আতেনবাদ ছিল প্রাচীন মিশরের একটি ধর্ম। এই ধর্মটি আতেনধর্ম,[১] আমারনা ধর্ম,[২]আমারনা নব্যতন্ত্র নামেও পরিচিত। এই ধর্মের প্রবর্তক ছিলেন নতুন রাজ্যের অষ্টাদশ রাজবংশের ফ্যারাও আখেনাতেন[৩] ধর্মটিকে বৈশিষ্ট্যসূচকভাবে একেশ্বরবাদী বা মনোলেট্রিস্টিক (অন্য দেবতার অস্তিত্ব অস্বীকার না করেও এক দেবতার পূজা) বলে বর্ণনা করা হয়; যদিও কোনও কোনও মিশরতত্ত্ববিদ দাবি করেন যে এই ধর্মটি আদতে ছিল হেনোথেইস্টিক (বিভিন্ন দেবতার মধ্য থেকে একজনের প্রতি আনুগত্য, বিশেষত কোনও পরিবার, জাতিগোষ্ঠী বা জনগোষ্ঠী কর্তৃক)।[৪] আতেনবাদের কেন্দ্র ছিল আতেনের কাল্ট। এই আতেন ছিলেন সূর্যের চাকতি। আদিতে আতেন ছিলেন মিশরের প্রথাগত সৌরদেবতা রা-এর একটি অবয়ব মাত্র। পরে অবশ্য আখেনাতেন কর্তৃক তিনি অপর সকল দেবদেবীর উর্ধ্বে স্থান অর্জন করেন।[৫] খ্রিস্টপূর্ব চতুর্দশ শতাব্দীতে প্রায় কুড়ি বছর আতেনবাদ মিশরের রাষ্ট্রধর্মের মর্যাদা ধরে রেখেছিল। আখেনাতেন অন্যান্য দেবদেবীর উপাসক ও প্রথাগত ধর্মের প্রতি অনুগতদের নিপীড়িত করতেন। তিনি অনেক প্রথাগত মন্দির বন্ধ করে দিয়েছিলেন। পরিবর্তে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আতেনবাদী মন্দিরসমূহ। যদিও পরবর্তীকালের ফ্যারাওরা আখেনাতেনের মৃত্যুর পরবর্তী পর্যায়ে এই আন্দোলনকে অপসারিত করেন এবং মিশরীয় সভ্যতার প্রথাগত বহুদেববাদী ধর্মবিশ্বাসকে পুনরায় স্থাপন করেন। তারপর বড়ো মাপের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল আখেনাতেন, আতেনবাদী মন্দিরসমূহ ও সর্বোচ্চ দেবতা হিসেবে আতেনবাদী যে কোনও উল্লেখনা মিশর ও মিশরের নথিপত্র থেকে অপসারণ করার জন্য

আমারনায় চুনাপাথরের খোদাইচিত্রে আখেনাতেননেফারতিতি এবং তাঁদের সন্তানবর্গ আতেনের পূজা করছেন; আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১৩৭২-১৩৫৫ অব্দ।

