ঐকবাদন স্বরলিপিলিখন

ঐকবাদন স্বরলিপিলিখন বলতে শুষিরযন্ত্র (পিতল বা কাষ্ঠনির্মিত), ততযন্ত্র, ঘাতযন্ত্র, ইত্যাদি যন্ত্রের বাদকদের সমন্বয়ে গঠিত একটি ঐকবাদনদলের (Orchestra) দ্বারা পরিবেশনের জন্য একটি সঙ্গীতকর্মের স্বরলিপি রচনা করার করার চর্চা, কলা, পেশা বা বিদ্যাকে বোঝায়। একে ইংরেজিতে "অর্কেস্ট্রেশন" (Orchestration) বলে। যে ব্যক্তি ঐ কাজটি সম্পাদন করেন, তাকে ঐকবাদন স্বরলিপিকার (Orchestrator) বলে। ঐকবাদন স্বরলিপিকার স্বরলিপির কোন অংশ কোন বাদ্যযন্ত্রে কতক্ষণ ও কী কৌশলে বাজানো হবে, তা এমনভাবে পছন্দ, নির্ধারণ ও সমন্বয় সাধন করেন, যাতে সঙ্গীতকর্মটির অভ্যন্তরের সব সূক্ষ্ম দ্যোতনাগুলি যেন সুন্দরভাবে প্রকাশিত হয়।

১৮২০ সালে কার্ল মারিয়া ফন ভেবারের রচিত ডের ফ্রাইশ্যুৎস গীতিনাট্যের দ্বিতীয় অংকের জন্য একটি হাতে লেখা স্বরলিপি, যাতে কণ্ঠশিল্পীদের সমস্ত অংশ ও তাদের সঙ্গত হিসেবে ঐকবাদনদলের বাজানো সুর ও অংশগুলি অন্তর্ভুক্ত আছে।

তবে উপরের কঠোর সংজ্ঞার চেয়ে বৃহত্তর অর্থে যেকোনও সম্মিলিত বাদকদল (Musical ensemble), যেমন শুষিরযন্ত্রপ্রধান বাদকদলের (concert band) জন্য সঙ্গীতের স্বরলিপি রচনা করাকেও ঐকবাদন স্বরলিপিলিখন বলা হতে পারে। ঐকবাদন স্বরলিপিলিখনে কোনও সঙ্গীতকর্মের বিভিন্ন অংশ যেমন উচ্চগ্রামের সুর, নিচুগ্রামের সুর, ইত্যাদি কোন্‌ বাদ্যযন্ত্রে কতজন বাদক কীভাবে, কতক্ষণ ধরে বাজাবে, সেই ব্যাপারগুলি নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। কখনও কখনও একটি বিশেষ যন্ত্রের বা যন্ত্রের দলের জন্য রচিত সঙ্গীতকে ঐকবাদনদলের দ্বারা পরিবেশনের জন্য উপযোজন সাধন করাকেও ঐকবাদন স্বরলিপিলিখনের আওতায় ধরা যায়। যেমন পিয়ানোতে একক বাদনের জন্য রচিত কোনও সঙ্গীতকর্মকে উপযোজিত করে ঐকবাদন স্বরলিপি লিখিত হতে পারে, যাতে একটি ঐকবাদনদল সেটিকে বাজাতে পারে। আবার কোনও শুষিরযন্ত্রপ্রধান বাদকদলের জন্য রচিত সঙ্গীত যেন বৃহৎ ঐকবাদনদল (সিম্ফনি অর্কেস্ট্রা) পরিবেশন করতে পারে, সেই উদ্দেশ্যেও উপযোজনমূলক ঐকবাদন স্বরলিপি রচনা করা হতে পারে।

পশ্চিমা ধ্রুপদী সঙ্গীতে ঐতিহাসিকভাবে সাধারণত সঙ্গীত রচয়িতারা নিজেরাই নিজেদের সঙ্গীতকর্মের ঐকবাদন স্বরলিপি রচনা করতেন। উদাহরণস্বরূপ হাইডন, মোৎসার্ট, বেটহোফেন, বেরলিওজ, ভাগনার, এলগার, ষ্ট্রাউস, রাভেল, রিমস্কি-কর্সাকভ ও ব্রিটেন এই কলায় বিশেষ পারদর্শিতা দেখান। সাঙ্গীতিক ইতিহাসের কালপরম্পরায় ধীরে ধীরে ঐকবাদন স্বরলিপিলিখন একটি পৃথক কলা ও পেশা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। আধুনিক কালে এসেও ধ্রুপদী পশ্চিমা সঙ্গীত রচয়িতারা প্রায় সবাই এখনও নিজস্ব সঙ্গীতের ঐকবাদন স্বরলিপি রচনা করেন। কিন্তু সঙ্গীতনির্ভর মঞ্চনাটক, চলচ্চিত্রের সঙ্গীত ও অন্যান্য বাণিজ্যিক মাধ্যমে ঐকবাদন স্বরলিপিকার ও বাদ্যযন্ত্র বিন্যস্তকারকদেরকে কোনও না কোনও মাত্রায় ব্যবহার করা রীতিতে পরিণত হয়েছে, কেন না সঙ্গীত রচয়িতারা ঐকবাদন স্বরলিপি লেখার সময় পান না বা তারা এ ব্যাপারে সুপ্রশিক্ষিত না-ও হতে পারেন।

