উইলেম ডে সিটার
উইলেম ডে সিটার (ওলন্দাজ: Willem de Sitter) (৬ মে ১৮৭২ - ২০ নভেম্বর ১৯৩৪) ছিলেন নেদারল্যান্ডের একজন বিখ্যাত গণিতবিদ, পদার্থবিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী।
উইলেম ডে সিটার | |
---|---|
জন্ম | Sneek, নেদারল্যান্ড | ৬ মে ১৮৭২
মৃত্যু | ২০ নভেম্বর ১৯৩৪ লেইডেন, নেদারল্যান্ড | (বয়স ৬২)
জাতীয়তা | ওলন্দাজ |
মাতৃশিক্ষায়তন | খ্রোনিঙেন ইউনিভার্সিটি |
পরিচিতির কারণ | ডে সিটার মহাবিশ্ব |
বৈজ্ঞানিক কর্মজীবন | |
কর্মক্ষেত্র | পদার্থবিজ্ঞান, গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান |
জীবনের প্রথম ভাগ
সম্পাদনাডে সিটারের বাবা এবং মায়ের নাম যথাক্রমে Lamoraal Ulbo de Sitter ও Catharine Theodore Wilhelmine Bertling। তার বাবা ছিলেন আইনজীবী এবং তাদের পরিবারে আইনজীবী হওয়াটা এক ধরনের প্রথায় পরিণত হয়েছিল। কিন্তু গণিত ও বিজ্ঞানে বিশেষ আগ্রহের কারণে তিনি ভিন্ন পেশা গ্রহণে উৎসাহিত হন। তিনি মাধ্যমিক স্কুলে পড়াশোনা করেছিলেন নেদারল্যান্ডের Arnhem শহরে, স্কুলের নাম ছিল Arnhem জিমনেসিয়াম। স্কুলের পাঠ শেষে ইউনিভার্সিটি অফ খ্রোনিঙেনে ভর্তি হয়েছিলেন গণিত বিষয়ে পড়ার জন্য। স্নাতক ডিগ্রির জন্য পড়াশোনা করতে গিয়ে গণিতে আগ্রহের পাশাপাশি তার মধ্যে প্রত্যক্ষ পরীক্ষা-নীরিক্ষার আগ্রহও জেগে উঠে। এই আগ্রহের কারণেই একসময় তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের অধ্যাপক Hermanus Haga-এর অধীনে পরিচালিত পরীক্ষণগুলোতে অংশ নেয়ার অনুমতি দেয়া হয়। এভাবেই তিনি প্রথম বারের মত খ্রোনিঙেনের জ্যোতির্বিজ্ঞান গবেষণাগারে কাজ করার সুযোগ পান।[১]
এই গবেষণাগারেই তখন অধ্যাপক ইয়াকোবুস কাপ্টাইন অনেকগুলো আলোকচিত্র প্লেট পরিমাপ করছিলেন। কেপটাউন মানমন্দিরে দক্ষিণ গোলার্ধের আকাশের তারা জরিপের অংশ হিসেবে এই প্লেটে ছবিগুলো তুলেছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী ডেভিড গিল। কাপ্টাইন বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানের অধ্যাপক হলেও জ্যোতির্বিজ্ঞান গবেষণাগারের কাজে সাহায্য করছিলেন কারণ পর্যবেক্ষণের জন্য তার নিজের কোন মানমন্দির ছিল না।
দক্ষিণ আফ্রিকায়
সম্পাদনাডে সিটারের জীবনের মোড় ঘুরে যায় যখন ডেভিড গিল ১৮৯৬ সালে খ্রোনিঙেনে আসেন দক্ষিণ গোলার্ধের আকাশ জরিপের অগ্রগতি বিষয়ে কাপ্টাইনের সাথে আলাপ করতে। গবেষণাগারে প্রবেশের সময় গিল ডে সিটারকে আলোকচিত্র প্লেট পরিমাপরত অবস্থায় দেখে কিছু কথা বলেন। পরদিন ডে সিটার যখন সকালের খাবার খাচ্ছিলেন তখন জানতে পারেন যে গিল তার সাথে আরও কথা বলতে চায়। ডে সিটার তখনও ভালভাবে ইংরেজি বলতে পারতেন না, ওদিকে কাপ্টাইন তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিচ্ছিলেন। অগত্যা কাপ্টাইনের স্ত্রী গিল ও ডে সিটারের মধ্যে দোভাষী হিসেবে কাজ করেন। এই সাক্ষাৎকারেই