আবদুল করিম গজনবী
স্যার আবদুল করিম গজনবী (২৫ আগস্ট ১৮৭২ - ২৪ জুলাই ১৯৩৯) ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের একজন রাজনীতিবিদ, পর্যটক, মন্ত্রী, বঙ্গীয় শাসন পরিষদ, বঙ্গীয় প্রাদেশিক ও ভারতীয় কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য, মুসলিম শিক্ষার সংস্কারক এবং বাংলার মুসলিম রেনেসাঁর অন্যতম পথপ্রদর্শক। মুসলিমদের উপকারের জন্য তিনি চেষ্টা করেছেন। সৈয়দ আমির আলি প্রতিষ্ঠিত সেন্ট্রাল ন্যাশনাল মোহামেডান এসোসিয়েশনের সাথে তিনি জড়িত ছিলেন। এর মাধ্যমে মুসলিমদের অভিযোগ ব্রিটিশ সরকারের কাছে তিনি তুলে ধরতেন।[১]
স্যার আবদুল করিম গজনবী | |
---|---|
জন্ম | দেলদুয়ার গ্রাম, টাঙ্গাইল, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত | ২৫ আগস্ট ১৮৭২
মৃত্যু | ২৪ জুলাই ১৯৩৯ | (বয়স ৬৬)
মৃত্যুর কারণ | ব্রাঙ্কো-নিউমোনিয়া |
সমাধি | দেলদুয়ারের পারিবারিক কবরস্থান, টাঙ্গাইল জেলা, বাংলাদেশ |
নাগরিকত্ব | ব্রিটিশ ভারত |
মাতৃশিক্ষায়তন | লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় |
পেশা | জমিদার, রাজনীতিবিদ |
প্রতিষ্ঠান | সেন্ট্রাল ন্যাশনাল মোহামেডান এসোসিয়েশন |
উল্লেখযোগ্য কর্ম | পিলগ্রিম ট্রাফিক টু হেজাজ এন্ড প্যালেস্টাইন, মুসলিম এডুকেশন ইন বেঙ্গল, দ্য ডাইয়ারকিয়াল সিস্টেম ইন বেঙ্গল |
পিতা-মাতা | আবদুল হাকিম খান গজনভি (বাবা), করিমুন নেসা খানম চৌধুরানী (মা) |
আত্মীয় | স্যার আবদুল হালিম গজনভি (ভাই), বেগম রোকেয়া (খালা), আবুল আসাদ মুহাম্মদ ইবরাহিম সাবের (মামা), আবু জায়গাম মুহাম্মদ খলিল সাবের (মামা) |
পুরস্কার | নাইট (১৯২৮), নবাব বাহাদুর (১৯৩৩) |
জন্ম ও পরিবার
সম্পাদনাআবদুল করিম গজনবী ১৮৭২ সালের ২৫ আগস্ট বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার গ্রামের জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা আবদুল হাকিম খান গজনবী এবং মা করিমুন নেসা খানম চৌধুরানী। আবদুল হাকিম খান গজনবী ছিলেন দেলদুয়ারের জমিদার।[১]
শিক্ষাজীবন
সম্পাদনাআবদুল করিম গজনভি ইংল্যান্ডের ডেভনশায়ারের এক্সমাউথের সেন্ট পিটার্স স্কুল, লন্ডনের মেসার্স রেন এন্ড গার্নেজ ইনস্টিটিউশন ও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন। এরপর জার্মানির জেনা বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুকাল পড়াশোনা করেছেন। তিনি ইউরোপ সফর করে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেছেন। ১৮৯০ সালে তিনি আইসিএস পরীক্ষায় অংশ নেন। লেখাপড়ায় তিনি তার বিদ্যানুরাগী মায়ের উৎসাহ পেয়েছিলেন। ১৮৯৪ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন।[১]
জমিদারি
সম্পাদনাদেশে ফেরার পর তিনি পৈতৃক জমিদারি পরিচালনায় নিয়োজিত হন। পূর্বপুরুষ ফতেহদাদ খান গজনভি লোহানির কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে জমিদারি তাদের কাছে পৌছায়। তার পূর্বপুরুষরা আফগানিস্তানের গজনি থেকে বাংলায় এসেছিলেন বলে জানা যায়। এর ফলে তাদের পদবী গজনভি ব্যবহৃত হয়।[১]
রাজনীতি
সম্পাদনাবঙ্গভঙ্গের সময় সময় তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তিনি সরকারের এই পদক্ষেপকে সমর্থন দেন। কংগ্রেস নেতারা বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন শুরু করলে তিনি তার প্রতিবাদ করেন। এ কারণে বঙ্গভঙ্গ বিরোধীরা তাকে ভ্রান্ত গজনভি বলে অভিহিত করতেন। অন্যদিকে প্রদেশের গভর্নর স্যার জোসেফ ব্যামফিল্ড ফুলার তাকে ন্যায়পন্থি বলে অভিহিত করেছিলেন। নবগঠিত পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের মুসলিম নির্বাচনী এলাকা থেকে তিনি ১৯০৯ সাল থেকে ১৯১২ সাল পর্যন্ত ইম্পেরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন।[১]