চলচ্চিত্র সঙ্গীতে ঐকবাদন স্বরলিপিকারের সঠিক ভূমিকা উচ্চমাত্রায় পরিবর্তনশীল, যা কোনও নির্দিষ্ট সঙ্গীত রচয়িতার প্রয়োজন ও দক্ষতাসমষ্টির উপর নির্ভর করে। সঙ্গীতনির্ভর মঞ্চনাটকে সাধারণ সঙ্গীত রচয়িতা সাধারণত পিয়ানোতে বাজানোর জন্য বা কণ্ঠে গাওয়ার জন্য একটি স্বরলিপি রচনা করেন এবং তার পরে একজন ঐকবাদন স্বরলিপিকার বা বাদ্যযন্ত্র বিন্যস্তকারক (arranger) ভূগর্ভীয় ঐকবাদনদলের (pit orchestra) বাজানোর জন্য একটি ঐকবাদন স্বরলিপি রচনা করেন।

জ্যাজ সঙ্গীতের বৃহৎ বাদকদলগুলির (big band) ক্ষেত্রে সঙ্গীত রচয়িতা বা গানের লেখক প্রথমে একটি নির্দেশনা পত্র (Lead sheet) রচনা করেন, যাতে সুর ও স্বরসমষ্টিগুলি অন্তর্ভুক্ত থাকে, এরপরে এক বা একাধিক ঐকবাদন স্বরলিপিকার বা বাদ্যযন্ত্র বিন্যস্তকারক ঐসব প্রাথমিক সাঙ্গীতিক ধারণাগুলির উপর ভিত্তি করে শুষিরযন্ত্র বিভাগ (যেমন স্যাক্সোফোন, ট্রাম্পেট, ট্রম্বোন) ও ছন্দ বিভাগের (বেস, পিয়ানো, জ্যাজ গিটার, হ্যামন্ড অর্গান, ড্রাম) জন্য সঙ্গীত স্বরলিপি রচনা করেন।

একজন ঐকবাদন স্বরলিপিকার একজন প্রশিক্ষিত পেশাদার সঙ্গীতবিদ যিনি কোনও সঙ্গীত রচয়িতার লেখা সঙ্গীতকর্মের বিভিন্ন অংশের জন্য কোনও ঐকবাদনদলের বিভিন্ন যন্ত্র নির্দিষ্ট করে দেন, কিংবা অন্য কোনও মাধ্যমের জন্য রচিত সঙ্গীতকর্মকে ঐকবাদনদলের দ্বারা বাজিয়ে পরিবেশনের জন্য উপযোজন সাধন করেন। ঐকবাদন স্বরলিপিকারেরা সঙ্গীতনির্ভর মঞ্চনাটক প্রযোজক প্রতিষ্ঠান, চলচ্চিত্র প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ও সঙ্গীত যন্ত্রধারণশালাগুলিতে (রেকর্ডিং স্টুডিও) কাজ করতে পারেন। কোনও কোনও ঐকবাদন স্বরলিপিকার মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় বা সঙ্গীত শিক্ষালয়ে শিক্ষাকতা করেন। ঐকবাদন স্বরলিপিকারদের শিক্ষাগ্রহণে বৈচিত্র্য রয়েছ। তাদের সিংহভাগই সঙ্গীত বিষয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করে থাকেন, যেমন তারা সঙ্গীতে স্নাতক বা সঙ্গীতে স্নাতকোত্তর উপাধির অধিকারী হতে পারেন, কিংবা অন্য কোনও ধরনের শিল্পী সনদ লাভ করতে পারেন। যেসব ঐকবাদন স্বরলিপিকার বিশ্ববিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় বা সঙ্গীত শিক্ষালয়ে শিক্ষকতা করেন, তাদের স্নাতকোত্তর উপাধি বা ডক্টরেট উপাধির অধিকারী হওয়া আবশ্যকীয় হতে পারে। চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বা সঙ্গীতনির্ভর মঞ্চনাটক পরিবেশন প্রতিষ্ঠানের হয়ে যেসব ঐকবাদন স্বরলিপিকার কাজ করেন, তাদেরকে উচ্চশিক্ষায়তনিক প্রমাণপত্রের পরিবর্তে পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কর্মনিয়োগ দেওয়া হতে পারে। ২০১০-এর দশকে এসে কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগ কিংবা কোনও সঙ্গীত বিদ্যালয়ের মর্যাদা সেটিতে কর্মরত শিক্ষকদের মধ্যে সমাপনী উপাধি বা ডক্টরেট উপাধিধারীদের অনুপাতের সাথে উত্তরোত্তর সম্পর্কিত হতে শুরু করে, ফলে ঐসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করতে হলে ঐ জাতীয় উপাধির অধিকারী হওয়া আবশ্যকীয় হয়ে পড়েছে।

আরও দেখুন

সম্পাদনা

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা

টেমপ্লেট:Musical composition