ইগতিসাব (বলপূর্বক কোন কিছু আদায় করা) বা জিনা-আল-জিবর শব্দ দুটি আরবি ভাষায় ধর্ষণ অর্থে ব্যবহৃত হয়।[১] ইসলাম ধর্ষণ বা বলপূর্বক যৌন হয়রানিকে অনুমোদন করে না। ইসলামে এটি একটি বড় পাপ। ইসলামে এটি হিরাবাহ বা রাহাজানি শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত।

ইসলামী উৎস সম্পাদনা

এ সম্পর্কে আবু দাউদে মুহাম্মাদের সময়কালের একটি ঘটনা[২] এবং মুয়াত্তা ইমাম মালিক গ্রন্থে প্রাথমিক সময়ের দুজন খলিফার দুটি বিচারকার্যের ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। [৩] এগুলো হল:

আলকামা তাঁর পিতা ওয়াযেল থেকে বর্ণনা করেন যে, মুহাম্মদের যুগে জনৈক মহিলা সালাত আদায়ের জন্য গমনকালে পথিমধ্যে তার সাথে একজন পুরুষের দেখা হলে, সে ব্যক্তি জোরপূর্বক তাকে ধর্ষণ করে। সে মহিলা চিৎকার দিলে, তার পাশ দিয়ে গমনকালে জনৈক ব্যক্তি এর কারণ জানতে চায়। তখন সে মহিলা বলেঃ অমুক ব্যক্তি আমার সাথে এরূপ অপকর্ম করেছে। পরে তার পাশ দিয়ে মুহাজিরদের একটি দল গমনকালে সে মহিলা তাদের বলেঃ অমুক ব্যক্তি আমার সাথে এরূপ কাজ করেছে। তারপর তারা গিয়ে এক ব্যক্তিকে ধরে আনে, যার সম্পর্কে তাদের ধারণা ছিল যে, সে-ই এরূপ করেছে। এরপর তারা সে ব্যক্তিকে উক্ত মহিলার কাছে উপস্থিত করলে, সেও বলেঃ হ্যাঁ। এই ব্যক্তিই এ অপকর্ম করেছে। তখন তাঁরা সে ব্যক্তিকে রাসূলুল্লাহ এর নিকট নিয়ে যায়। মুহাম্মদ যখন সে ব্যক্তির উপর শরীআতের নির্দেশ জারী করার মনস্থ করেন, তখন মহিলার সাথে অপকর্মকারী ব্যক্তি দাঁড়িয়ে যায় এবং বলেঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ ! আমি এই অপকর্ম করেছি। তখন মুহাম্মদ সে মহিলাকে বলেনঃ তুমি চলে যাও, আল্লাহ তোমার অপরাধ মাফ করে দিয়েছেন। এরপর তিনি (সা) ভুলভাবে ধরে আনা লোকটির সাথে উত্তম ব্যবহার করেন এবং ধর্ষক ব্যক্তিটির জন্য বলেনঃ একে পাথর মেরে হত্যা কর। [৪] মুহাম্মদ আরও বলেনঃ[৫] লোকটি এমন তাওবা করেছে যে, সমস্ত মদীনাবাসী এরূপ তাওবা করলে, তা কবূল হতো।

মালিক নাফির কাছ থেকে আমাকে বর্ণনা করেন যে, খুমুসের ক্রীতদাসদের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে একজন ক্রীতদাস নিযুক্ত ছিল এবং সে একজন কৃতদাসীর উপর ঐ নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে বল প্রয়োগ করল এবং তাঁর সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত হল। ওমর ইবনুল খাত্তাব তাকে চাবুকপেটা করলেন এবং তাকে বহিষ্কার করলেন, এবং তিনি দাসীটিকে চাবুকপেটা করলেন না কারণ ঐ নারীর উপর বল প্রয়োগ করে জোর খাটান হয়েছিল।

