উইলিয়াম ওয়ার্ড
ভারতে আগত খ্রিষ্টান মিশনারি
জন্ম২০শে অক্টোবর ১৭৬৯
ডার্বি, ইংল্যান্ড
মৃত্যু৭ই মার্চ ১৮২৩

উইলিয়াম ওয়ার্ড (১৭৬৯-১৮২৩) ছিলেন একজন গুরুত্বপূর্ণ খ্রিষ্টান ধর্মপ্রচারক, লেখক, মুদ্রক ও অনুবাদক। ১৮০২ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই মে তিনি শ্রীরামপুরের সহধর্মপ্রচারক জন ফাউন্টেনের বিধবা স্ত্রীকে বিয়ে করেন এবং তার দুই কন্যাকে দত্তক নেন।

প্রথম জীবন

সম্পাদনা

২০শে অক্টোবর, ১৭৬৯ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যান্ডের স্ট্যাফোর্ডশায়ারে বার্টনের কাছে স্ট্রেটন গ্রামে উইলিয়াম ওয়ার্ড জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা জন ওয়ার্ড ছিলেন ঐ গ্রামের একজন ছুতোর ও মিস্ত্রী এবং ঠাকুরদা টমাস ওয়ার্ড কৃষিকাজে নিযুক্ত ছিলেন। উইলিয়ামের শৈশবেই তার বাবা মারা যান, এবং তার লালন-পালনের দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে তার মায়ের উপর বর্তায়। তিনি প্রথমে ডার্বির কাছে মিঃ কনগ্রিভ এবং পরে মিঃ ব্রিয়ারি নামক দু'জন শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে লেখাপড়া করেন।

বিদ্যালয়ের শিক্ষা শেষ হওয়ার পর উইলিয়াম ডার্বির একটি ছাপাখানায় মুদ্রক ও পুস্তক-বিক্রেতা মিঃ ড্রিউরির কাছে শিক্ষানবিশি করেন, এবং শিক্ষানবিশির মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও আরও দু'বছর ঐ ছাপাখানায় ড্রিউরিকে ডার্বি মার্কারি সংবাদপত্র সম্পাদনার কাজে সহযোগিতা করেন। এর পর স্ট্যাফোর্ডে গিয়ে তিনি তার ভূতপূর্ব মনিবের আত্মীয় জোশুয়া ড্রিউরিকে স্ট্যাফোর্ডশায়ার অ্যাডভার্টাইজার সংবাদপত্র সম্পাদনায় সহায়তা করেন। ১৭৯৪ বা ১৭৯৫ খ্রিষ্টাব্দে উইলিয়াম হাল্ শহরে গিয়ে স্বাধীনভাবে মুদ্রকের জীবিকা অবলম্বন করেন এবং কিছুকাল হাল্ অ্যাডভার্টাইজার সম্পাদনা করেন।

প্রথম জীবনে উইলিয়াম ওয়ার্ড অ্যানাব্যাপ্টিস্ট ধর্ম গ্রহণ করেন এবং ১৭৯৬ খ্রিঃ ২৬শে আগস্ট হাল্ শহরে তার ব্যাপ্টাইজেশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোয় ক্রমাগত ধর্মপ্রচারে নিযুক্ত থাকতে থাকতে সম্ভাবনাময় একজন ব্যক্তি হিসেবে তার পরিচিতি হয় এবং ১৭৯৭ খ্রিঃ আগস্ট মাসে ব্যাপ্টিস্ট সম্প্রদায়ের অন্যতম সদস্য মিঃ ফিশউইকের সহায়তায় তিনি ইয়র্কশায়ারের হ্যালিফ্যাক্সের কাছে ইউড হল্-এ যান। সেখানে জন ফসেটের (১৭৪০-১৮১৭) ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তিনি দেড় বছর পড়াশোনা করেন।

ধর্মপ্রচারণা কাজকর্ম

সম্পাদনা

১৭৯৮ খ্রিঃ শরৎকালে ব্যাপ্টিস্ট মিশন কমিটি ইউড পরিদর্শনে যায় এবং উইলিয়াম ওয়ার্ড নিজেকে ধর্মপ্রচারক হিসেবে নিয়োগ করেন। সম্ভবত তার এই পদক্ষেপের পিছনে তার সাথে উইলিয়াম কেরির ১৭৯৩ খ্রিঃ সংঘটিত একটি কথোপকথনের প্রভাব ছিল; কেরি ভারতে নিযুক্ত ধর্মপ্রচারণা কর্মক্ষেত্রে একজন মুদ্রকের বিশেষ প্রয়োজনীয়তার কথা তাকে বলেছিলেন।

উইলিয়াম ওয়ার্ড জোশুয়া মার্শম্যানের সাথে একই জাহাজ 'ক্রাইটেরিয়ন' এ চড়ে ১৭৯৯ খ্রিঃ ভারতে আসেন। কিন্তু কলকাতায় এসেই কেরির সাথে দেখা করতে পারেননি। একটি সরকারি নির্দেশ অনুযায়ী তাকে শ্রীরামপুরের দিনেমার উপনিবেশে রওনা দিতে হয়। সেখানেই পরে কেরি তার সঙ্গে দেখা করেন।

ভারতে ওয়ার্ডের প্রধান কাজ ছিল ব্যাপ্টিস্ট মিশন প্রেসের ছাপাখানার তত্ত্বাবধান করা। ঐ প্রেস তখন বাইবেলের বিভিন্ন উপদেশ বাংলা, মারাঠা, তামিল এবং আরও ২৩ টি ভাষায় অনুবাদ করে প্রচার করত। ভাষাতত্ত্বের উপরেও তখন প্রচুর বই ছাপার কাজ চলছিল, কিন্তু এত ব্যস্ততার মধ্যেও ওয়ার্ড নিয়মিত তার বিশাল ডায়রিতে লেখা ও স্থানীয় বাসিন্দাদের ধর্মশিক্ষা দানের জন্য যথেষ্ট সময় দিতেন।

১৮০৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত উইলিয়াম ওয়ার্ড সংলগ্ন মফঃস্বল ও গ্রামগুলোয় প্রায়ই যাতায়াত করতেন, কিন্তু ঐ বছরের পর থেকে নানা কাজে সময়ের অভাব হওয়ায় এবং কলকাতা ও শ্রীরামপুরে ধর্মপ্রচার কর্মকাণ্ডের সময়সীমা বেড়ে যাওয়ায় তার পক্ষে আর মূল কার্যালয় ছেড়ে বেশি দূর যাওয়া সম্ভব হয়নি। ১৮১২ খ্রিঃ তার ছাপাখানা একটি অগ্নিকাণ্ডের কবলে পড়ে। ফলে ছাপাখানা কর্তৃক জমিয়ে রাখা তখনও পর্যন্ত অনূদিত ও প্রকাশিত সমস্ত ধর্মোপদেশের নথি ভস্মীভূত হয়ে যায়। ক্ষতির আর্থিক মূল্য ছিল অন্তত দশ হাজার পাউণ্ড। অবশ্য ধ্বংসাবশেষ থেকে নতুন টাইপ করার ব্লকগুলো উদ্ধার করা গিয়েছিল, আর ব্রিটেনের শুভানুধ্যায়ীদের চেষ্টায় ক্ষতির প্রভাব কাটিয়ে উঠতেও তাদের বেগ পেতে হয়নি।

