রঘুনাথ গোস্বামী [১](১৩ জানুয়ারি ১৯৩১- ১৯ জানুয়ারি ১৯৯৫) একজন বিশিষ্ট শিল্পী, খ্যাতনামা ভারতীয় বাঙালি বুক ও গ্রাফিক ডিজাইনার। যদিও এটাই তার একমাত্র পরিচয় নয়। তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। রঘুনাথ ভারতের প্রথম পাপেট চলচ্চিত্র তৈরি করেন, যা শ্রেষ্ঠ শিশু চলচ্চিত্র হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর স্বর্ণপদক পুরস্কার লাভ করে। রঘুনাথ বহু গ্রন্থের প্রচ্ছদও এঁকেছেন।[২]

রঘুনাথ গোস্বামী
জন্ম(১৯৩১-০১-১৩)১৩ জানুয়ারি ১৯৩১
মৃত্যু১৯ জানুয়ারি ১৯৯৫(1995-01-19) (বয়স ৬৪)
পেশাশিল্পী ও গ্রাফিক ডিজাইনার
দাম্পত্য সঙ্গীউমা গোস্বামী
সন্তানমঙ্গল গোস্বামী
পিতা-মাতাউপেন্দ্রনাথ গোস্বামী (পিতা)
রাণীবালা দেবী (মাতা)

প্রাথমিক জীবন সম্পাদনা

১৯৩১ সালের ১৩ই জানুয়ারি হাওড়ার সাঁতরাগাছিতে মামারবাড়ি ভট্টাচার্য পরিবারে রঘুনাথ জন্মগ্রহণ করেন। রঘুনাথরা ছিলেন হুগলী জেলার শ্রীরামপুরের বিখ্যাত গোস্বামী পরিবারের বংশধর। পিতা উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী মেধাবী ছাত্র ছিলেন। মা রাণীবালা দেবী ছিলেন গৃহবধূ। রঘুনাথের ছোটবেলা অতিবাহিত হয় মামার বাড়িতে। এরপর মামারবাড়ি ছেড়ে দক্ষিণ কলকাতার কালীঘাটে সদানন্দ রোডে চলে আসেন। কিছুদিন পর চলে যান উত্তর কলকাতার পাইকপাড়ায় রাণী হর্ষমুখী রোডে। এখানে আসার পর তিনি মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র কলেজে আই.এ ক্লাশে ভর্তি হন, কিন্তু আর্থিক কারণে কলেজ ছেড়ে গ্রন্থ অলংকরণে মন দেন। এক বন্ধুর মামা শৈলেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়-এর সংস্পর্শে এসে তিনি শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হন।

কর্মজীবন সম্পাদনা

রঘুনাথ গোস্বামীর কর্মজীবন শুরু হয় বুক ডিজাইনার, ইলাস্ট্রেটর ও গ্রাফিক ডিজাইনার হিসেবে। সেই সঙ্গে বই-এর প্রচ্ছদ শিল্পীও ছিলেন। জে ওয়াল্টার থমসন কোম্পানীতে বিজ্ঞাপনের ডিজাইনিং-এর কাজ করতেন। এখানে তিনি ছিলেন আর্ট ডিরেক্টর। এরপর এভারেস্ট অ্যাডভার্টাইজিং সংস্থাতেও চাকরি করেন। ১৯৬০ সালে ক্রিয়েটিভ আর্ট ডিরেক্টর হিসেবে স্বাধীনভাবে কাজ করার উদ্দেশে চাকুরি ছেড়ে দিয়ে শুরু করেন ‘আর গোস্বামী অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস’(RGA) নামে একটি সংস্থা। গ্রাফিক ডিজাইন, ইন্টিরিয়র ডিজাইন, এক্‌সিবিশন ডিজাইন, আর্কিটেক্‌চারাল ডিজাইন, প্রোডাক্ট ডিজাইন, কমিউনিকেশন, অ্যানিমেশন, টীচিং এইড্‌স ইত্যাদি ডিজাইনের সর্ব দিকে তিনি অনায়াসে তিনি পদচারণা করেছেন। ১৯৫২ সালে উত্তর কলকাতার পাইকপাড়ায় রাণী হর্ষমুখী রোডে হেনা দাশগুপ্ত, দিলীপ ভৌমিক ও শান্তিরঞ্জন পাল-কে নিয়ে তিনি দি পাপেটস ক্যালকাটা (সংস্থাটির সম্পূর্ণ নাম এটি হলেও পরবর্তী ক্ষেত্রে সুবিধার জন্য আমরা কেবলমাত্র দি পাপেট্‌স্‌ নামটিই ব্যবহার করব) নামে সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংস্থাই এদেশে নন্‌-ট্রাডিশনাল পাপেটের চর্চা শুরু করে। দি পাপেটস-এর অফিস ছিল ৬ নং হেস্টিংস স্ট্রিট(অধুনা কিরণ শঙ্কর রায় রোড), ক্যালকাটা-১। ১৯৬০ সালে এই পথেই ‘হট্টগোল বিজয়’ নামে একটি রঙীন পাপেট ফিল্ম তৈরি করেন। এটি ভারতের প্রথম পাপেট চলচ্চিত্র। গল্পটিও রঘুনাথের লেখা। যা ১৯৬১ সালে শ্রেষ্ঠ শিশু চলচ্চিত্র হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর স্বর্ণপদক পুরস্কার লাভ করে। অংশুমান বন্দ্যোপাধ্যায় আনন্দবাজার পত্রিকায়(৩০জুন,১৯৯৭) ‘বিজ্ঞাপনে যাঁরা এনেছিলেন বাঙালিয়ানা’ শিরোনামে লিখেছিলেন --- “অন্নদা মুন্সী থেকে শুরু করে, সত্যজিৎ রায়, ও সি গাঙ্গুলি, মাখন দত্তগুপ্ত, রণেন আয়ন দত্ত বা রঘুনাথ গোস্বামী--- কারও পরিচয়ই কেবল বিজ্ঞাপন-কুশলী হিসাবে নয়। এঁরা বিজ্ঞাপনের সঙ্গে এনেছিলেন চারুকলাবিদ্যা, সাহিত্য,সঙ্গীত, চলচ্চিত্র এবং সর্বোপরি বাঙালিয়ানার ঐতিহ্য। তাঁদের কাজের মধ্যে ফুটে উঠেছিল কলকাতার সংস্কৃতি’’। বহু গ্রন্থের তিনি প্রচ্ছদ করেছেন। মনে রাখতে হবে কোনো শিক্ষা ছাড়াই কেবলমাত্র দেখতে দেখতে কমার্শিয়াল আর্টের শিক্ষা লাভ করেন। রাতে কলেজে পড়তে পড়তে বই-এর প্রচ্ছদপট আঁকা আর বুক ইলাস্ট্রেশনের কাজ করতেন। মিত্র ও ঘোষ পাব্লিশার্স থেকে প্রকাশিত বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ইছামতী’, ‘কুশল পাহাড়ী’ উপন্যাসের প্রচ্ছদও তার করা। পোষাকী পুরস্কার তার ঝুলিতে দুটি। একটি আকাদেমী পুরস্কার; পান ১৯৯৩ সালে। পুতুল নাটকের জন্য তাকে এই স্মমান প্রদান করা হয়। ১৯৯১-১৯৯২ সালের জন্য এই পুরস্কার দেওয়া হয়। তৎকালীন রাজ্যপাল রঘুনাথ(কে ভি রঘুনাথ রেড্ডি) আর এক রঘুনাথের হাতে পুরস্কারটি তুলে দেন। দ্বিতীয় পুরস্কার; প্রধানমন্ত্রীর স্বর্ণপদক লাভ করেন ১৯৬১ সালে ‘হট্টগোল বিজয় পালার জন্য’। রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ ভাবধারায় শিল্পসৃষ্টির জন্য ১৯৮১ সালে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ আশ্রম(হাওড়া)-এর পক্ষ থেকে ১৯৮১ সালে নিবেদিতা শিল্প পুরস্কার পান। ১৯৯৪ সালে ষড়ভূজ সংস্থার পক্ষ থেকে মূকাভিনয় ও লোকনাট্য পুরস্কার পান। এছাড়াও নানা প্রতিষ্ঠান থেকে সংবর্ধনা ও পুরস্কার পেয়েছেন।

জীবনাবসান সম্পাদনা

রঘুনাথ গোস্বামী ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দের ১৯ শে জানুয়ারি প্রয়াত হন। তাঁর স্ত্রী ছিলেন উমা গোস্বামী এবং পুত্র মঙ্গল গোস্বামী।[৩]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. গদ্যসংগ্রহঃরঘুনাথ গোস্বামী, সম্পাদক- গোবর্দ্ধন অধিকারী, প্রকাশক- গাঙচিল, প্রকাশকাল- ২০১৪।
  2. অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, দ্বিতীয় খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, জানুয়ারি ২০১৯ পৃষ্ঠা ৩৩১, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-২৯২-৬
  3. "অতীতের তাঁরা বৈচিত্র্যময় শিল্পের জাদুকর"। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১১-২৪