আখেনাতেনের পূর্বে আতেনের ইতিহাস সম্পাদনা

আতেন (মিশরীয়: jtn) শব্দটির অর্থ "বৃত্ত", "চাকতি" এবং পরবর্তীকালে "সৌর চাকতি"। শব্দটি প্রথম পাওয়া যায় খ্রিস্টপূর্ব চতুর্বিংশ শতাব্দীর আবুসির প্যাপিরাই-তে, যা পঞ্চম রাজবংশের ফ্যারাও নেফেরিইকারে কাকাই-এর শবাগার মন্দিরে।[৬] আতেনবাদের দেবতা আতেন প্রথম এক দেবতা হিসেবে উল্লিখিত হন দ্বাদশ রাজবংশের সমসাময়িক সিনুহে উপাখ্যান-এ।[৭] মধ্য রাজ্যের শাসনকালে আতেন "সৌরচাকতি রূপে… নিছকই ছিলেন সূর্যদেবতা রে-এর একটি অবয়ব।"[৫] আতেন ছিলেন আপেক্ষিকভাবে এক অস্পষ্ট সৌরদেবতা; আতেনীয় যুগ ছাড়া মিশরের ইতিহাসে এই দেবতাটিকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। যদিও এনম ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, অষ্টবিংশ রাজবংশের যুগে আতেন খানিকটা মর্যাদা অর্জন করেছিলেন। বিশেষত ফ্যারাও তৃতীয় আমেনহোতেপ শাসনকালে তাঁর রাজকীয় বজরার নামকরণ করেছিলেন আতেনের আত্মা। তবু মিশরের একমাত্র দেবতা হিসেবে আতেনকে প্রতিষ্ঠা করার যে বিপ্লবাত্মক ক্রিয়াকাণ্ড তা সূচিত হয় চতুর্থ আমেনহোতেপের আমলেই। যদিও আখেনাতেনের রাজত্বকালের আগে প্রত্যেক রাজবংশই[৫] একজন করে দেবতাকে রাজকীয় রক্ষাকর্তা ও সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় দেবতা হিসেবে গ্রহণ করতেন। কিন্তু কেউই অন্য দেবতাদের সম্পূর্ণ বাদ দিতেন না। এবং সেই কারণে অনেক সংখ্যক দেবদেবীর পূজা প্রচলিত ও স্বীকৃত ছিল। চতুর্থ থুতমোসিসের রাজত্বকালে, আতেন এক স্বতন্ত্র সৌরদেবতার মর্যাদা পান এবং চতুর্থ থুতমোসিসের পুত্র তৃতীয় আমেনহোতেপ আতেনের এক পৃথক কাল্ট প্রতিষ্ঠা ও প্রচার করেন। অবশ্য এমন কোনও প্রমাণ পাওয়া যায় না যে, তৃতীয় আমেনহোতেপ অন্যান্য দেবদেবীদের অবহেলা করে আতেনকেই একমাত্র দেবতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছিলেন।

আতেনবাদী মিশর সম্পাদনা

চতুর্থ আমেনহোতেপ তাঁর রাজত্বের পঞ্চম বর্ষে (খ্রিস্টপূর্ব ১৩৪৮/১৩৪৬ অব্দ) আতেনবাদের প্রবর্তন ঘটান। তিনিই আতেনকে সর্বোচ্চ দেবতার মর্যাদা প্রদান করেন। প্রথম দিকে তিনি প্রথাগত দেবদেবীদের পূজা চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন।[৫] পরবর্তীকালে আখেনাতেন অন্যান্য দেবদেবীর পূজা নিষিদ্ধ করেন। এই ঘটনা বহু শতাব্দী ধরে আচরিত মিশরীয় ধর্মীয় প্রথায় এক বিপ্লবাত্মক ব্যতিক্রম।[৮][৯] এই পরিবর্তনে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করার জন্য আতেনের নামটি কার্তুশ আকারে লেখা হয়েছিল, যে আকার সাধারণত রক্ষিত থাকত ফ্যারাওদের নামের ক্ষেত্রে। এইভাবে আতেনবাদ নামক নব্যতন্ত্রটি প্রবর্তিত হয়েছিল। এই ধর্মসংস্কারের সঙ্গে সঙ্গেই ঘোষিত হয়েছিল সেদ উৎসব নামে এক উৎসব। এই উৎসবটি ছিল রাজপদের উপর দৈবশক্তি দৃঢ়ভাবে আরোপ করার জন্য এক ধরনের রাজ্যাভিষেকপূর্তি। প্রথাগতভাবে এই উৎসবটি ফ্যারাওয়ের রাজত্বের ত্রিশতম বর্ষে আয়োজিত হত। এই উৎসবটি সম্ভবত ছিল তৃতীয় আমেনহোতেপের সম্মানে আয়োজিত উৎসব। কোনও কোনও মিশরতত্ত্ববিদ মনে করেন, তিনি চতুর্থ আমেনহোতেপের সঙ্গে ২-১২ বছর পর্যন্ত একত্রে রাজত্ব করেছিলেন।

 
সম্ভবত আমারনা যুগে দেবতা আমুনের নাম মুছে ফেলা হয়েছিল। মিশরের থিবসের আমুন মন্দিরের দ্বাররক্ষী দ্জেসেরকার স্টেলার বিবরণ থেকে। বর্তমানে লন্ডনের পেট্রি মিউজিয়াম অফ ইজিপশিয়ান আর্কিওলজিতে রক্ষিত।
 
তৃতীয় আমেনহোতেপের মূর্তির পশ্চাৎস্তম্ভের চিত্রলিপি। দু’টি স্থানে আখেনাতেনের কর্মচারীরা আমুনের নামটি মুছে দেন। পরে তা আবার এক গভীরতর পৃষ্ঠতলে পুনর্লিখিত হয়। ব্রিটিশ মিউজিয়াম, লন্ডন

