অশ্মীভবন
ভূতত্ত্বমতে অশ্মীভবন বা পেট্রিফিকেশন (ইংরেজি: Petrifaction) বলতে বিভিন্ন খনিজ পদার্থ দ্বারা মূল কোনো বস্তুর ছিদ্রযুক্ত স্থান পূরণ করার প্রক্রিয়াকে বোঝানো হয়। সাধারণত উদাহরণ হিসেবে অশ্মীভূত কাঠের কথা বলা হয়। কিন্তু ব্যাকটেরিয়া থেকে মেরুদণ্ডী প্রাণী, সকলেই অশ্মীভূত হতে পারে (হাড়, পাখির ঠোঁট, এবং শেল ইত্যাদি অশ্মীভূত হয়ে অধিকতর শক্ত হয়, পেশী টিস্যু, পালক বা ত্বক ততটা শক্ত হয় না)। অশ্মীভবন দুটি অনুরূপ প্রক্রিয়ার সমন্বয়ের মাধ্যমে সংঘটিত হয়: পারমিনারেলাইজেশন এবং প্রতিস্থাপন। এর মাধ্যমে অশ্মীভূত হয়ে যা তৈরি হয়, আণুবীক্ষণিক স্তরেও মূল নমুনার মতই হয়ে থাকে।[১]
প্রক্রিয়া
সম্পাদনাপারমিনারেলাইজেশন
সম্পাদনাঅশ্মীভবনের সাথে জড়িত একটি প্রক্রিয়া হচ্ছে পারমিনারেলাইজেশন। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সৃষ্ট জীবাশ্ম তুলনামূলকভাবে মূল নমুনাকে অধিক পরিমাণে ধারণ করে থাকে। এই প্রক্রিয়া তখন ঘটে যখন ভূগর্ভস্থ পানি দ্রবীভূত খনিজ (সবচেয়ে সাধারণভাবে কোয়ার্টজ, ক্যালসাইট, অ্যাপাটি (ক্যালসিয়াম ফসফেট), সাইডরাইট (আয়রন কার্বনেট), এবং পাইরাইট,[২] নমুনার ছিদ্র স্থান এবং গহ্বর পূরণ করে। নমুনার উদাহরণ হিসেবে বিশেষ ভাবে বলা যায় হাড়, শেল বা কাঠের কথা।[৩] জীবের টিস্যুর ছিদ্র এই সকল খনিজ পদার্থ দ্বারা পূর্ণ হয় এবং ভিতরকার পানি নির্গর হয়। পারমিনারেলাইজেশনের দুইটি সাধারণ উদাহরণ হল সিলিকিফিকেশন এবং পাইরিটিাইজেশন।
সিলিকিফিকেশন
সম্পাদনাসিলিকিফিকেশন হচ্ছে সেই প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে জৈব পদার্থ সিলিকা দ্বারা সম্পৃক্ত হয়ে যায়। সিলিকার একটি সাধারণ উৎস আগ্নেয় উপাদান। গবেষণায় দেখা গেছে যে এই প্রক্রিয়ায়, মূল জৈব পদার্থের অধিকাংশই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।[৪][৫] সিলিকিফিকেশন প্রায়ই দুটি পরিবেশে ঘটে — হয় বদ্বীপের সাধারণ বা বন্যাবাহিত পলির মধ্যে নমুনা সমাহিত হওয়ার ফলে কিংবা আগ্নেয়গিরির উদ্গীরণের ছাইয়ের মধ্যে প্রাণী সমাহিত হওয়ার ফলে। সিলিকিফিকেশনের জন্য পানি উপস্থিত থাকতে হবে কারণ এটি উপস্থিত অক্সিজেনের পরিমাণ কমিয়ে দেয় যেন ছত্রাক দ্বারা জীবের প্রক্রিয়াজাতকরণ গতি হ্রাসপ্রাপ্ত হয়, জীবের আকৃতি বজায় থাকে। এর ফলে সিলিকার পরিবাহিত হয়ে জমা হতে পারে। প্রক্রিয়া শুরু হয় যখন একটি নমুনা একটি জলজ সিলিকা সমাধান সঙ্গে পরিবেষ্টিত করা হয়। নমুনার কোষ দেয়াল ক্রমান্বয়ে দ্রবীভূত হয় এবং সিলিকা ফাঁকা জায়গায় জমা করা হয়। কাঠের নমুনার ক্ষেত্রে দেখা যায় প্রক্রিয়া অগ্রসর হওয়ার সাথে সাথে সেলুলোজ এবং লিগনিন নামক কাঠের দুটি উপাদান, ক্রমান্বয়ে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে সিলিকা দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়। নমুনা পানি হারানোর মাধ্যমে পাথরে পরিণত হয় (লিথিফিকেশন নামক প্রক্রিয়া)। সিলিকিফিকেশন ঘটার জন্য, ভূতাপীয় পরিবেশ অবশ্যই নিরপেক্ষ বা সামান্য অম্লীয় পিএইচবিশিষ্ট[৬] হ্তে হবে। তাপমাত্রা ও চাপের পরিমাণ হ্তে হবে কিছুটা অগভীর পলীয় পরিবেশের অনুরূপ। আদর্শ প্রাকৃতিক পরিস্থিতিতে, কৃত্রিম উপায়ে করা অশ্মীভবনের গতিতেই প্রাকৃতিক সিলিকিফিকেশন ঘটতে পারে।[৭]
পাইরিটিাইজেশন