মালিক শিহাবের কাছ থেকে আমাকে বর্ণনা করেন যে আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ান ধর্ষণের একটি বিচারে রায় দিলেন যে ধর্ষককে ধর্ষিত মহিলার জন্য মোহর দিতে হবে। ইয়াহিয়া বললেন যে তিনি মালিককে বলতে শুনেছেন, "আমাদের সম্প্রদায় যা করা হয় একজন পুরুষকে যে একজন নারীকে ধর্ষণ করে, হোক সে কুমারী বা অকুমারী, যদি সে মুক্ত হয়, তাহলে অবশ্যই ঐ পুরুষকে ঐ মহিলার জন্য মহিলাটির চাহিদা অনুযায়ী মোহর দিতে হবে। যদি সে একজন দাসী হয়, তাহলে অবশ্যই ঐ নারীকে এমন সমতুল্য কিছু দিতে হবে যা তাঁর অপমানিত মূল্যকে লাঘব করে। এরকম মামলায় হদ বা হুদুদ শাস্তি প্রয়োগ করা হবে, এবং ধর্ষিত মহিলাটির উপর কোন শাস্তি প্রয়োগ করা হবে না। যদি ধর্ষকটি একজন কৃতদাস হয়, তাহলে উক্ত দ্বায় তাঁর মালিকের উপর বর্তাবে যদি না ঐ মালিক ঐ ক্রীতদাসটিকে আদালতের কাছে অর্পণ করে।"

ফিকহ সম্পাদনা

তাই হাদিসের বিবৃতি অনুযায়ী অধিকাংশ আইনবিদের বক্তব্য হল, ধর্ষকের শাস্তি হল মৃত্যুদণ্ড। তবে কিছু আধুনিক আইনবিদ মনে করেন, ধর্ষকের শাস্তি একজন জিনাকারীর মতই, অর্থাৎ ধর্ষক বিবাহিত হলে তার শাস্তি মৃত্যুদন্ড এবং অবিবাহিত হলে তাকে একশত বেত্রাঘাত প্রদান এবং এক বছরের জন্য নির্বাসন দিতে হবে: এবং উভয় ক্ষেত্রেই শাস্তি জনসম্মুখে প্রদান করতে হবে। ধর্ষিতাকে কোন প্রকার শাস্তি দেয়া হবে না, কারণ ধর্ষিতাদের সাধারণত প্রতিরোধ ক্ষমতার দিক থেকে দুর্বল হয়ে থাকেন।[১] [৭]

ইমাম মালিক সহ বেশ কিছু ইসলামী পণ্ডিত আরও বলেন যে ঐ ব্যক্তির উক্ত মহিলাকে মোহর দিতে হবে। :

ইমাম মালিক বলেন, আমাদের মতে যে ব্যক্তি কোন মহিলাকে ধর্ষণ করে, হোক সে মহিলা কুমারী অথবা না, যদি সে একজন মুক্ত মহিলা হয় তাকে অবশ্যই দাবি অনুযায়ী অর্থ দিতে হবে, আর যদি ঐ মহিলা কোন দাসী হয়, তবে তাকে অবশ্যই এমন কিছু দিতে হবে যা দ্বারা সে নিজের উপর সংঘটিত উক্ত দুর্ঘটনার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারে। ধার্য শাস্তি ধর্ষকের উপর প্রযুক্ত হবে এবং যে মহিলা ধর্ষিত হয়েছে তাঁর জন্য কোন শাস্তি নেই, মামলা যাই হোক না কেন।