গিল ডে সিটারকে কেপটাউনে এসে জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণের কাজে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ জানান এবং বলেন যে, এর মাধ্যমে সে তার জ্যোতির্বিজ্ঞান শিক্ষা শেষ করতে পারবে। অবশ্য, সেটাকে তার জ্যোতির্বিজ্ঞান শিক্ষার শুরুও বলা যায় কারণ তখনও জ্যোতির্বিজ্ঞানের উপর ডে সিটারের প্রাতিষ্ঠানিক দখল ছিল না এবং তিনি গণিতের প্রতিই বেশি মনোযোগী ছিলেন।[২]
ডে সিটার তার বাবা-মার সাথে কথা বলে গিলের আমন্ত্রণ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন এবং যাওয়ার আগে খ্রোনিঙেনের পরীক্ষাগুলো শেষ করে ফেলতে মনস্থ করেন। ১৮৯৭ সালে অবশেষে খ্রোনিঙেন থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন এবং সে বছরেরই গ্রীষ্মকালে কেপটাউনের উদ্দেশ্যে রওনা দেন, কেপটাউন পৌঁছেন অগাস্টে। দক্ষিণ আফ্রিকার এই কেইপ মানমন্দিরে তিনি দুই বছর আলোকমিতি ও হেলিওমিটার প্রকল্পে কাজ করেন। গিলের পরামর্শে ডে সিটার ডক্টরেট অধ্যয়নের জন্য বেছে নিয়েছিলেন বৃহস্পতির উপগ্রহগুলোর হেলিওমিটার পর্যবেক্ষণের বিশ্লেষণ। উল্লেখ্য এই পর্যবেক্ষণগুলো গিল ১৮৯১ সালে করেছিলেন।
১৮৯৯ সালে খ্রোনিঙেনে ফিরে আসার পর তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞান গবেষণাগারে সহকারী হিসেবে যোগ দেন এবং একইসাথে কাপ্টাইনের অধীনে ডক্টরেট গবেষণার কাজ করতে থাকেন। ১৯০১ সালে খ্রোনিঙেন বিশ্ববিদ্যালয়ে তার পিএইচডি অভিসন্দর্ভ পেশ করেন যার শিরোনাম ছিল Discussion of Heliometer Observations of Jupiter's Satellites। ডে সিটারের মৃত্যুর পর তার শোকবার্তায় ইয়ান ওর্ট এই গবেষণা সম্পর্কে লিখেছিলেন,
“ | গিলের করা বৃহস্পতির উপগ্রহগুলোর হেলিওমিটার পর্যবেক্ষণ নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে ডে সিটার জ্যোতির্বিজ্ঞানের যে শাখায় প্রবেশ করেছিলেন তা তার মত বিজ্ঞজনের জন্য উপযুক্ত মনে হচ্ছিল। একদিকে, সবচেয়ে জটিল গাণিতিক সমস্যা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারা এবং বাস্তবসম্মতভাবে সেগুলোর সমাধান করার মত মেধা তার ছিল, অন্যদিকে তিনি পর্যবেক্ষণের গুরুত্ব ও সীমাবদ্ধতা বিষয়ে এক ধরনের সংশয়বাদী অন্তর্দৃষ্টি অর্জন করেছিলেন। পর্যবেক্ষণ এবং যন্ত্রপাতির প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহ থাকার কারণেই তিনি এই অন্তর্দৃষ্টি পেয়েছিলেন।[৩] | ” |
১৮৯৮ সালের ৬ই ডিসেম্বর ডে সিটার দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনেই Eleonora Suermondt-কে বিয়ে করেন। Eleonora-র জন্ম হয়েছিল ডাচ ইস্ট ইন্ডিজের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর Surabaya-তে। ডে সিটারের সাথে যখন দেখা হয় তখন তিনি স্কুল শিক্ষিকা ছিলেন। তাদের প্রথম সন্তান Lamoraal Ulbo-র জন্ম হয়েছিল ১৮৯৯ সালের সেপ্টেম্বরে কেপটাউনেই। কিন্তু