অস্থি কলা মেরুদণ্ডী প্রাণীদের দেহের অস্থিনির্মিত অন্তঃ কঙ্কাল গঠনকারী একটি কঠিন যোজক কলা (অন্যান্য কঠিন যোজক কলার উদাহরণ হল হাড়ের কিছু অংশের তরুণাস্থি ও দাঁতের ডেন্টিন, সিমেন্ট এবং এনামেল)। অস্থি অর্থাৎ হাড়। এক একটি হাড় বা অস্থি একেকটি অঙ্গ। কিন্তু সেই অঙ্গের মধ্যে অনেক রকম কলা আছে। এদের মধ্যে কঠিন অংশ অস্থি কলা দিয়ে তৈরী। কিন্তু এছাড়াও থাকে কঠিন কিন্তু অস্থির থেকে অপেক্ষাকৃত নরম অংশ তরুণাস্থি কলা, হাড়ের ফাঁপা অংশের ভিতরে অস্থিমজ্জা যা মানবশরীরের প্রধান হিমাটোপোয়েটিক বা রক্ত উৎপাদনকারী কলা, এবং হাড়ের বাইরের আবরণ পেরিঅস্টিয়াম ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের কলা।

অস্থিকলা

অস্থিকলার মধ্যে কোষের থেকে ধাত্র বেশি। এবং এই ধাত্র খনিজ কেলাসাদি দ্বারা অস্মীভূত হয়ে অস্থিকে কাঠিন্য দেয়। সাধারণতঃ অন্তঃকঙ্কাল ভ্রুণ অবস্থায় তরুণাস্থি কলা হিসাবে প্রথমে তৈরি হয় এবং বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তার কিছু কিছু অংশ অস্থি দ্বারা প্রতিস্থাপিত হতে থাকে।

অস্থি কলার কোষ সম্পাদনা

অস্থি কলায় নিম্ন লিখিত রকম কোষ দেখা যায়ঃ

  1. অস্টিওব্লাস্ট (জায়মান অস্থিকোষ, একটি করে নিউক্লিয়াস, কোষ বিভাজনে অক্ষম)
  2. অস্টিওসাইট (পরিণত অস্থিকোষ, একটি নিউক্লিয়াস, বিভাজনে অক্ষম)
  3. অস্টিওক্লাস্ট (অস্থি-বিগলক কোষ, বহু নিউক্লিয়াস)
  4. অস্থি-আবরক কোষ (বোন লাইনিং সেল)
  5. অস্টিওসাইট প্রোজেনিটর বা প্রাক-অস্থি কোষ যারা অস্টিওব্লাস্ট অথবা তরুণাস্থি কোষ দুইতেই রূপান্তরিত হতে পারে, বিভাজনক্ষম।

অস্থিকলার ধাত্র সম্পাদনা

 
হ্যাভারসিয়ান সিস্টেম

অস্থিকলার কঠীন ধাত্র ধাপে ধাপে তৈরি হয়। অস্থি তৈরির প্রথম ধাপে তরুণাস্থির ছাঁচ ধিরে ধীরে অস্টিওক্লাস্টের অণুপ্রবেশে বিগলিত হতে থাকে এবং তার মধ্যে রক্তবাহের প্রবেশ ঘটে। রক্তবাহদের চতুর্দিকে চক্রাকারে স্তরে স্তরে সজ্জিত অস্টিও ব্লাস্ট দ্বারা তাদের চারিদিকে প্রথমে অস্টিওয়েড নামের নরম ধাত্র নিঃসৃত হয়। তার মধ্যে পরবর্তীতে ভিটামিন ডি-র প্রভাবে অস্টিওব্লাস্ট দ্বারা নিঃসৃত ক্যালসিয়াম, ম্যাগণেসিয়াম ফসফেট ইত্যাদি আয়নের উপর অস্টিওব্লাস্টের মধ্যে প্রস্তুত নিঃসৃত অ্যাল্কালাইন ফসফাটেজ উৎসেচকের ক্রমবর্ধমান বিক্রিয়ায় উৎপন্ন হাইড্রক্সি-অ্যাপাটাইটের কেলাস জমা হয়ে অস্থি অশ্মীভূত হয়। এই কঠিন কলা দ্বারা ল্যাকুনা অর্থাৎ ছোট ছোট কোটরে আবদ্ধ অস্টিওব্লাস্টগুলিও অস্টিওসাইট বা অস্থিকোষে পরিবর্তিত হয়। অস্টিওক্লাস্টরা পুরোনো অস্থিকে বিগলিত করে নতুন অস্থি তৈরি করার পথ করে দেয়।

