ইন্দো-নেপাল শান্তি ও বন্ধুত্বের চুক্তি ১৯৫০
বিশ্বকোষীয় পর্যায়ে যেতে এই নিবন্ধে আরো বেশি অন্য নিবন্ধের সাথে সংযোগ করা প্রয়োজন। |
১৯৫০ সালের ভারত-নেপাল শান্তি ও বন্ধুত্ব চুক্তি হলো ভারত ও নেপালের মধ্যে স্বাক্ষরিত দ্বিপাক্ষিক চুক্তি। এ চুক্তি দক্ষিণ এশিয়ার দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে কৌশলগত সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে। এ চুক্তির অফিসিয়াল নাম হলো- ভারত সরকার ও নেপাল সরকারের মধ্যে স্বাক্ষরিত শান্তি ও বন্ধুত্ব চুক্তি। ১৯৫০ সালের ৩১ জুলাই নেপালের রাজধানী কাঠমন্ডুতে নেপালের প্রধানমন্ত্রী মোহন শমসের জং বাহাদুর রানা এবং নেপালে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত চাঁদদ্রেশর নারায়ন সিং মধ্যে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং চুক্তির ৯ নং ধারা অনুযায়ী এই দিন হতে তা কার্যকর হয়। এ চুক্তির আওতায় উভয়দেশের জনগণ ও পণ্য অবাধে প্রবেশাধিকার লাভ কওে এবং উভয় দেশের সামরিক ও পররাষ্ট্রনীতির বিষয়ে ঘনিষ্ট সম্পর্ক ও সহযোগিতা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫২ সালে কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল এর চীনের সহায়তায় ক্ষমতা দখলের ব্যর্থ প্রয়াসের পর ভারত ও নেপাল এই চুক্তির অধীনে সামরিক ও গোয়েন্দা সহযোগিতা বৃদ্ধি করে এবং ভারত নেপালে একটি সামরিক মিশন প্রেরণ করে। এই চুক্তি দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। তাই ১৯৫০ সালের ভারত-নেপাল শান্তি ও বন্ধুত্ব চুক্তি উপমহাদেশের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
পটভূমি
সম্পাদনানেপালের দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিমে ভারতের সীমান্ত অবস্থিত। ভারতে ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮১৬ সালে চুক্তি অনুযায়ী নেপাল ব্রিটিশ শাসনাধীন ছিল, যা পরবর্তীতে ১৯২৩ সালের চিরস্থায়ী শান্তি ও বন্ধুত্ব চুক্তির দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা লাভের পর দুই দেশ ঘনিষ্ট ও কৌশলগত বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে চেয়েছে। ১৯৪৯ সালে চীনে কমিউনিস্ট উত্থান ও তিব্বতের আক্রমণের প্রেক্ষিতে ভারত ও নেপাল উভয় রাষ্ট্র নিরাপত্তাজনিত বিষয়টি অধিক গুরুত্ব প্রদান করে। নেপাল আশঙ্কা করে যে, চীন কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল কর্তৃক একটি কমিউনিস্ট বিপ্লবে সমর্থন প্রদান করবে। মূলত ভারত ও নেপাল উভয় রাষ্ট্র নিজেদের সার্বভৌমত্ব রক্ষা, নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৯৫০ সালে ভারত-নেপাল শান্তি ও বন্ধুত্ব চুক্তি স্বাক্ষর করে।
চুক্তির মূল বিষয়বস্তু
সম্পাদনাঅফিসিয়াল নামঃ ভারত সরকার ও নেপাল সরকারের মধ্যে স্বাক্ষরিত শান্তি ও বন্ধুত্ব চুক্তি। স্বাক্ষরের তারিখঃ ৩১ জুলাই, ১৯৫০। স্বাক্ষরের স্থানঃ কাঠমান্ডু, নেপাল।
ভারত সরকার ও নেপাল সরকার ঐতিহাসিকভাবে সুসম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ ছিল। এই সম্পর্ককে আরো জোরদার করার লক্ষ্যে ও চিরস্থায়ীভাবে অব্যাহত রাখতে উভয় দেশ এ চুক্তি স্বাক্ষর করে।
চুক্তি স্বাক্ষরকারী ব্যক্তিঃ ভারত সরকারঃ ভারত সরকারের পক্ষে নেপালে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত চন্দ্রেশ্বর নারায়ন সিং এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। নেপাল সরকারঃ নেপালের পক্ষে নেপালের প্রধানমন্ত্রী মোহন শমশের এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।
চুক্তির ধারাসমূহ