তিনি ১৯১৩ সাল থেকে ১৯১৬ সাল পর্যন্ত বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির মুসলিম এলাকা থেকে ভাইসরয়ের কাউন্সিলে সরকার মনোনীত সদস্য ছিলেন। কাউন্সিলের সদস্য থাকাকালীন সময়ে তিনি হাজিদের যাতায়াতের বিষয়ে তদন্ত করার দায়িত্ব পেয়েছিলেন। মক্কা ও মদিনায় হাজিদের যাতায়াত নিয়ে আলোচনার জন্য ১৯১৩ সালে ভারত সরকার তাকে হেজাজের তৎকালীন শাসক হুসাইন বিন আলির নিকটে প্রেরণ করে। এসময় তিনি সিরিয়া ও ফিলিস্তিন ভ্রমণ করেছিলেন।[১]
মুসলিমদের শিক্ষার উন্নতির উদ্দেশ্যে ১৯১৪ সালের ৩০ জুন গঠিত ডি পি আই ডব্লিউ ডব্লিউ হর্নেলের নেতৃত্বাধীন ১৪ সদস্যের কমিটিতে তিনি অন্যতম বেসামরিক সদস্য ছিলেন। এই কমিটির নাম ছিল মোহামেডান এডুকেশন এডভাইজারি কমিটি। কমিটিতে তার পেশকৃত সুপারিশের মধ্যে মুসলিম শিক্ষানীতি, পাঠ্যসূচি, কারিগরি ও শিল্প শিক্ষা, নারী শিক্ষাসহ বিভিন্ন বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল। মুসলিমদের জন্য কারিগরি ও বাণিজ্যিক শিক্ষার প্রতি তিনি গুরুত্বারোপ করতেন এবং নারী শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিতেন।[১]
শাসনকাজে ভারতীয়দের অংশগ্রহণ বৃদ্ধির জন্য ১৯১৯ সালে ভারত সরকার আইন ১৯১৯ প্রণীত হয়। আইন অনুযায়ী ১৯২৩ সালের ডিসেম্বরে বঙ্গীয় প্রাদেশিক ব্যবস্থাপক সভার ১৯২৪-১৯২৬ মেয়াদের জন্য অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় নির্বাচনে তিনি ময়মনসিংহের দক্ষিণ-পশ্চিমের মুসলিম নির্বাচনী এলাকা থেকে নির্বাচকমণ্ডলীর প্রতিনিধি হিসেবে সভার সদস্য হন এবং ১৯২৪ সালে দুই মাস মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বপালন করেন। ১৯২৭ সালে ১৯২৭-১৯২৯ মেয়াদের জন্য অনুষ্ঠিত তৃতীয় নির্বাচনেও তিনি এই এলাকা থেকে জয়ী হন এবং সেই বছর সাত মাস মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বপালন করেন।[১]
১৯২৪ সালে শাসন সংস্কার তদন্ত কমিটিতে তিনি মত দেন যে হুবহু ইউরোপীয় ধাচের গণতন্ত্র ভারতের মুসলিমদের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তিনি সাইমন কমিশনকে সমর্থন দিয়েছিলেন। কমিশনের পক্ষে বাংলার ১৫জন বিশিষ্ট মুসলিম নেতা তার নেতৃত্বে ১৯২৭ সালের ডিসেম্বরে পত্রিকায় বিবৃতি দেন। ১৯২৮ সালে তিনি বেঙ্গল সাইমন কমিটির সভাপতি হন। ১৯২৯ সালে তাকে সর্বভারতীয় প্রাদেশিক সাইমন কমিটিসমূহের সভাপতি নিয়োগ দেয়া হয়। ১৯২৮ সালের ডিসেম্বরে হর্টগ কমিটিতে তিনি বাংলাকে বাঙালিদের সার্বজনীন মাতৃভাষা বলে উল্লেখ করেছিলেন।[১]
১৯২৯ সালের এপ্রিল থেকে ১৯৩৪ সালের ৯ মে পর্যন্ত তিনি বেঙ্গল এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন। এসময় তিনি হজ সংক্রান্ত বিষয় তদারকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৩৪ সালের ১০ মে তিনি রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণ অবসর নেন।[১]
সম্মাননা
সম্পাদনাকর্মক্ষেত্রে কৃতিত্বের জন্য ব্রিটিশ সরকার তাকে ১৯২৮ সালে নাইট খেতাব দেয়। ১৯৩৩ সালে তিনি নবাব বাহাদুর খেতাব পান।[১]
রচনাবলী
সম্পাদনাআবদুল করিম গজনবী তিনটি বই লিখেছেন। এগুলি হল পিলগ্রিম ট্রাফিক টু হেজাজ এন্ড প্যালেস্টাইন, মুসলিম এডুকেশন ইন বেঙ্গল ও দ্য ডাইয়ারকিয়াল সিস্টেম ইন বেঙ্গল।[১]
ব্যক্তিগত জীবন
সম্পাদনাআবদুল হালিম গজনবী ছিলেন তার ছোট ভাই। নারী শিক্ষার অগ্রদূত বেগম রোকেয়া তার খালা ছিলেন। আবুল আসাদ মুহম্মদ ইবরাহিম সাবের ও আবু জায়গাম মুহম্মদ খলিল সাবের ভ্রাতৃদ্বয় তার মামা ছিলেন।[১]
মৃত্যু
সম্পাদনাস্যার আবদুল করিম গজনবী ১৯৩৯ সালের ২৪ জুলাই তার কলকাতায় বালিগঞ্জের বাসভবনে ব্রাঙ্কো-নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। ২৬ জুলাই তাকে গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।[১]