ষন্নিগ্রহী সপ্তম সংখ্যা,২০১৫, পৃঃ ১৩,১৪
- ↑ কৃষ্টি কিরণ, সম্পাদক: তুষারকান্তি ষন্নিগ্রহী, সপ্তম সংখ্যা, ২০১৫, পৃঃ ১৪,১৫,১৬
- ↑ https://www.tamilnadutourism.tn.gov.in/destinations/kancheepuram