আল-শাফায়ি, আল-লায়িস উক্ত দৃষ্টিভঙ্গিরর সঙ্গে ঐকমত্য্য দেখিয়েছেন এবং আলী ইবনে আবি তালিবও একই রকম মতামত দিয়েছেন। আবু হানিফা এবং আস-সাওরি দাবি করেন যে, হুদুদ শাস্তি দিতে হবে কিন্তু ধর্ষক মোহর দিতে বাধ্য নয়। যাই হোক, আলেমগণ সকলেই এ বিষয় একমত যে, ধর্ষককে হুদুদ আইনের অধীনে শাস্তি দিতে হবে, যদি তাঁর বিরুদ্ধে পরিষ্কার তথ্য প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায় অথবা যদি সে অপরাধ স্বীকার করে এবং ধর্ষিত মহিলাকে কোন শাস্তি দেয়া হবে না।[৮] ধর্ষণের মামলায়, চারজন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীর প্রয়োজন হতে পারে, কিন্তু সেটি সকল পরিস্থতিতিতে প্রযোজ্য নয়। যদি ধর্ষক তাঁর অপরাধ স্বীকার করে তখন চারজন সাক্ষীর প্রয়োজন হবে না।[৯] কোন কোন ক্ষেত্রে এধরনের অপরাধ স্বীকার বাতিল বলে গণ্য হয় এবং সাক্ষীর আবশ্যকতা আবার পুনর্বহাল হতে পারে। যদি কোন প্রমাণ নাই পাওয়া যায় অথবা আসামী যদি দোষ নাই স্বীকার করে অথবা চারজন সাক্ষী না পাওয়া যায়, তখন বিচারক ধর্ষককে এমন কোন শাস্তি দিতে পারেন যেটি তাকে এবং তাঁর মত অন্যান্যদেরকে এধরনের কাজে লিপ্ত হওয়া থেকে নিরুৎসাহিত করবে এবং বিরত রাখবে।[১] এক্ষেত্রে বর্তমানে আলেমগণ রায় দেন যে, চারজন সাক্ষী ও ধর্ষকের স্বীকারোক্তি এসব প্রমাণ যদি না মিলে তখন আধুনিক ডিএনএ টেস্ট, সিসিটিভি ক্যামেরা ফুটেজ, মোবাইল ভিডিও, ধর্ষিতার বক্তব্য, ধর্ষণের আলামত ইত্যাদি বিষয় ধর্ষণের প্রমাণ হিসেবে গণ্য হবে।[১০] ধর্ষণের অভিযোগকারী মহিলা থেকে যদি, ধর্ষণের সময় আর্তনাদ বা সাহায্যের জন্য চিৎকারের শব্দ শুনতে পাওয়া যায়, তবে নিযুক্ত কাজি উক্ত ঘটনাকে একটি শক্ত প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করতে পারবেন যা নির্দেশ করে যে, পুরুষটি উক্ত মহিলাকে জোর করেছিল বা তাঁর উপর শক্তি প্রয়োগ করেছিল।[১] ধর্ষণের অভিযোগকারী যদি অভিযোগটি প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়, তবে তা মিথ্যা অভিযোগ বলে গ্রহণ করা হবে, যার শাস্তি হল বেত্রাঘাত।[১১]

আরও দেখুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; ruling rape নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি
  2. "প্রশ্নোত্তর আত-তাহরীক অক্টোবর ২০১৪, প্রশ্ন (৪০/৪০) : কোন নারী ধর্ষণের শিকার হ'লে সে কি অপরাধী হিসাবে গণ্য হবে?"দারুল ইফতা, হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ। মাসিক আত-তাহরীক। অক্টোবর ২০১৪। ৬ আগস্ট ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫ 
  3. "Islam on rape"। Discover the truth। সংগ্রহের তারিখ ৭ এপ্রিল ২০১৫ 
  4. কিছু আইনবিদের মতে, তাকে পাথর মেরে হত্যা কর, এই অংশটুকু যঈফ বা দুর্বল, এই অংশ ব্যতীত হাদীসের বাকি অংশটুকু হাসান বা নির্ভরযোগ্য। হাসান, এ কথাটি বাদেঃ ‘‘তোমরা একে পাথর মারো।’’ অগ্রাধিকারযোগ্য কথা হলো, তাকে পাথর মারা হয়নি।
  5. অপর এক অনুবাদে বলা হয়েছে, সাহাবীগণ লোকটিকে পাথর নিক্ষেপ করে হত্যা করার কথা বললে মুহাম্মদ বলেন:
  6. "Bukhari , Book: 89 - Statements made under Coercion, Chapter 6: If a woman is compelled to commit illegal sexual intercourse against her will"। sunnah.com। সংগ্রহের তারিখ ১৪ আগস্ট ২০১৫ 
  7. Kassam, Zayn। "The Oxford Encyclopedia of Islam and Law" (ইংরেজি ভাষায়)। Oxford Islamic Studies Online। সংগ্রহের তারিখ ৩ মে ২০১৩ 
  8. Uzma Mazhar (২০০২)। "Rape in Islam"। Muslimaccess.com। সংগ্রহের তারিখ ২০১২-১১-০৭ 
  9. সুনান আবু দাউদ, ৩৮:৪৩৬৬ (ইংরেজি)
  10. "ইসলামে ধর্ষণের শাস্তি কঠোর"banglanews24.com। ২০১৯-০১-০৩। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৩-১৪ 
  11. Peters, R, "Zinā or Zināʾ" in the Encyclopaedia of Islam (second edition) edited by P. Bearman, Th. Bianquis, C.E. Bosworth, E. van Donzel, W.P. Heinrichs (Brill Online).