মনে করা হয় যে, রাজত্বকালের পঞ্চম বর্ষেই চতুর্থ আমেনহোতেপ অধুনা আমারনা নামে পরিচিত স্থানে তাঁর নতুন রাজধানী আখেতাতেনের (আতেনের দিগন্ত) নির্মাণকার্য শুরু করেন। এমন প্রমাণ পাওয়া যায় যে, এই নতুন রাজধানীর সীমানা নির্ধারণের জন্য তিনটি সীমানির্দেশক স্টেলা ব্যবহার করা হয়েছিল। তারপর চতুর্থ আমেনহোতেপ নিজের নতুন ধর্মাচরণের পরিচায়ক হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে নিজের নাম পরিবর্তন করে রাখেন আখেনাতেন (আতেনের আত্মা)। এই ঘটনার তারিখ অনুমান করা হয়, সেই বছরের ২ জানুয়ারি। নিজের রাজত্বের সপ্তম বর্ষে (খ্রিস্টপূর্ব ১৩৪৬/১৩৪৪ অব্দ) রাজ্যের রাজধানী থিবস থেকে আখেতাতেনে স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু মনে করা হয় যে, শহরের নির্মাণকার্য শেষ হতে আরও দুই বছর সময় লেগেছিল। প্রথাগত অনুষ্ঠান-কেন্দ্রগুলি থেকে নিজের রাজসভাকে স্থানান্তরিত করার ক্ষেত্রে, তিনি ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রে এক নাটকীয় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।

এই রাজধানী স্থানান্তরণের ঘটনাটি ফ্যারাও ও তাঁর রাজসভাকে পুরোহিতবর্গ ও প্রথাগত উপাসনাকেন্দ্রগুলি থেকে পৃথক করে দেয়, কিন্তু তাঁর অধ্যাদেশগুলির গভীরতর ধর্মীয় গুরুত্বও ছিল। ফ্যারাওয়ের নিজের নাম পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে এমনও বলা যেতে পারে যে আরমানায় রাজধানী পরিবর্তনও আখেনাতেনের প্রতীকী মৃত্যু ও পুনর্জন্মের একটি সংকেত। এটি তাঁর মৃত্যু ও যৌথ-শাসনকার্যের অবসানেরও দ্যোতক হতে পারে। আতেনের সম্মানে নতুন রাজধানী স্থাপনের পাশাপাশি আখেনাতেন প্রাচীন মিশরের বৃহত্তর মন্দির চত্বরগুলির মধ্যে কয়েকটি নির্মাণ করেছিলেন। এগুলির মধ্যে একটি ছিল কারনাকে এবং আরেকটি ছিল থিবসে আমুনের পুরনো মন্দিরের নিকটে।

 
আমেনেমহাতের অন্ত্যেষ্টি-ফলক থেকে দেবতা আমুনের নাম আখেনাতেনের কর্মচারীরা মুছে দিয়েছিলেন। চুনাপাথর, চিত্রিত। মিশর, অষ্টাদশ রাজবংশের প্রথম ভাগ। দ্য বারেল কালেকশোন, গ্লাসগো

নিজ রাজত্বের নবম বর্ষে (খ্রিস্টপূর্ব ১৩৪৪/১৩৪২ অব্দ) আখেনাতেন তাঁর নতুন ধর্মের এক অধিকতর বিপ্লবাত্মক রূপকে সামনে আনেন। তিনি আতেনকে শুধুমাত্র মিশরীয় দেবমণ্ডলীর সর্বোচ্চ দেবতাই নয়, বরং মিশরের একমাত্র দেবতা এবং নিজেকে আতেন ও মিশরীয় জনগণের মধ্যে একমাত্র যোগাযোগরক্ষাকারী বলে ঘোষণা করেন। আতেনবাদের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল আতেনের মূর্তি ও অন্যান্য চিত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ। ব্যতিক্রম ছিল একটি রশ্মিযুক্ত সৌরচাকতি, যাতে রশ্মিগুলি (সাধারণত সেগুলির শেষভাগে হাত দেখা যেত) ছিল আতেনের অদৃশ্য আত্মার প্রতীক। আখেনাতেন আতেনের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা জানাতেন। এই রকমই একটি প্রার্থনা হল গ্রেট হিম টু দি আতেন: "হে একমাত্র ঈশ্বর, যাঁর পাশে আর কেউ নেই"। ফ্যারাওয়ের শাসনকালের নবম বর্ষের পরে নতুন রাজত্বের বিপ্লবাত্মক চিন্তাধারার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করার জন্য আতেনের নামটি ভিন্নভাবে লেখা হত। রশ্মিযুক্ত সৌরচাকতির প্রতীকের মাধ্যমে লেখার পরিবর্তে আতেনের নামটি উচ্চারণধ্বনির মাধ্যমে লেখা হত।