অস্থিকলায় অজৈব খনিজ লবণই প্রধান হলেও এর জৈব অংশের (বিশেষ করে অশ্মীভূত হবার আগে যে অস্টিওয়েড থাকে তার) মধ্যে আছে নানা প্রোটিন। তাদের মধ্যে মুখ্য হলঃ কোলাজেন (৯০%), ফাইব্রোনেকটিন, অস্টিওনেক্টিন, অস্টিওপন্টিন, অস্টিওক্যালসিন, অস্টিওপ্রোতেগ্রিন ইত্যাদি।

অস্থিকলার গঠন সম্পাদনা

আণুবীক্ষণিক ভাবে দেখলে সদ্যজোড়া লাগা ভাঙা হাড়ে ও ভ্রুণের হাড় হল উওভেন বোন (woven bone অর্থাৎ সদ্য"বোনা" হাড়) যাতে কোষ বেশি থাকে ও ধাত্র একটু এলোমেলো ভাবে সংগঠিত থাকে। কিন্তু বাকি সমস্ত রকম পরিণত অস্থি অর্থাৎ কম্প্যাক্ট বোন (compact bone) ও মজ্জার মধ্যে ঠেকা দেওয়ার জন্য হাড়ের হালকা জালি দিয়ে ভরতি ফাঁপা অর্থাৎ স্পঞ্জি বোন বা ট্রাবেকুলার বোন (spongy or trabecular bone) এক বিশেষ রকমের সজ্জা দ্বারা প্রস্তুত যার নাম বলে হ্যাভারসিয়ান সিস্টেম। কঠিন ধাত্রের মধ্যে ল্যাকুনাতে আবদ্ধ অস্টিওসাইটরা একে অপরকে নড়েচড়ে স্পর্শ করতে না পারলেও ক্যানালিকুলা অর্থাৎ খুব সরু সরু নালিকা দিয়ে তারা অপরের সঙ্গে যুক্ত থাকে, এবং হাভারসিয়ান নালি নামে রক্তবাহ ও স্নায়ুধারী লম্বা লম্বা নালীর চারিদিকে সমকেন্দ্রিক চক্রাকারে সজ্জিত অস্টিওসাইটদের অনেক স্তর মিলে একেকটি হ্যাভারসিয়ান সিস্টেম বা অস্টিয়ন তৈরি করে। দুই স্তর অস্টিওসাইটদের মধ্যের যোজক কলাস্তর হল ভিতরের সারির অস্টিওসাইটদের দ্বারা নিঃসৃত অস্টিওয়েডের স্তর। এই অস্থিকলাধাত্রের স্তর হল এক একটি ল্যামেলা, বহুবচনে ল্যামেলি। একেকটি ল্যামেলা ৩-৭ মাইক্রন পুরু এবং একটি অস্টিয়নে ২০টি পর্যন্ত ল্যামেলা থাকতে পারে, ফলে একেকটি অস্টিয়নের ব্যাস হতে পারে ২০০ থেকে ৩০০ মাইক্রন। অস্টিয়নের মধ্যের সমকেন্দ্রিক ল্যামেলা ছাড়াও আরো দুধরনের ল্যামেলা হয়। পরিধিস্থিত (সারকামফারেন্সিয়াল) বা পেরিঅস্টিয়াল ল্যামেলা যা পুরো অস্থিকে সবেচেয়ে বাইরে থেকে বেষ্টন করে, এবং ইন্টারস্টিসিয়াল ল্যামেলা যা অস্টিয়নগুলির ফাঁকে ফাঁকে থাকে। এগুলি আসলে পুরোনো অস্টিয়নের বা উওভেন বোনের ধ্বংসাবশেষ। পুরোনো অস্থি এক বিশেষ ব্যবস্থা দ্বারা এক এক সার অস্টিওক্লাস্ট ও তাদের পিছনে অণুবর্তী সারি সারি অস্টিওব্লাস্টের সুড়ঙ্গ খোড়া ও বোজানোর পর্যায়ক্রমিক ক্রিয়ায় দশকের ব্যবধানে আস্তে আস্তে পুরোপুরি নতুন অস্থি দ্বারা পুনর্নির্মিত হয়। নতুন ল্যামেলাগুলির ফাঁকে ফাঁকে কিছু পুরোনো ল্যামেলার গোঁজা থেকে যায়—সেগুলিই তখন ইন্টারস্টিসিয়াল ল্যামেলা। অস্থি পুনর্গঠনের সময় কিছু কেন্দ্রাতিগ নালির সৃষ্টি হয় যাদের নাম ভল্কম্যানের নালি। এরা হ্যাভারসিয়ান নালীদের সঙ্গে লম্বভাবে থাকে এবং একে অপরের সঙ্গে ও পেরিঅস্টিয়ামের সঙ্গে যুক্ত থাকে।