শ্রীরামপুর কলেজ

সম্পাদনা
 
ওয়ার্ড ব্যবহৃত চেয়ার, শ্রীরামপুর কলেজ।

১৮১৮ খ্রিঃ দীর্ঘদিন রুগ্ন থাকার ফলে ওয়ার্ড একবার ইংল্যাণ্ডে প্রত্যাবর্তন করেন। সেখানে তার দায়িত্ব ছিল ভারতীয়দের পাশ্চাত্য সাহিত্য ও বিজ্ঞান শিক্ষা দেওয়ার জন্য উইলিয়াম কেরিজোশুয়া মার্শম্যান এর সাথে তার যৌথ উদ্যোগে সদ্যপ্রতিষ্ঠিত শ্রীরামপুর কলেজের উন্নতির জন্য অর্থ সরবরাহের ব্যবস্থা করা।

ওয়ার্ড ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডের অনেক জায়গায় এই উদ্দেশ্যে ঘোরেন এবং হল্যান্ড ও উত্তর জার্মানিতেও যান। ১৮২০ খ্রিঃ অক্টোবরে নিউ ইয়র্কে গিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও সফর করে ১৮২১ খ্রিঃ এপ্রিল মাসে ইংল্যান্ডে ফেরেন। ঐ বছরেই ২৮শে মে 'অ্যালবার্টা' জাহাজে চড়ে পাড়ি দেন ভারতের উদ্দেশ্যে। এহেন সংহত প্রচেষ্টার জন্য কেরি, মার্শম্যান ও ওয়ার্ড একত্রে শ্রীরামপুর ত্রয়ী নামে খ্যাত হন।

মৃত্যু

সম্পাদনা

উইলিয়াম ওয়ার্ড ৭ই মার্চ,১৮২৩ খ্রিঃ কলেরা রোগে মারা যান। তাকে ধর্মপ্রচারকদের জন্য নির্দিষ্ট সমাধিস্থলে সমাধিস্থ করা হয়।

রচনাসমূহ

সম্পাদনা

ধর্মোপদেশের পাশাপাশি ওয়ার্ড আরও কয়েকটি রচনার স্রষ্টা, যেমন—

  • 'অ্যাকাউন্ট অফ দ্য রাইটিংস, রিলিজিয়ন, অ্যান্ড ম্যানার্স অফ দ্য হিন্দুস' (হিন্দুদের সাহিত্য, ধর্ম ও আচারের বিবরণ), শ্রীরামপুর, ১৮১১, চার খণ্ডে; ৫ম সংস্করণ, সংক্ষিপ্ত, মাদ্রাজ, ১৮৬৩, আট খণ্ডে।
  • 'ফেয়ারওয়েল লেটার্স ইন ব্রিটেন অ্যান্ড আমেরিকা অন রিটার্নিং টু বেঙ্গল ইন ১৮২১' (১৮২১ খ্রিঃ বাংলায় ফেরার সময় ব্রিটেন ও আমেরিকার বিদায়ী পত্রসমূহ), লন্ডন, ১৮২১; ২য় সংস্করণ, ১৮২১।
  • 'ব্রিফ মেময়্যার অফ কৃষ্ণ-পাল, দ্য ফার্স্ট হিন্দু, ইন বেঙ্গল, হু ব্রোক দ্য চেন অফ দ্য কাস্ট বাই এম্ব্রেসিং দ্য গস্পেল' (কৃষ্ণ পালের সংক্ষিপ্ত স্মৃতিকথা, বাংলার প্রথম হিন্দু যে ধর্মোপদেশ আশ্রয়পূর্বক জাতিভেদের শিকল ভেঙেছিল), ২য় সংস্করণ,লন্ডন, ১৮২৩।

এছাড়াও তিনি অনেক চতুর্দশপদী এবং অন্যান্য ছোট কবিতা লিখেছিলেন যেগুলো স্যামুয়েল স্টেনেটের লেখা একটি স্মৃতিকথায় পরিশিষ্ট হিসেবে প্রকাশিত হয়। এই স্মৃতিকথাটির আরম্ভে আর. বেকার খোদিত একটি অনুকৃতি আছে, যেটি শিল্পী ওভার্টন অঙ্কিত উইলিয়াম ওয়ার্ডের একটি প্রতিকৃতির আদলে তৈরি।