আতেনবাদী ধর্মতত্ত্ব এখনও অস্পষ্ট রয়ে গিয়েছে। একমাত্র দেবতা ছাড়া অন্য দেবতার উপাসনায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং মূর্তিপূজা নিষিদ্ধকরণ মিশরের সনাতন প্রথার এক বিপ্লবাত্মক ব্যতিক্রম। কিন্তু কোনও কোনও গবেষকের মতে, আখেনাতেন ছিলেন মনোলেট্রি বা হেনোথেইজমের অনুশীলনকারী, একেশ্বররবাদের নয়। কারণ তিনি সক্রিয়ভাবে অন্যান্য দেবতাদের অস্তিত্ব অস্বীকার করেননি। তিনি শুধুমাত্র আতেন ভিন্ন অন্য দেবতাদের পূজায় নিষিদ্ধ করেছিলেন। এই সংস্কারগুলি পরবর্তীকালে তাঁর উত্তরসূরি ফ্যারাও তুতানখামুন বাতিল করে দেন।[৮][১০]

কোনও কোনও ইতিহাসবিদ মনে করেন যে, কেবলমাত্র আখেনাতেন ও নেফারতিতিই সরাসরি আতেনকে পূজা করতে পারতেন।[৯]

প্রথাগত মিশরীয় ধর্মের থেকে পার্থক্য সম্পাদনা

আখেনাতেন ধর্মীয় সংস্কারের এক বিপ্লবাত্মক কর্মসূচি সম্পাদনা করেছিলেন। প্রায় কুড়ি বছর ধরে তিনি মিশরের রাষ্ট্রীয় ধর্মের বহু যুগ ধরে আচরিত বিশ্বাস ও রীতিনীতিগুলির পরিবর্তন ঘটিয়েছিলেন এবং থিবসে আমুনের শক্তিশালী পুরোহিতবর্গকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। পনেরো শতাব্দী ধরে মিশরীয়রা দেবদেবীদের এক সুবিস্তীর্ণ পরিবারকে পূজা করে এসেছিল। এই প্রত্যেক দেবদেবীরই পুরোহিতবর্গ, মন্দির, পূজাস্থান ও অনুষ্ঠানপদ্ধতির এক নিজস্ব বিস্তারিত ব্যবস্থা ছিল। কাল্টগুলির একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল দেবদেবীদের মূর্তি ও ছবির পূজা। এই পূজা অনুষ্ঠিত হত মন্দিরগুলির অন্ধকার সীমার মধ্যে।

ধর্মীয় পদমর্যাদাক্রমের শিখরে ছিলেন ফ্যারাও – যিনি একাধারে ছিলেন রাজা ও জীবন্ত দেবতা। মিশরীয় রাজ্যের প্রশাসন এই কারণে অচ্ছেদ্যভাবে ও ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট ছিল এবং নিয়ন্ত্রিত হত প্রধানত পুরোহিতবর্গ ও লিপিকরদের ক্ষমতা ও প্রভাবের মাধ্যমে। আখেনাতেনের সংস্কারগুলি পুরোহিতশক্তির দার্শনিক ও অর্থনৈতিক ভিত্তিটিকে ছিন্ন করে দেয়, অন্য সকল দেবদেবীর কাল্টকে অবলুপ্ত করে এবং সেই সঙ্গেই পুরোহিতবর্গ বলিদান প্রথা ও দক্ষিণা গ্রহণের যে বিশাল ও লোভনীয় ব্যবসা গড়ে তুলেছিলেন তাও বিনষ্ট করেন।

একই সঙ্গে তিনি ফ্যারাওয়ের ভূমিকাকে আরও শক্তিশালী করে তোলেন। আতেনের উদ্দেশ্যে রচিত স্তোত্রাবলির বিভিন্ন সংস্করণ বিশ্লেষণ করে ডোমিনিক মন্টসেরাট বলেছেন যে, স্তোত্রগুলির প্রতিটি সংস্করণেই আলোকপাত করা হয়েছে রাজার প্রতি। তিনি মনে করেন যে, ফ্যারাওয়ের প্রকৃত নব্যধারাটি ছিল দেবতা ও রাজার সম্পর্ককে এমন একভাবে নতুন সংজ্ঞা প্রদান করা যা আখেনাতেনকেই সুবিধা প্রদান করতে পারে। মিশরতত্ত্ববিদ জন বেইনেসের কথা উদ্ধৃত করে বলা যায়: "আমারনা ধর্ম ছিল দেবতা ও রাজার এক ধর্ম, এমনকি [এভাবেও বলা যায়] প্রথমে রাজার ও তারপর দেবতা[র ধর্ম]"।[১১][১২]