কোলাজেন নানারকম হয়। অস্থি কলায় থাকে কোলাজেন১ যা কোলাজেন-দের মধ্যে দৃঢ়তম (তুলনায় তরুণাস্থিতে থাকে কোলাজেন ২), এবং কোলাজেন১-এর তন্তুগুলি এক একটি ল্যামেলা বা পাত-এ সমান্তরাল থাকে, কিন্তু দুটি সংলগ্ন ল্যামেলাতে তাদের অভিমুখ ভিন্ন থাকে ফলে বিভিন্ন দিকে দৃঢ়তা বৃদ্ধি পায় (অনেকটা প্লাইউডের মত)। হাইড্রক্সিঅ্যাপাটাইট কেলাসিত হবার সময় এই তন্তুগুলির ফাঁকে ফাঁকে তন্তুগুলির সমান্তরালে বিন্যস্ত হয়। এই খনিজ কেলাস অস্থিকে চাপ সহ্য করার ক্ষমতা দেয়। কিন্তু টান সহ্য করার ক্ষমতা আসে কোলাজেন তন্তুগুলি থেকে।

অস্থিচূর্ণকে জলে দিয়ে অনেক্ষণ গরম করে ফোটালে কোলাজেনের তন্তুগুলি ডিনেচার হয়ে যায় অর্থাৎ তাদের বিনুনি ও ভাঁজ খুলে যায় এবং তার ফলে যে জেলির মত পদার্থ তৈরি হয় তার নাম জিলেটিন। বাজারে যে জিলেটিন বা "জেলো" পাওয়া যায় তা প্রধানত গরুর অস্থিচূর্ণ হতে প্রস্তুত।

অস্থিকলার কার্য সম্পাদনা

  • পেশী অঙ্গ ও নরম কলাসমূহের ভরবহন ও যান্ত্রিক দৃঢ়তা প্রদান।
  • চলাচলের জন্য লিভার-হিসাবে কাজ।
  • দেহের অন্তর্বর্তী নরম অঙ্গগুলিকে চোট আঘাত থেকে রক্ষা করা
  • ক্যালসিয়াম ফসফেটের বৃহত্তম আধার হিসাবে দেহে তাদের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ।