ইলমুদ্দিন (জন্ম:৪ঠা ডিসেম্বর, ১৯০৮ – মৃত্যু:৩১শে অক্টোবর, ১৯২৯) ছিলেন অবিভক্ত ভারতের একজন মুসলিম যিনি রাজপাল নামক এক বই প্রকাশককে হত্যা করেন। রাজপাল “রঙ্গিলা রসূল” নামক একটি বইয়ের প্রকাশক ছিলেন। মূলত, বইটি ছিল হিন্দু দেবী সীতাকে অবমাননা করে লিখিত একটি পুস্তিকার বিরুদ্ধে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ।[১] [২] মুসলিমরা প্রকাশিত এই বইটিকে ধর্মবিশ্বাসের উপর আক্রমণ হিসেবে দেখেন।

বাল্যজীবন সম্পাদনা

গাজি ইলমুদ্দিন শহীদ অবিভক্ত ভারতের লাহোরে (বর্তমান পাকিস্তান) জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা একজন ছুতার মিস্ত্রী ছিলেন। বয়োপ্রাপ্ত হলে তিনি তার পিতার দোকানে কাজে যোগ দেন। আবদুল রশিদ নামে তার একজন বন্ধু ছিলেন। তাকে “শিদা” বলে ডাকা হত। শিদার বাবার দোকান ওয়াজির খান মসজিদের সামনে অবস্থিত ছিল। একদিন তারা দুই বন্ধু মসজিদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। ঐ সময় মসজিদের কাছে অনেক লোকের ভিড় জমে ছিল। লোকেরা তখন রাজপালের বিরুদ্ধে স্লোগান দিচ্ছিলেন।

এ সময় গাজি ইলমুদ্দিন সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি রাজপালকে তার দোকানে গিয়ে ছুরিকাঘাতে হত্যা করবেন।

হত্যাকাণ্ডের পটভূমি সম্পাদনা

কৃষ্ণ প্রসাদ প্রতাব নামক ব্যক্তি চমূপতি ছদ্মনামে “রঙ্গিলা রসুল” নামক বই লেখেন। এই বইয়ে নবী মুহাম্মদ এর নামে কুৎসা রটানোয় মুসলিমরা এর প্রতিবাদ করেন।[৩] বইটি লাহোর থেকে ১৯২৩ সালে রাজপাল কর্তৃক প্রকাশিত হয়।[৪] ভারতীয় মুসলিমদের বেশ কিছু দল এই বইটি নিষিদ্ধের দাবি জানায়। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার মুসলিমদের দাবির প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেনি।

ইলমুদ্দিন তার বন্ধুর কাছে নিজের ইচ্ছার কথা জানান। একটি সূত্র মতে, তারা দুজনেই প্রকাশককে হত্যার সিদ্ধান্ত নেন।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

হত্যাকাণ্ড সম্পাদনা

তিনি হত্যার উদ্দেশ্যে বাজার থেকে এক রুপি দিয়ে একটি ছুরি কেনেন। ছুরিটি প্যান্টের ভেতর নিয়ে তিনি রাজপালের দোকানের দিকে এগিয়ে যান। এসময় রাজপাল তার দোকানে ছিলেন না। এদিনটি ছিল ৬ই সেপ্টেম্বর ১৯২৯ সাল।

রাজপাল দোকানে এলে ইলমুদ্দিন তার উপর আক্রমণ করেন। পরে জনতা তাকে নীরস্ত করে। এরপর পুলিশ ইলমুদ্দিনকে প্রেপ্তার করে। অক্টোবরের ৪ তারিখ তাকে পাঞ্জাবের মিয়ানওয়ালি কারাগারে প্রেরণ করা হয়।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] পরবর্তীতে তাকে হত্যাকারী হিসেবে সাব্যস্ত করা হয় এবং ভারতীয় দন্ডবিধি অনুসারে মৃত্যুদন্ডে দণ্ডিত করা হয়।[৫] [৬]

বিচার ও মৃত্যুদন্ড সম্পাদনা

ইলমুদ্দিনের পক্ষের আইনজীবী ছিলেন ফারুক হোসেন। ইলমুদ্দিন নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন। বিবাদী পক্ষ তার নির্দোষিতার পক্ষে দুজন সাক্ষী উপস্থাপন করে। বাদী পক্ষের দুজন সাক্ষী তার দোষী হওয়ার বিষয়ে সাক্ষ্য দেয়। তৎকালীন প্রখ্যাত আইনজীবী ও পরবর্তীকালে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ইলমুদ্দিনের পক্ষাবলম্বন করেন।[৭] তিনি লাহোর হাইকোর্টে আপিলে অংশ নেন। জিন্নাহ বিবাদীপক্ষের সাক্ষীদের বক্তব্যের উপর পাল্টা যুক্তি ছুড়ে দেন যা আদালতে গৃহীত হয়নি। জিন্নাহ এরপর পরিস্থিতির উল্লেখ করে এই বলে আবেদন করেন যে ইলমুদ্দিন একজন ১৯, ২০ বছরের ব্যক্তি যিনি তার বিশ্বাসের প্রতিষ্ঠাতার প্রতি ভালবাসার কারণে উত্ত্যক্ত হয়েছিলেন। তাই তার মৃত্যুদন্ডকে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরে বদলানো যেতে পারে। কিন্তু এই যুক্তিও আদালতে গৃহীত হয়নি।[৮]