সম্পাদনা১৯৫০ সালে স্বাক্ষরিত চুক্তির ধারাসমূহ নিম্নে উল্লেখ করা হলোঃ
- ধারা নং - ০১
ভারত সরকার ও নেপাল সরকারের মধ্যে চিরস্থায়ী শান্তি ও বন্ধুত্ব অব্যাহত থাকবে। উভয় দেশের সরকার সম্পূর্ণ সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতা ও একে অপরের স্বাধীনতার প্রতি পূর্ণ সম্মান ও সম্মতি জ্ঞাপন করবে।
- ধারা নং - ০২
দুই সরকার যে কোন প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে যে কোন গুরুত্বপূর্ণ বিরোধ বা ভুল বোঝাবুঝি সংক্রান্ত তথ্য উভয়ের মধ্যে আদান প্রদানসহ বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য পরামর্শ প্রদান করবে।
- ধারা নং - ০৩
ধারা ০১ অনুযায়ী সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা ও বজায় থাকবে এবং উভয় দেশের সরকার সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধিদের মাধ্যমে পারস্পরিক কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখবে। প্রতিনিধি ও সংশ্লিষ্ট কর্মীরা আর্ন্তজাতিক আইন অনুযায়ী প্রথাগতভাবে কূটনৈতিক বিশেষাধিকার ও স্বাধীনতা ভোগ করবে।
- ধারা নং - ০৪
দুই দেশের সরকার কর্তৃক নিয়োগ প্রাপ্ত কনসাল-জেনারেল, কনসাল, ভাইস কনসাল এবং অন্যান্য কনস্যুলার এজেন্ট যারা শহর, বন্দর ও একে অপরের ভূ-খণ্ডে অন্যান্য স্থানে রক্ষিত হবে। কনসাল-জেনারেল, কনসাল, ভাইস কনসাল এবং কনস্যুলার এজেন্ট বৈধ কর্তৃপক্ষ দ্বারা নিয়োগ প্রাপ্ত হবেন। নিয়োগকারী বৈধ কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনে প্রত্যাহার করতে পারবে। তবে তাদের প্রত্যাহার করার কারণ উল্লেখ করতে হবে। ব্যক্তি উল্লেখিত সকল অধিকার, বিশেষাধিকার, ছাড় ও দায়মুক্তি একটি পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে ভোগ করবে।
- ধারা নং - ০৫
নেপাল সরকার অস্ত্র, গোলাবারুদ বা সামরিক উপকরণ ও নেপালের নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় সরজ্ঞাম ভারতের ভূ-খন্ড ব্যবহার করে স্বাধীনভাবে আমদানি করতে পারবে।
- ধারা নং - ০৬
ভারত ও নেপাল উভয় দেশ প্রতিবেশীসুলভ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখবে এবং এ অঞ্চলের শিল্প ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে অংশগ্রহণসহ এ ধরনের উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট চুক্তির অনুমোদন প্রদান করবে।
- ধারা নং - ০৭
ভারত ও নেপাল সরকার অনুমোদন করে যে, পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে এ অঞ্চলের এক দেশের নাগরিক অন্য দেশে বাসস্থান, সম্পদের মালিকানা, ব্যবসা ও বাণিজ্যে অংশীদার, যাতায়াত এবং অন্যান্য সুবিধা অনুরূপ প্রকৃতির সুবিধা ভোগ করবে।
- ধারা নং - ০৮
এই চুক্তি পূর্ববর্তী সকল চুক্তি, সমঝোতা এবং ব্রিটিশ সরকার ও নেপাল সরকারের মধ্যকার চুক্তি বাতিল বলে গণ্য হবে।
- ধারা নং - ০৯
চুক্তি স্বাক্ষরের তারিখ হতে এই চুক্তি কার্যকর হবে।
- ধারা নং - ১০
উভয় পক্ষের সম্মতিক্রমে অথবা এক বছরের নোটিশ প্রদানের মাধ্যমে বাতিল না করা পর্যন্ত এই চুক্তি বলবৎ থাকবে।
সমালোচনা
সম্পাদনানেপালীরা এই চুক্তিকে অসম চুক্তি বলে অভিহিত করে থাকে। নেপালের আইন উন্মুক্ত সীমান্তের অনুমতি প্রদান করে না এবং আইন অনুযায়ী নেপালে ভারতীয়রা জমি ও সম্পদ ক্রয় করার ও তাদের নামে ব্যবসা পরিচালনা করার অধিকার রাখে না। তাদের দাবি করে যে, ১৯৫০ সালে অগণতান্ত্রিক সরকার এ চুক্তি স্বাক্ষর করে এবং এক বছরের নোটিশ প্রদানের মাধ্যমে তা বাতিল করতে ইচ্ছুক। এই চুক্তি অজনপ্রিয় এবং রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন বলে মনে করেন।