রণেন আয়ন দত্ত
রণেন আয়ন দত্ত (২৪ নভেম্বর ১৯২৭ ― ৩ মার্চ ২০২৪) [২]ছিলেন একজন খ্যাতনামা বাঙালি চিত্রশিল্পী এবং আধুনিক বিজ্ঞাপনশিল্পের প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব। প্রচ্ছদ অঙ্কনে, শিল্পনির্দেশনায় ও মণ্ডপসজ্জাতে তার খ্যাতি ছিল বিশ্বজোড়া। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির ইতিহাসেও রয়েছে তার অবিস্মরণীয় কাজ।[৩]
রণেন আয়ন দত্ত | |
---|---|
জন্ম | [১] | ২৪ নভেম্বর ১৯২৭
মৃত্যু | ৩ মার্চ ২০২৪ | (বয়স ৯৬)
জাতীয়তা | ভারতীয় |
মাতৃশিক্ষায়তন | গভর্নমেন্ট কলেজ অব আর্ট অ্যান্ড ক্র্যাফট, কলকাতা |
আন্দোলন | ভারতীয় বিজ্ঞাপন শিল্প |
সন্তান | ২ কন্যা |
পিতা-মাতা | রজনীমোহন দত্ত (পিতা) প্রিয়বালা দেবী (মাতা) |
জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবন সম্পাদনা
রণেন আয়ন দত্তর জন্ম ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ ভারতের অধুনা বাংলাদেশের শ্রীহট্ট তথা সিলেটে। পিতা রজনীমোহন দত্ত ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং মাতা প্রিয়বালা দেবী। দারিদ্রের মধ্যেই কেটেছে তার বাল্যকালে। কলকাতায় চলে আসেন। থাকতেন উত্তর কলকাতার কেশব সেন স্ট্রিটের মেছুয়াবাজারে। ম্যাট্রিক পাশ করার পর তাকে একরকম জোর করেই ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে সরকারি আর্ট কলেজে ভর্তি করানো হয়। [৪] সেসময়ে শিক্ষক হিসাবে পেয়েছিলেন আনোয়ারুল হক, রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, অতুল বসু, মাখনলাল দত্তগুপ্ত, জয়নুল আবেদিন প্রমুখ মহীরুহদের। ফিগার ড্রয়িং এবং জলরং-এ দক্ষ হয়ে ওঠেন। প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে কলেজের পরীক্ষা পাশ করেন তিনি।[৫]ভবানী লাহা পুরস্কার লাভ করেন।
কর্মজীবন সম্পাদনা
কলেজ পাশের পর তার যোগাযোগ হয় খ্যাতনামা চিত্রশিল্পী অন্নদা মুন্সীর সঙ্গে। তিনি তখন প্রবেশিকা নামের এক বাণিজ্যিক সংস্থা চালাতেন। সেই সূত্র ধরেই রণেন প্রথমে পাবলিসিটি ফোরাম ও পরে বোম্বাই এর স্টেনঅ্যাক বিজ্ঞাপন সংস্থায় কাজ করতে থাকেন। ছবি-আঁকা বিজ্ঞাপনে বাঙালির যে চিরকালের মুগ্ধতাবোধ ছিল, তাতেই তিনি ভাষা নির্বিশেষে বিজ্ঞাপনের অসাধারণ কাজ করেছেন। বাংলা বিজ্ঞাপনের ইলাস্ট্রেশনে তিনি দেশজ শৈল্পিক ধারায় বিজ্ঞাপনের জগতে শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেন।তিনি অবশ্য ইলাস্ট্রেটিভ তথা বর্ণনাত্মক বিজ্ঞাপনের ব্যাপারে আসল শিক্ষা লাভ করেছিলেন শিক্ষাগুরু মাখনলাল দত্তগুপ্তর কাছে। [৪] পরে সুভাষ ঘোষালের ডাকে যোগদান করেন জেডব্লিউ টমসনে (পরবর্তীকালে 'হিন্দুস্তান টমসন'-এ)। শেষ জীবনে তিনি ওই সংস্থার প্রধান আর্ট ডিরেক্টর হন।[২] ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন নিজের কোম্পানি আরএডি অ্যাসোসিয়েটস্।
শিল্পকীর্তি সম্পাদনা
রণেন আয়ন দত্ত বিজ্ঞাপন, ইলাস্ট্রেশন, প্রচ্ছদশিল্প থেকে সিনেমার পোস্টারঅঙ্কন, মণ্ডপসজ্জা—সর্বত্রই নিজস্ব স্বাক্ষর রেখেছেন। টি বোর্ড, আইসিআই, টাটা স্টিল, ফিলিপ্স, জিকেডব্লিউ এয়ার ইন্ডিয়া থেকে শুরু করে ১৯৮০-৯০ এর দশকের বোরোলীন, জবাকুসুম, শালিমারের কেশতেল, উইলস্ সিগারেটের একাধিক বহুল জনপ্রিয় বিজ্ঞাপনের প্রচারের পিছনে ছিলেন তিনি । সুভো ঠাকুরের সুন্দরম্ এবং চতুরঙ্গ পত্রিকার শিল্পনির্দেশকের কাজ করেন। নিয়মিতই তার আঁকা স্কেচ ও ইলাস্ট্রেশন প্রকাশিত হত।[৩] উল্লেখযোগ্য প্রচ্ছদ এঁকেছেন-
- প্রবোধকুমার সান্যালের অগ্নিসাক্ষী
- অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাস একটি নদীর নাম;
- অবধূতের কলিতীর্থ কালীঘাট
- দীপক চৌধুরীর দাগ [২]
- সুধাংশু দাসের নাবিক[৪]প্রভৃতি গ্রন্থসমূহের
বাংলা চলচ্চিত্রের পোস্টার অঙ্কন করেন বেশ কয়েকটি সফল চলচ্চিত্রের -
- তপন সিংহের কাবুলিওয়ালা
- অরুন্ধতী দেবীর ছুটি
- অজয় করের হারানো সুর ইত্যাদির [২]
মণ্ডপসজ্জাতেও রণেন আয়নের খ্যাতি ছিল বিশ্বজোড়া। মুম্বাইয়ের এয়ার ইন্ডিয়া ভবন, দিল্লির বেঙ্গল প্যাভিলিয়ন, রাঁচির ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ কোল ম্যানেজমেন্ট ভবন সজ্জার দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে দিল্লিতে এশিয়া-৭২ এর মেলা মণ্ডপসজ্জা তিনিই করেছিলেন। তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী মোহিত হয়েছিলেন।[৩] [২] শিল্প ও স্থাপত্যের মেলবন্ধন ঘটিয়ে তিনি সৃষ্টি করতেন বিশাল মাপের বাণিজ্যিক প্যাভিলিয়ন। কলকাতা-সহ ভারতের কয়েকটি রাজ্যে সংগ্রহশালা তৈরি হয়েছে তার পরিকল্পনায়। সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- কলকাতায় স্টেট ব্যাঙ্কের স্থানীয় প্রধান কার্যালয়ে আর্কাইভ, রামমোহন রায় স্মারক সংগ্রহশালা, দুর্গাপুর স্টিল মিউজিয়াম ইত্যাদি।[২]
সম্মাননা সম্পাদনা
শিল্পকীর্তিতে তার অবদানের জন্য ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ডি. লিট ডিগ্রি প্রদান করে। [১][৫]
জীবনাবসান সম্পাদনা
খ্যাতনামা শিল্পী রণেন আয়ন দত্ত বার্ধক্যজনিত কারণে বেশ কয়েকমাস তার শরীর ভাল ছিল না। ২০২৪ খ্রিস্টাব্দের ৩ মার্চ দুপুরে শ্বাসকষ্ট শুরু হলে দক্ষিণ কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তির করা হয়। কিন্ত রাত আট টায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। [৫] [২]তার দুই কন্যা সন্তান আছে।[৫]
তথ্যসূত্র সম্পাদনা
- ↑ ক খ "Ranen Ayan Dutt: Painter, Illustrator, Muralist, Graphic Artist (24.11.1927 – 03.03.2024)"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৩-০৫।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ ছ "রণেন আয়ন দত্তের প্রয়াণ"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৩-০৫।
- ↑ ক খ গ "কাজ দেখে মুগ্ধ ইন্দিরা গান্ধী আলাপ করেছিলেন রণেন আয়ন দত্তর সঙ্গে"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৩-০৫।
- ↑ ক খ গ "রনেনদার বিজ্ঞাপনের ছবিতে ছিল ইতিহাসের সাক্ষ্য"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৩-০৫।
- ↑ ক খ গ ঘ "Painter and illustrator Ranen Ayan Dutt passes away at 96 (ইংরাজীতে)"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৩-০৫।