প্রথম দিকে আখেনাতেন আতেনকে মিশরীয় জাতির কাছে উপস্থাপনা করেছিলেন পরিচিত সর্বোচ্চ দেবতা আমুন-রা-এর এক রূপান্তর হিসেবে (এটি আবার ছিল ইতিপূর্বে আমুনের কাল্টের প্রাধান্য বৃদ্ধির ফলশ্রুতি, এরই ফলে আমুন সৌরদেবতা রা-এর সঙ্গে মিশে যান)। ফ্যারাও এই কাজটি করেছিলেন পরিচিত ধর্মীয় প্রেক্ষাপটের সঙ্গে নিজের ধ্যানধারণাকে মিলিত করার জন্য। 'আতেন' নামটি দেওয়া হয়েছিল সৌরচাকতিকে। আখেনাতেনের দেবতার পরিপূর্ণ উপাধিটি ছিল "রা-হোরাস, যিনি নিজের আলোকের নামে দিগন্তকে আহ্লাদিত করেন, যে আলোক হল সৌরচাকতি"। (সৌরদেবতার এই নামটি আখেনাতেনের নতুন রাজধানী আখেতাতেনের সীমানানির্দেশক অসংখ্য ফলকে পাওয়া যায়।)

যদিও রাজত্বের নবম বর্ষে আখেনাতেন নিজের নতুন ধর্মের আরও বিপ্লবাত্মক একটি রূপকে সামনে আনেন। তিনি ঘোষণা করেন যে, আতেন শুধুমাত্র সর্বোচ্চ দেবতাই নন, বরং তিনিই একমাত্র দেবতা এবং আতেনের পুত্র রূপে আখেনাতেনই হলেন আতেন ও তাঁর জাতির মধ্যে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম।[১৩] তিনি সারা মিশর জুড়ে আমুনের মন্দিরগুলির বিকৃতিসাধনের নির্দেশ দেন। আতেনবাদের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলির অন্যতম ছিল আতেনের মূর্তি বা অন্যান্য চিত্রের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ। কেবল একটি রশ্মিযুক্ত সৌরচাকতিকে আতেনের প্রতীক গণ্য করা হত। এই চাকতির শেষভাগের রশ্মিগুলি ছিল হস্তাকৃতি, যা সম্ভবত ছিল আতেনের অদৃশ্য আত্মার প্রতীক। পরে অবশ্য এই চিহ্নও পরিহার করা হয়।[১৪][১৫]

আমারনা শিল্পকলা সম্পাদনা

 
খোদাইচিত্রে আতেনের আলোকরশ্মির তলায় আখেনাতেন ও নেফারতিতি এবং তাঁদের তিন কন্যা

এই সংক্ষিপ্ত সময়কালের মধ্যে শিল্পকলার যে শৈলীর বিকাশ ঘটেছিল, তা মিশরীয় শিল্পকলার অন্যান্য যুগের থেকে লক্ষণীয়ভাবে অন্যরকম। এর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের কৃত্রিমতা লক্ষিত হয়। যার মধ্যে রয়েছে দীর্ঘায়িত মস্তক থেকে প্রলম্বিত উদর, অতিরঞ্জিত অসৌন্দর্য এবং নেফারতিতির সৌন্দর্য। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য এই যে, মিশরীয় রাজকীয় শিল্পকলার ইতিহাসে এই একমাত্র ক্ষেত্রেই আখেনাতেনের পরিবারকে এক সুস্পষ্ট রকমের বাস্তবসম্মত পদ্ধতিতে চিত্রায়িত করা হয়েছিল। এর মধ্যে পারিবারিক স্নেহবন্ধন সুন্দরভাবে বিধৃত হয়েছিল।