খ্রোনিঙেনে ফিরে আসার পর ১৯০১ সালের ১০ জানুয়ারি শিশুটি মারা যায়। তাদের অন্য সন্তানদের নাম হচ্ছে Theodora (জন্ম: ১৯০০), Lamoraal Ulbo (জন্ম: ১৯০২), Aernout (জন্ম: ১৯০৫) এবং Agnes (জন্ম: ১৯০৮)। লামোরাল উলবো ডে সিটার পরবর্তীকালে বিখ্যাত গাঠনিক ভূতত্ত্ববিদ হয়েছিলেন, তিনি ১৯৮০ সালে মারা যান। Aernout হয়েছিলেন ডাচ ইস্ট ইন্ডিজের অন্তর্গত ইন্দোনেশিয়ার লেমবাং এ অবস্থিত Bosscha মানমন্দিরের পরিচালক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যখন জাপানিরা ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ দখল করে নেয় তখন তিনি বন্দী হন এবং বন্দি শিবিরেই ১৯৪৪ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।
লেইডেন মানমন্দিরে
সম্পাদনা১৮৭২ সাল থেকে ইউনিভার্সিটি অফ লেইডেনের মানমন্দিরের পরিচালক এবং সেখানে জ্যোতির্বিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে কাজ করছিলেন Hendricus Gerardus van de Sande Bakhuyzen, ১৯০৮ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। অবসরের পর তার পদের দায়িত্বকে দুই ভাগ করা হয়, জ্যোতির্বিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং মানমন্দিরের পরিচালক দুটি কাজের জন্য দুটি আলাদা পদ চালু করা হয়। তখনই উইলেম ডে সিটারকে জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রধান অধ্যাপক এবং Ernest-Frederich van de Sande Bakhuyzen কে মানমন্দিরের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। পদ গ্রহণের পর ডে সিটার তার প্রথম লেকচার দিয়েছিলেন The New Methods in Celestial Mechanics বিষয়ে। ১৯১৮ সালে van de Sande Bakhuyzen মারা যাওয়ার পর অধ্যাপনার পাশাপাশি লেইডেন মানমন্দিরের পরিচালক পদটিও গ্রহণ করতে হয় ডে সিটারকে।[১]
পরিচালক হওয়ার পর তিনি লেইডেনের জ্যোতির্বিজ্ঞান জগতে একটি বড় ধরনের পরিবর্তন নিয়ে আসেন। প্রথমেই জ্যোতির্বিজ্ঞানের জন্য তিনটি আলাদা আলাদা ডিভিশন তৈরি করেন: অবস্থানের মৌলিক জ্যোতির্বিদ্যা বা জ্যোতির্মিতি, জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞান এবং খ-বলবিদ্যা বা তাত্ত্বিক জ্যোতির্বিজ্ঞান। তার নেতৃত্বকালীন সময়ে লেইডেন ছিল পৃথিবীর সেরা জ্যোতির্বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি।[৩]
১৯১৩ সালে ডে সিটার যুগল তারা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে আলোর বেগ উৎসের বেগের উপর নির্ভর করে না। এর আগে অনেকেই আলোর নিঃসরণ বিষয়ে এমন একটি তত্ত্ব প্রণয়নের চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন যা উৎসের উপর নির্ভর করে কিন্তু পরীক্ষণমূলক অন্যান্য ফলাফলের সাথে সাংঘর্ষিক নয়। যে সিটারের এই পর্যবেক্ষণমূলক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সেই চেষ্টায় ইতি টানতে বাধ্য হন সবাই।
বিশ্বতত্ত্বে অবদান
