শিমর্ ইবনে যিলজাওশান আল-আমিরি (আরবি: شَمر بن ذي الجوشن العامري, রোমানাইজড: Shamir ibn Dhīʾl-Jawshan al-ʿĀmirī) সাধারণত শিমর বা শেমর নামে পরিচিত, সে কুফার একজন আরব সামরিক সেনাপতি ছিল, তাকে ৬৮০ সালে সংগঠিত কারবালার যুদ্ধে ইসলামের নবী মুহাম্মদের নাতি হোসাইন ইবনে আলীকে হত্যাকারী হিসাবে উল্লেখ করা হয়।[১]

জীবনী সম্পাদনা

শিমর্ ছিল ইসলামের নবী মুহাম্মদের সাহাবি শুরাহবিল (বা আউস) ধি আল-জাওশান ইবনে কুরতুল-আওয়ার ইবনে আমর[১][২][৩] এর ছেলে, মুসলমানদের ইরাক বিজয়ের পরে তিনি কুফায় বসতি স্থাপন করেছিলেন।[১] সে বানু আমিরের কায়েস গোত্রের শাখা বানু কিলাবের মুয়াবিয়া আল-দিবাব বংশের লোক ছিল।[৪][৫] শিমর্ মূলত খলিফা আলীর (খিলাফত কাল ৬৫৬-৬৬১) মিত্র ছিল এবং সে সিফফিনের যুদ্ধে সিরিয়ার গভর্নর ও উমাইয়া খিলাফতের ভবিষ্যত প্রতিষ্ঠাতা মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল এবং যুদ্ধে সে তাঁর মাথায় আঘাত পেয়েছিল।[১] পরে সে উমাইয়াদের সাথে যুক্ত হয়। ৬৭১ সালে যখন যিয়াদ ইবনে আবিহি আলীয়-সমর্থক হুজুর ইবনে আদিকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেপ্তার করেছিল তখন হুজুরের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যদানকারীদের মধ্যে শিমরও ছিল।[১]

৬৮০ সালে মুহাম্মদের নাতি ও খলিফা আলীর পুত্র হোসাইন ইবনে আলী উমাইয়াদের ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য আলীয়-সমর্থকদের আহ্বানের জবাবে তাঁর চাচাত ভাই মুসলিম ইবনে আকিলকে কুফায় প্রেরণ করেন। শিমর অন্যান্য বিভিন্ন উপজাতীয় উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিদের সাথে এই বিদ্রোহটি দমন করতে গভর্নর উবাইদুল্লাহ ইবনে যিয়াদকে সহায়তা করেছিল। এর খুব অল্প সময় পরে হোসাইন ইরাকে পৌঁছেন এবং কুফার বাইরের কারবালার প্রান্তরে তাঁকে রূদ্ধ করা হয়। ইবনে যিয়াদ হোসাইনের কাছ থেকে শান্তি প্রস্তাবের বিষয়ে একমত হওয়ার পর শিমর এই প্রস্তাবটির বিরোধিতা করেছিল এবং ইবনে যিয়াদকে হোসাইনের উপর বল প্রয়োগ করার জন্য রাজি করেছিল। পরে শিমরকে কারবালায় প্রেরণ করা হয় হোসাইনকে বাধ্য করতে এবং প্রত্যাখ্যান করলে তাকে হত্যা করার নির্দেশ দিয়ে। যুদ্ধের একদিন আগে শিমর হোসাইনের তিন চাচাত ভাইকে নিরাপদে আচরণের প্রস্তাব দেয়, এদের মধ্যে আব্বাস ইবনে আলীও ছিলেন যার মা উম্মে আল-বানিন শিমরের গোত্রের ছিলেন। প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করা হয় কারণ হোসাইনকে কোনও নিরাপদ আচরণের প্রস্তাব দেওয়া হয়নি। যুদ্ধের দিন (১০ অক্টোবর) শিমর উমাইয়া সেনাবাহিনীর বাম শাখার নেতৃত্ব দেয়। সেনাবাহিনীর সেনাপতি উমর ইবনে সা'দ এর নির্দেশে শিমর হোসাইনের সহযোগীদের তাঁবুগুলিতে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং তার নিজের সঙ্গীদের বাধা দেওয়ার আগে হোসাইনের ব্যক্তিগত তাঁবু পোড়ানোর উদ্দেশ্যে ছিল।[১]

প্রায় দিনব্যাপী সংঘাত ও দ্বন্দ্বের ধারাবাহিকতার পরে হোসাইনের বেশিরভাগ সহযোগী নিহত হয় কিন্তু উমাইয়া সেনারা হোসাইনকে হত্যা করতে দ্বিধায় পড়ে। শিমর তাদের হত্যা করতে উত্সাহিত করে: "লজ্জা করে না তোমাদের! তোমরা কেন লোকটির জন্য অপেক্ষা করছো? তাকে হত্যা কর, তোমাদের মায়েরা তোমাদের বঞ্চিত করুক!"[৬] এরপর শিমর্ চূড়ান্ত হামলার নেতৃত্ব দেয়।[৭] কিছু বিবরণ অনুযায়ী শিমর্ হোসাইনকে শেষ পর্যন্ত হত্যা করে ও শিরশ্ছেদ করে, অন্য কিছু বিবরণ অনুযায়ী সিনান ইবনে আনাসের নাম বলা হয়। এরপর সে হোসাইনের জীবিত থাকা পুত্র আলী জয়নুল আবিদীনকে হত্যার চেষ্টা করে কিন্তু ইবনে সা'দ তাকে বাধা দেয়। এরপর শিমরের নেতৃত্বে সৈন্যদল মৃতদের মাথা কুফায় নিয়ে যায়। পরে সে বন্দীদের নিয়ে সিরিয়ায় যায়। সে তার জীবনের পরবর্তী সময়ে তার কর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়েছিল বলে জানা যায়।[১]

৬৪৫ সালের অক্টোবরে কুফা দখল করা মুখতার আল সাকাফির শাসনামলে মুখতারকে ক্ষমতাচ্যুত করার আন্দোলনকারীদের মধ্যে শিমর্ ছিল। বিদ্রোহ দমন করার পর শিমর্ কুফা এবং বসরার মধ্যে অবস্থিত সাদামায় পালায়ন করে। সে সময় বসরার শাসক ছিলেন মাস'আব ইবনে আল জুবায়ের, শিমর তাকে একটি চিঠি লিখে সাহায্যের জন্য আবেদন করে। আবু আমরা কায়সানের নেতৃত্বে মুখতারের সৈন্যরা এই চিঠিটি পথিমধ্যে রোধ করে। তার অবস্থান এরফলে অবগত হওয়ার সাথে সাথে শিমরকে খুঁজে বের করে হত্যা করা হয়। অন্যান্য বর্ণনা মতে তাকে আহত করে মুখতারর কাছে প্রেরণ করা হয়েছিল, তিনি তাকে হত্যা করেন।[৮]

শিয়া ঐতিহ্য অনুসারে শিমরের দেহটি তখন বন্য কুকুর দ্বারা ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়।

বংশধর সম্পাদনা

শিমর নিহত হওয়ার পরে তার ছেলেরা কুফায় জাজিরার উদ্দেশ্যে রওনা হয়।[৯] শিমরের নাতি আল-সুমাইল ইবনে হাতিম ৭৪২ সালে উত্তর আফ্রিকায় বারবার বিদ্রোহের বিরুদ্ধে প্রেরিত বালজ ইবনে বিশরের উমাইয়া সেনাবাহিনীর একজন সেনাপতি ছিল এবং পরবর্তীতে আন্দালুসে কিলাবী সেনাদলের নেতা হয়েছিল।[১০]

চরিত্র রুপায়ণ সম্পাদনা

শিয়ারা আশুরার স্মৃতিতে শোক পালনের সময় আবেগের প্রকাশ হিসাবে শিমরকে সাধারণত একটি দীর্ঘ পালকযুক্ত টুপি সহ লাল বস্ত্র-পরিধান করে চিত্রিত করা হয়।[১১]

আরও দেখুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Kohlberg 2004, পৃ. 722।
  2. Caskel 1966, পৃ. 14, 216।
  3. Rowson 1989, পৃ. 192, note 703।
  4. Hawting 1996, পৃ. 52 n. 214।
  5. Caskel 1966, পৃ. 13–14।
  6. Howard 1990, পৃ. 160।
  7. Vaglieri 1971, পৃ. 611।
  8. Kohlberg 2004, পৃ. 723।
  9. James 2012, পৃ. 78।
  10. Taha 2016, পৃ. 143।
  11. Burke, Edmund; Yaghoubian, Nejde (২০০৬)। Struggle and Survival in the Modern Middle East। University of California Press। পৃষ্ঠা 243আইএসবিএন 9780520246614 

উৎস সম্পাদনা