আখেনাতেন ও নেফারতিতির ছবিগুলিতে আতেনকে এই যুগলের উপর লক্ষণীয়ভাবে দেখা যায়। আতেনের চিহ্নের হাতগুলিকে দেখা যায় উভয়কে আংখ প্রদান করছেন। নতুন রাজ্যের শিল্পকলায় রীতির বিপরীতে এখানে ফ্যারাও ও তাঁর পত্নীকে প্রায় একই আকারে চিত্রিত করতে দেখা যায়। নেফারতিতির ছবি আমারনার অপ্রধান আতেন মন্দিরগুলিকে শোভিত করতেও দেখা যায়। আতেনের পূজায় নেফারতিতির একটি গুরুত্বপূর্ণ আনুষ্ঠানিক ভূমিকার এটি একটি সম্ভাব্য ইঙ্গিত।

আখেনাতেনের শৈল্পিক উপস্থাপনাতে তাঁর এক অস্বাভাবিক গড়ন দেখা যায় – সরু অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, লম্বোদর ও চওড়া পশ্চাদ্দেশ। আরমানা যুগের অন্যান্য অগ্রণী ব্যক্তিবর্গের (রাজপরিবার বা অন্য পরিবার) ক্ষেত্রেও একই বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। এটি সম্ভবত একটি ধর্মীয় যোগের লক্ষণ। বিশেষত, কোনও কোনও সূত্র থেকে এমন ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে রাজকীয় শিল্পকলার রীতির বিপরীতে আখেনাতেনের এহেন চিত্রায়ন তাঁকে খুব স্বাভাবিক দেখানোর একটি প্রয়াস। ব্রায়ার বব তাঁর দ্য মার্ডার অফ তুতানখামেন গ্রন্থে বলেছেন যে, এই পরিবার সম্ভবত মারফান’স সিন্ড্রোমের শিকার হয়েছিল। যারই ফলে ফ্যারাওয়ের দেহে এই দীর্ঘায়িত লক্ষণগুলি দেখা যায়।

পতন সম্পাদনা

 
আতেন

আতেনবাদের পতনের সূত্রপাত ঘটে আখেনাতেনের রাজত্বকালের শেষভাগে যখন প্রাচীন নিকট প্রাচ্য জুড়ে এক অতিমারী ছড়িয়ে পড়েছিল। দাবি করা হয় যে, এই অতিমারীর ফলে রাজপরিবারের অনেক সদস্য ও অনেক উচ্চ-পদস্থ আধিকারিকের জীবনহানি ঘটেছিল এবং সম্ভবত তা থেকেই আখেনাতেনের সরকারের পতন সূচিত হয়েছিল। প্রাপ্ত উৎসসূত্রের স্বল্পতা ও অসম্পূর্ণতার জন্য এই পর্যায়ের ঘটনাবলির সম্পূর্ণ ইতিহাস জানা যায় না। খুব সম্ভবত অতিমারীর ফলে বহু সংখ্যক লোকের মৃত্যুর ফলে আখেনাতেন দ্রুত উত্তরাধিকার হিসেবে দু’জন রাজপ্রতিভূ নিযুক্ত করেন: স্মেঙ্খকারেনেফারনেফারুয়াতেন। এই দুই ব্যক্তি আসলে কে তা সঠিক জানা যায় না। তবে অনুমান করা হয় যে স্মেঙ্খকারে ছিলেন আখেনাতেনের ছোটো ভাই এবং নেফারনেফারুয়াতেন ছিলেন বাস্তবে রানি নেফারতিতি স্বয়ং। অল্পকাল রাজত্ব করার পরি স্মেঙ্খকারে মারা যান। ক্রমে নেফারনেফারুয়াতেনই হয়ে ওঠেন মিশরের একমাত্র সক্রিয় রাজপ্রতিভূ।[১৬]

আখেনাতেনের রাজত্বের শেষ বছরগুলিতে আমুন ও সম্ভবত অল্পক্ষেত্রে অন্য দেবতাদের উপাসকদের উপর নিপীড়ন বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পরই পুরনো কাল্টগুলির পুনরুত্থান ঘটতে শুরু করে। নেফারনেফারুয়াতেন মনে হয় আমুনের পুরোহিতবর্গের সঙ্গে কিছুটা সমঝোতা করে নেন, যদিও আতেনবাদের একটি স্বল্পতর মাত্রার রূপকে ধরে রাখেন।[১৭] যদিও কয়েক বছর পরই নেফারনেফারুয়াতেন ইতিহাসের পৃষ্ঠা থেকে অন্তর্হিত হন। তাঁর উত্তরসূরি তুতাতখাতেন (আখেনাতেনের পুরনো উজির তথা রাজপ্রতিভূ আয়ের সঙ্গে) নিজের রাজত্বকালের তৃতীয় বর্ষে (খ্রিস্টপূর্ব ১৩৩০ অব্দ) নিজের নাম পরিবর্তন করে রাখেন তুতানখামুন। তিনি আমুনের পুরোহিতবর্গকে পুনঃস্থাপিত করেন এবং রাজধানী স্থানান্তরিত করে আনেন মেমফিস অথবা কম সম্ভবত থিবসে।[১৭]