সম্পাদনাপাইরিটিাইজেশন সিলিকিফিকেশনের অনুরূপ একটি প্রক্রিয়া, কিন্তু এখানে প্রাণীর ছিদ্র বা গহ্বরে লোহা এবং সালফার জমে থাকে। পাইরিটিাইজেশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নমুনা কঠিন জীবাশ্মতেও পরিণত হতে পারে, আবার সংরক্ষিত নরম টিস্যুরূপেও থাকতে পারে। সামুদ্রিক পরিবেশে পাইরিটিাইজেশন ঘটার কারণ প্রাণীদের দেহ উচ্চ ঘনত্বের লোহার সালফাইড বিশিষ্ট পলির মধ্যে সমাহিত হওয়া। জীব সালফাইড ছেড়ে দেয়, যা পার্শ্ববর্তী পানিতে দ্রবীভূত থাকা লোহার সাথে বিক্রিয়া করে; ফলাফলে তারা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। লোহা এবং সালফাইডের মধ্যে এই বিক্রিয়া পাইরাইট (FeS2) গঠন করে। পারিপার্শ্বের উচ্চ ঘনত্ববিশিষ্ট পাইরাইট এবং কম ঘনত্বের কার্বনেট থাকার কারণে জীবের কার্বনেটবিশিষ্ট শেল উপাদান পাইরাইট দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়। মাটির কর্দমবিশিষ্ট পরিবেশে উদ্ভিদের মধ্যে পাইরিটিাইজেশন কম মাত্রায় ঘটে।[৩]
প্রতিস্থাপন
সম্পাদনাপ্রতিস্থাপন, অশ্মীভবনের সাথে জড়িত দ্বিতীয় প্রক্রিয়া। এখানে পানিতে থাকা খনিজ পদার্থ মূল নমুনাকে ক্ষয় ঘটিয়ে নমুনার স্থলে খনিজ পদার্থকে বসিয়ে দেয়। এই প্রক্রিয়া অত্যন্ত ধীর হয়ে থাকে, ধীরে ধীরে জীবের আণুবীক্ষণিক কাঠামোর প্রতিলিপি তৈরি হ্তে থাকে। প্রক্রিয়ার হার যত ধীর হবে, মূল কাঠামোর আণুবীক্ষণিক প্রতিলিপি তত ভালভাবে তৈরি হবে। সাধারণত প্রতিস্থাপনের সাথে জড়িত খনিজ পদার্থগুলি হল ক্যালসাইট, সিলিকা, পাইরাইট, এবং হেমাটি।[৩] শুধুমাত্র প্রতিস্থাপন দ্বারা সংরক্ষিত প্রাণী খুঁজে পাওয়া বিরল (পারমিনারেলাইজেশনের বিপরীতে), কিন্তু এভাবে তৈরি হওয়া জীবাশ্ম জীবাশ্মবিজ্ঞানীদের কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই জীবাশ্মগুলি খুব বিস্তারিত তথ্য ধারণ করে।[৮]
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ Cedric Mims (২১ অক্টোবর ২০১৪)। When We Die: The Science, Culture, and Rituals of Death। St. Martin's। পৃষ্ঠা 190। আইএসবিএন 978-1-4668-8385-7।
- ↑ Babcock, Loren। "Permineralization"। Access Science Encyclopedia। McGraw-Hill। সংগ্রহের তারিখ ২৯ মার্চ ২০১২।
- ↑ ক খ গ Perkins, Rogers। "Fossilization: How Do Fossils Form"। Fossil Museum। সংগ্রহের তারিখ ফেব্রু ১৫, ২০১২।
- ↑ Sigleo, Anne (১৯৭৮)। "Organic geochemistry of silicified wood, Petrified Forest National Park, Arizona"। Geochimica et Cosmochimica Acta। Arizona। 42 (9): 1397–1405। ডিওআই:10.1016/0016-7037(78)90045-5। বিবকোড:1978GeCoA..42.1397S।
- ↑ Mustoe, G (২০০৮)। Mineralogy and geochemistry of late Eocene silicified wood from Florissant Fossil Beds National Monument, Colorado। Geological Society of America। পৃষ্ঠা 127–140।
- ↑ Leo, R.F.; Barghoorn, E.S. (১৯৭৬)। Silicification of Wood। Harvard University। পৃষ্ঠা 27।
- ↑ Viney, Mike। "Permineralization"। The Petrified Wood Museum।
- ↑ "How Does Wood Petrify"। National Computational Science in Educati। National Computational Science in Educati। ১৭ এপ্রিল ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৪ এপ্রিল ২০১২।