সম্পাদনা১৯১৬ সালে পল এরেনফেস্ট-এর সাথে একসাথে কাজ করে যে সিটার প্রস্তাব করেন যে একটি চতুর্মাত্রিক স্থান-কাল ব্যবস্থা সাধারণ আপেক্ষিকতার উপর ভিত্তি করে নির্মীত বিশ্বতাত্ত্বিক মডেলের জন্য সবচেয়ে উপযোগী। ১৯১৬-১৭ সালে তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানের উপর আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের প্রভাব বিষয়ে বেশ কয়েকটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। তিনি পদার্থের অনুপস্থিতিতে আইনস্টাইনের ক্ষেত্র সমীকরণের সমাধান নির্ণয় করেন। আর্নস্ট মাখ ঘোষিত একটি নীতি ছিল- স্থানীয় জড় প্রসঙ্গ কাঠামো মহাবিশ্বের বৃহৎ স্কেলের ভর বণ্টন দ্বারা নির্ণীত হয়। ডে সিটার প্রশ্ন করলেন, "যদি টেস্ট বডি ছাড়া আর কোন পদার্থের অস্তিত্ব না থাকে তাহলে টেস্ট বডির কি জড়তা থাকে?"
ডে সিটারের গবেষণা ১৯১৯ সালে আর্থার এডিংটনের বিখ্যাত মহাকর্ষীয় লেন্সিং পরীক্ষাকে প্রভাবিত করেছিল। আইনস্টাইনের আগেই ডে সিটার মনে করতেন আপেক্ষিকতার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হচ্ছে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ। আইনস্টাইন নিজে প্রথমে এটা বিশ্বাস করেননি, কিন্তু পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এটাই সত্য প্রমাণিত হওয়ার পর মেনে নিতে বাধ্য হন। এমনকি প্রমাণিত হওয়ার আগে মহাবিশ্বকে স্থির করার জন্য আইনস্টাইন তার সমীকরণে একটি মহাজাগতিক ধ্রুবক অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন, উদ্দেশ্য ছিল নিউটনের সময় থেকে চলে আসা সমস্যাটির সমাধান- মহাবিশ্ব কেন নিজের ভরে ধ্সে পড়ে না? কিন্তু মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হচ্ছে জানার পর আইনস্টাইন সেই ধ্রুবককে তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল বলে আখ্যায়িত করেন। ডে সিটার ১৯১৯ সালেই বলেছিলেন যে, এই ধ্রুবক আইনস্টাইনের অত্যন্ত সুন্দর সূত্রটির প্রতিসাম্য ও এলিগেন্স নষ্ট করে দিচ্ছে, যেখানে সূত্রটির সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল তা নতুন কোন অণুকল্প বা পরীক্ষণমূলক ধ্রুবক প্রবর্তন না করেই অনেক কিছু ব্যাখ্যা করতে পারে। ১৯৯০-এর দশকে অবশ্য মহাবিশ্বের ত্বরণ ঘটছে জানার পর আবার মহাজাগতিক ধ্রুবকের প্রয়োজন দেখা দেয়।
১৯৩২ সালে আইনস্টাইন ও ডে সিটার একসাথে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন যাতে মহাবিশ্বের বিখ্যাত আইনস্টাইন-ডে সিটার মডেল প্রস্তাব করা হয়। একটি সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্বের জন্য আইনস্টাইনের ক্ষেত্র সমূকরণসমূহের খুব সাধারণ একটি সমাধান এটি। এই গবেষণাপত্রেই তারা বলেছিলেন মহাবিশ্বে এমন অনেক পদার্থ থাকতে পারে যারা আলো নিঃসরণ করে না এবং তাদেরকে সনাক্তও করা যায়নি। বর্তমানে এই পদার্থকে বলা হয় তমোবস্তু বা ডার্ক ম্যাটার।