পরবর্তী দুই দশকে আতেনবাদের আনুষ্ঠানিক পতন দৃষ্ট হয়। আখেনাতেন যে মন্দিরগুলি নির্মাণ করেছিলেন সেগুলির অধিকাংশই নির্মিত হয়েছিল টালাটাট ব্লক দিয়ে। এই ধরনের মন্দিরের অন্যতম নিদর্শন ছিল থিবস। এগুলির বিভিন্ন অংশ খুলে নিয়ে অন্যান্য মন্দিরের নির্মাণ উপাদান বা শোভিতকরণের কাজে ব্যবহার করা হয়। সেই সঙ্গে আতেনের শিলাখেলগুলিও মুছে ফেলা হয়। আখেতাতেন সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত হয়নি। স্থানীয় আতেন মন্দিরেও পূজানুষ্ঠান অব্যাহত থাকে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই শহরের অধিকাংশ বাসিন্দাই স্থানত্যাগ করেন। তুতানখামুনের মৃত্যুর পর নিজ গুণে ফ্যারাও হিসেবে অল্পকাল রাজত্ব করেন আয়। তারপর তাঁর সেনাধ্যক্ষ তথা রাজপরিবার-বহির্ভূত ব্যক্তি হোরেমহেব ক্ষমতায় আসেন। তিনি আমারনা যুগের শাসকদের নাম মুছে ফেলার উদ্যোগ নেন। ফ্যারাওদের সরকারি তালিকা থেকে আখেনাতেন, স্মেঙ্খকারে, নেফারনেফারুয়াতেন, তুতানখামুন ও আয়ের নাম বাদ দেওয়া হয়, তাঁদের স্মারকগুলি ও অধিকাংশ অবশিষ্ট আতেন মন্দির ধ্বংস করে ফেলা হয়।[১৮] তা সত্ত্বেও হোরেমহেবের রাজত্বের প্রথমদিকের বছরগুলিতে আখেতাতেনের আতেন মন্দিরটি সক্রিয় ছিল। এর থেকে অনুমিত হয় যে, আমারনা যুগের শাসকদের নাম মুছে ফেলার এই উদ্যোগটি সর্বজনীন ছিল না। হয়তো মিশরে অল্প কয়েকটি স্থানে আতেনবাদের অস্তিত্ব বজায় থেকেই গিয়েছিল।[১৯]

যদিও এই ঘটনাই কার্যতভাবে আতেনবাদের সমাপ্তি নির্দেশ করেছিল, তবু প্রাচীন মিশরীয় ধর্মে এই বিপ্লবাত্মক কাল্টের কিছু দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব বজায় ছিল। উদাহরণস্বরূপ, আমারনা যুগে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় আনীত কিছু পরিবর্তন হোরেমহেব ও তাঁর উত্তরসূরিদের ক্ষেত্রেও প্রযুক্ত হয়েছিল।[২০]

আব্রাহামীয় একেশ্বরবাদের সঙ্গে যোগসূত্র সম্পাদনা

আতেনবাদের মনোল্যাট্রিস্টিক অথবা একেশ্বরবাদী চরিত্রের জন্য অনেক লেখকই মনে করেন যে ইহুদি ধর্মের (বা অন্যান্য একেশ্বরবাদী ধর্ম) সঙ্গে আতেনবাদের একটি যোগসূত্র বিদ্যমান। উদাহরণস্বরূপ, মনঃসমীক্ষক সিগমন্ড ফ্রয়েড তাঁর মোজেস অ্যান্ড মনোথেইজম গ্রন্থে অনুমান করেছেন যে, আখেনাতেন ছিলেন একেশ্বরবাদী ধর্মের অগ্রণী পুরুষ এবং মোজেস ছিলেন আখেনাতেনের অনুগামী।

আধুন দ্রুজ ধর্মের অনুগামীরা মনে করেন যে, তাঁদের ধর্ম আতেনবাদ সব প্রাচীনতর একেশ্বরবাদী ও রহস্যবাদী ধর্মীয় আন্দোলনগুলির উত্তরসূরি এবং সেগুলি থেকে উৎসারিত।[২১] বিশেষত তাঁরা তাওহিদে উল্লিখিত আখেনাতেনের প্রথম সাধারণ ঘোষণাটির কথা উল্লেখ করেন।[২২]

জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে সম্পাদনা

  • ব্রিটিশ লেখিকা আগাথা ক্রিস্টি ১৯৩৭ সালে আখেনাতেন নামে একটি নাটক রচনা করেন। নাটকটির কেন্দ্রীয় চরিত্রেরা ছিলেন ফ্যারাও আখেনাতেন, তাঁর পত্নী নেফারতিতি ও তাঁদের উত্তরসূরি তুতাঙ্খনাতোন (পরে যিনি তুতানখানুম নাম গ্রহণ করেছিলেন)। নাটকটি রচনার ক্ষেত্রে গবেষণার জন্য ক্রিস্টি মিশরতত্ত্ববিদ স্টিফেন গ্ল্যানভিলের সাহায্য গ্রহণ করেন।[২৩]

আরও দেখুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Dodson 2016, পৃ. 204, Cairo; New York City।
  2. Assmann 2004, পৃ. 180, Leiden; Boston।
  3. Ridley 2019, Cairo; New York।
  4. Darnell, J. C., & Manassa, C. (2007). Tutankhamun's Armies: Battle and conquest during ancient Egypt's Late Eighteenth Dynasty. John Wiley & Sons.
  5. David (1998), p. 124. উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; আলাদা বিষয়বস্তুর সঙ্গে "FOOTNOTEDavid1998" নামটি একাধিক বার সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে
  6. Redford 1976, পৃ. 47, Alexandria, Virginia; Cairo।
  7. Petrie, William Matthew Flinders (২০১৩), "The Adventures of Sanehat", Egyptian Tales, Cambridge: Cambridge University Press, পৃষ্ঠা 97–142, আইএসবিএন 978-1-107-32520-3, ডিওআই:10.1017/cbo9781107325203.005, সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৩-০৯ 
  8. Brewer, Douglas j.; Emily Teeter (২২ ফেব্রুয়ারি ২০০৭)। Egypt and the Egyptians (2nd সংস্করণ)। Cambridge University Press। পৃষ্ঠা 105। আইএসবিএন 978-0-521-85150-3 
  9. Hart, George (২০০৫)। The Routledge dictionary of Egyptian gods and goddesses  (2nd সংস্করণ)। Routledge। পৃষ্ঠা 39আইএসবিএন 978-0-415-34495-1 
  10. Simson Najovits, Egypt, the Trunk of the Tree. A Modern Survey of an Ancient Land, II, New York, 2004, pp. 132-136.
  11. Montserrat, Dominic (২০০২)। Akhenaten: History, fantasy and ancient Egypt। Routledge। পৃষ্ঠা 40। আইএসবিএন 978-0415301862 
  12. Baines, John (১৯৯৮)। "The Dawn of the Amarna Age"। O'Connor, David; Cline, Eric। Amenhotep III: Perspectives on his reign। University of Michigan Press। পৃষ্ঠা 281। 
  13. Reeves, Nicholas (২০০৫)। Akhenaton: Egypt's false prophet। পৃষ্ঠা 146। আইএসবিএন 0-500-28552-7 
  14. Brewer, Douglas J.; Teeter, Emily (২২ ফেব্রুয়ারি ২০০৭)। Egypt and the Egyptians (2nd সংস্করণ)। Cambridge University Press। পৃষ্ঠা 105। আইএসবিএন 978-0-521-85150-3 
  15. Najovits, Simson (২০০৪)। Egypt, the Trunk of the Tree. A modern survey of an ancient landII। New York, NY। পৃষ্ঠা 132-136 
  16. Dodson (2016), pp. 143–146.
  17. Dodson (2016), pp. 144–146.
  18. Dodson (2016), pp. 146–150.
  19. Dodson (2016), p. 150.
  20. Dodson (2016), p. 151.
  21. Obeid & Ubayd (2006), p. 96.
  22. Obeid & Ubayd (2006), pp. 96, 139.
  23. "Akhnaton - Play by Agatha Christie"www.agathachristie.com (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১০-১৩ 

উল্লেখপঞ্জি সম্পাদনা

আরও পড়ুন সম্পাদনা

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা

  •   উইকিসংকলনে আতেনবাদ সম্পর্কিত কর্ম দেখুন।

টেমপ্লেট:Paganism

টেমপ্লেট:আমারনা যুগ

]