হিন্দু পত্রিকা “প্রতাপ” এসময় জিন্নাহর সমালোচনা করে। পত্রিকা মতে এ ঘটনা হিন্দুদের মধ্যে জিন্নাহর সম্মানের জন্য হানিকর হবে। এটি স্মরণ রাখতে হবে যে ভারতীয় দন্ডবিধির ২৯৫-ক ধারার সংযোজনের সময় জিন্নাহ নির্বাচন কমিটিতে ছিলেন এবং তিনি তখন সতর্ক বার্তা উচ্চারণ করে বলেন যে এই আইন ভিন্নমতের কণ্ঠরোধ ও ধর্মের সমালোচনার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] কর্মকর্তারা এরপর ইলমুদ্দিনকে ফাঁসির মঞ্চের দিকে নিয়ে যান। তার মৃতদেহ জানাজা ছাড়াই কারাগারে দাফন করা হয়। কিন্তু ড আল্লামা মুহাম্মদ ইকবাল, মিয়া আমিরুদ্দিন এবং আবদুল আজিজের মত মুসলিম নেতাদের হস্তক্ষেপে লাশ কবর থেকে বের করা হয়।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] এরপর তার মৃতদেহ আল্লামা ইকবাল ও তার ঘনিষ্ঠদের সহায়তায় দাফনের জন্য লাহোর পাঠানো হয়।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

দাফন সম্পাদনা

সমগ্র শহর সেই সাথে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের কয়েক লক্ষ মুসলিম তার জানাজায় যোগ দেয়। ইলমুদ্দিনের পিতা আল্লামা ইকবালকে জানাজার নামাজের ইমামতির জন্য অণুরোধ করেন। ইকবাল উত্তর দেন এই বলে, “এই মহান যোদ্ধার জানাজা পড়ানোর তুলনায় আমি একজন পাপী ব্যক্তি”। তিনি লাহোরের হিযবুল আহনাফের প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ দিদার আলি শাহকে জানাজা পড়ানোর প্রস্তাব করেন।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] পরে ওয়াজির খান মসজিদের ইমাম ও সৈয়দ দিদার আলি শাহ জানাজার নামাজ পরিচালনা করে। জনতার প্রচন্ড ভীড়ের কারণে জানাজা তিন দফায় সম্পন্ন করতে হয়। ড স্যার আল্লামা মুহাম্মদ ইকবাল ও সৈয়দ দিদার আলি শাহসহ আরো অনেক খ্যাতনামা পণ্ডিত ইলমুদ্দিনের দাফনে অংশ নেন। এটি ছিল লাহোরের অন্যতম সর্ববৃহৎ জানাজা।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] তাকে লাহোরের মিয়ানি সাহিব বাহওয়ালপুর রোডের কবরস্থানে দাফন করা হয়। তার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য মিয়ানওয়ালি কারাগারে গাজি ইলমুদ্দিন শহীদ মসজিদ নাম একটি মসজিদ তৈরী করা হয়।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Ambedkar, Babasaheb, "Thoughts on Pakistan", pg. 165
  2. "Not just Imran; Iqbal and Jinnah also supported Islamic terror"www.outlookindia.com/। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১২-২৭ 
  3. "Not just Imran; Iqbal and Jinnah also supported Islamic terror"www.outlookindia.com/। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১২-২৭ 
  4. Nair, Neeti (মে ২০০৯)। "Bhagat Singh as 'Satyagrahi': The Limits to Non-violence in Late Colonial India"। Cambridge University Press: 649–681। জেস্টোর 20488099 
  5. Ramzi, Shanaz (৩০ মার্চ ২০১৪)। "Where history meets modern comforts"dawn.com 
  6. "Until we start denouncing Ilm-ud-din's legacy Mumtaz Qadris will keep sprouting up in Pakistan"nation.com.pk 
  7. Malik Asad (ফেব্রুয়ারি ৪, ২০১৫)। "Killer's defence lawyers eye 'heavenly reward'" 
  8. VIEW: The Ilam Din fiasco and lies about Jinnah — Yasser Latif Hamdani