আতাউল হাকিম
ড. আতাউল হাকিম (১৮৯৪-১৯৬৯) ভারতীয় উপমহাদেশের অবিভক্ত বাংলার একজন মুসলিম শিক্ষাবিদ, গণিতবিদ, হোমিওপ্যাথি গবেষক ছিলেন।[১] তিনি গোটা উপমহাদেশের প্রথম মুসলিম গণিত বিশেষজ্ঞ-বিশারদ ছিলেন।[২][৩] তিনি কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের শিক্ষক ছিলেন। তিনি দাড়ি কামানোর ফলে ব্রিটিশ ভারতের আইসিএস পরীক্ষার্থীর তালিকায় যোগদানের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। তার লেখা বই দ্য আরব ম্যাথমেটিকস আরব গণিতবিদদের নিয়ে লেখা মূল্যবান একটি কর্ম।[৪][৫]
ড. আতাউল হাকিম | |
---|---|
জন্ম | ১ জানুয়ারি ১৮৯৪ |
মৃত্যু | ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৬৯ | (বয়স ৭৫)
জাতীয়তা | বাংলাদেশী |
মাতৃশিক্ষায়তন |
|
উল্লেখযোগ্য কর্ম |
|
দাম্পত্য সঙ্গী | খুরশেদ আরা হাকিম |
বাল্যকাল ও শিক্ষাজীবন
সম্পাদনাআতাউল হাকিম ১৮৯৪ সালের ১ জানুয়ারি তৎকালীন বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার নাইখাইন গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ছিলো মুন্সি চাঁদ মিয়া।
আতাউল হাকিম বাল্যশিক্ষা গ্রহণ করেন তার গ্রামের গৌরচন্দ্র ভিক্ষু নামক এক পণ্ডিতের নিকট। এরপর তিনি প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের জন্য স্থানীয় গৈড়লা আপার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হোন। তিনি এখান থেকে ১৯০৬ সালে মেধা বৃত্তি পান, এরপর ১৯০৭ সালে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হোন নিকটবর্তী এ এস রাহাত আলী উচ্চবিদ্যালয়ে। কিন্তু এখানে মাত্র এক বছর পরার পরেই আবার পটিয়া আদর্শ বিদ্যালয়ে ভর্তি হোন, তিনি এখানে ৭ম ও ৮ম শ্রেণী পড়েন।[২] এরপর তিনি ১৯১১ সালে চট্টগ্রাম সরকারি মোহসেনিয়া মাদ্রাসার (তৎকালীন চট্টগ্রাম ওল্ড স্কিম মাদ্রাসা, বর্তমানে সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ, চট্টগ্রাম) অ্যাংলো পার্সিয়ান বিভাগ থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন। এরপর চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ১৯১৩ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাশ ও ১৯১৫ সালে বিএ পাশ করেন।
এরপর উচ্চ শিক্ষার জন্য কলকাতা শহরে আসেন, ১৯১৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অঙ্কশাস্ত্রে এমএ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান দখল করেন। ১৯১৯ সালে তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে আরবি বিভাগেও এমএ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ, সোহরাওয়ার্দী প্রথম স্থান ও তিনি দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন। তিনি ১৯৪২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন, তার পিএইচডি গবেষণা কর্মের নাম ‘দ্য আরব ম্যাথমেটিকস’। তিনি প্রায় ২২ বছর গবেষণা এই পিএইচডি গবেষণাপত্র তৈরি করেন, বইটি ৩,৭০৬ পৃষ্ঠা সমৃদ্ধের সহিত ৪টি খণ্ডে বিভক্ত ছিলো। এই বইতে তিনি আরব দেশের প্রায় ৩৫০০ গণিত ব্যক্তিদের জীবন ও কর্ম নিয়ে আলোচনা করেছেন।[৬] তিনিই অবিভক্ত বাংলার প্রথম মুসলিম পিএইচডি ডিগ্রিধারী ব্যক্তি ছিলেন, ১৯৪৩ সালের ১৪ মার্চ কলকাতায় প্রবাসী চট্টগ্রামের বাসিন্দারা এই পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের জন্য সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।[৭]
তিনি হোমিওপ্যাথি নিয়েও পড়াশোনা করেছেন, ১৯৪৯ সালে হোমিওপ্যাথি বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক এক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে সমগ্র পাকিস্তানে প্রথম স্থান দখল করেন। এছাড়াও তিনি হোমিওপ্যাথিক সোসাইটির অনারারি ফেলোশিপ বৃত্তি অর্জন করেন।
কর্মজীবন
সম্পাদনাআতাউল হাকিম অবিভক্ত বাংলা, পূর্ব পাকিস্তানসহ নানা স্থানের শিক্ষাবিভাগে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছে। তিনি ১৯১৮ সালে এমএ পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হবার পূর্বেই চট্টগ্রাম কলেজের প্রভাষক পদে যোগদান করেন। এরপর ১৯২০ সালে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে গণিত বিভাগে যোগদান করেন, পরে তিনি কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করার পরে তিনি পূর্ব বাংলায় আসেন এবং রাজশাহী রেঞ্জের বিভাগীয় স্কুল পরিদর্শকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি এখানে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালনের পরে দুই বছর অবসর ছুটি কাটান। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের রিডার পদে যোগদান করেন, এবং তিনি এই বিভাগের অধ্যাপক হন। পরে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগের প্রধান হোন।
তার সম্পর্কে জ্ঞাত রয়েছে, ব্রিটিশ ভারতের আইসিএস পরীক্ষার্থীর তালিকায়, দাড়ি কামিয়ে ফেলা ও লাল টুপি পরা পরিহার করার বিনিময়ে তার নাম প্রথম প্রস্তাব করা হয়েছিলো। কিন্তু তিনি সেটা প্রত্যাখান করেন।
গ্রন্থপঞ্জি
সম্পাদনাআতাউল হাকিম গণিত ও হোমিওপ্যাথি বিষয়ে বহু বই লিখেছেন, এসব বইয়ের কিছু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতির গণিত বিভাগে পড়ানো হয়। তিনি তার লেখা ‘দ্য আরব ম্যাথমেটিকস’ অভিসন্দর্ভের একটি কপি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ছাপানোর জন্য দেন, পরবর্তীতে সেটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা থেকে বের করা হয়। তিনি হোমিওপ্যাথি বিষয়ের উপর ৪৫০ পৃষ্ঠার ম্যাটেরিয়া মেডিকা নামক একটি বই রচনা করেন।
অবদান
সম্পাদনাআতাউল হাকিম নিজের কর্মজীবনের পাশাপাশি বহু মাদ্রাসা, স্কুল-কলেজের প্রতিষ্ঠায় যোগান দিয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের বহু শিক্ষার্থীরাকে বিনামূল্যে পড়াশোনার সুযোগ করে দিয়েছে, এমনকি তার নামে অনেক প্রতিষ্ঠানে অনুপ্রেরণামূলক বৃত্তির ব্যবস্থা ছিলো। তিনি ব্যক্তিগত জীবনে ধর্ম পালনের সর্বোচ্চ চেষ্টা করতেন, এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় অগ্রনী ভূমিকা রেখেছেন। তার সাথে শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, ড. শ্যামা প্রসাদ মুখার্জী প্রমুখ ব্যক্তির ব্যক্তিগত যোগাযোগ ও বন্ধুত্ব ছিলো।
১৯১২ সালে মুসলিম ছাত্রদের আর্থিক সহযোগিতার জন্য খান বাহাদুর মুহাম্মদ ইব্রাহিম, মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, আবদুল ওহাব চৌধুরী প্রমুখ ব্যক্তি চট্টগ্রাম মোসলেম ছাত্র সমিতি নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।[১০] এই সংগঠনটি নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডের জন্য প্রশংসিত ছিলো। হাকিম ১৯২৬ থেকে ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত সংগঠনটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এই সংগথনে অবদান রাখার জন্য তিনি ১৯৯৯ সালে মরণোত্তর ‘চট্টগ্রাম সমিতি পদক’ দেওয়া হয়।
উল্লেখযোগ্য ছাত্র
সম্পাদনাতিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাদান করার জন্য তার বহু শিক্ষার্থী রয়েছে। কিছু উল্লেখযোগ্য ছাত্র:
- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
- বিচারপতি মঞ্জুর মোর্শেদ
- ড. মুহাম্মদ শহীদুলাহ
- ড. কুদরত-ই-খুদা
- বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী
- নুরুল হক চৌধুরী
- ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম
- বিচারপতি মো. সায়েম
- অর্থনীতিবিদ ড. নুরুল ইসলাম
মৃত্যু
সম্পাদনাআতাউল হাকিম ১৯৬৯ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ইন্তেকাল করেন, তবে চট্টগ্রাম চরিতাভিধান তার মৃত্যুসাল ১৯৭৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর উল্লেখ করেছে।[১১]
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ Ataul Hakim (পিডিএফ)। ৩০ মে ২০২২ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২২ মে ২০২২।
- ↑ ক খ "পটিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়কে জাতীয়করণের দাবি"। jagonews24.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৫-২২।
- ↑ শামসুল হক, মুহাম্মদ (২০২১-১০-১২)। "উপমহাদেশের প্রথম মুসলিম গণিত বিশারদ ড. আতাউল হাকিম"। দৈনিক আজাদী। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৫-২২।
- ↑ Hakim, Ataul (১৯৪১)। The Arabs and Mathematics (ইংরেজি ভাষায়)। Islamia College।
- ↑ চট্টগ্রাম চরিতাভিধান, ড. সুনীতিভূষণ কানুনগো সম্পাদিত, ২০১২, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়।
- ↑ أحمد, نفيس (২০২০-০৮-০৮)। جهود المسلمين في الجغرافيا (আরবি ভাষায়)। وكالة الصحافة العربية।
- ↑ "পটিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করা হোক"। DailyInqilabOnline। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৫-২২।
- ↑ Hakim, Ataul (১৯৫০)। The Stereographic Projection of the Arabs (ইংরেজি ভাষায়)।
- ↑ Hakim, Ataul (১৯৫০)। Research Notes (ইংরেজি ভাষায়)।
- ↑ চট্টল মনীষা, আহমদ মমতাজ ও রাইহান নাসরীন সম্পাদিত - ২০১৩।
- ↑ "Dr Abdullah Faruque Dead"। The Daily Star (ইংরেজি ভাষায়)। ১৯৯৭-০৭-২০। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৫-২২।