বাঘনখ[১] বা ব্যাঘ্র নখর (মারাঠি: वाघनख्या, প্রতিবর্ণী. বাঘনখ্যা) হলো ভারতীয় উপমহাদেশে উদ্ভূত একটি করতালু আকৃৃতির অস্ত্র৷ অস্ত্রটি এমনভাবেই তৈরী যেন তা ধারকের আঙুলের গাঁট বা অঙ্গুলিপর্ব ভালোভাবে এঁটে থাকতে পারে এবং সহজেই তা তালুর নিচে লুকিয়ে রাখা যায়৷ এটিতে পাঞ্জাদস্তানাতে আটকানো চার থেকে পাঁচটি বাঁকা ধারালো অস্ত্রফলক রয়েছে, যা সহজেই চামড়া ও পেশিতে লম্বা-সরু ক্ষত তৈরী করতে পারে৷ মনে করা হয়, বনবিড়ালের আত্মরক্ষা ও আক্রমনপদ্ধতি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এই অস্ত্রটি নির্মিত এবং "বাঘনখ" শব্দটির আক্ষরিক বাংলা অর্থও বাঘের নখ বা বাঘের থাবা৷

বাঘনখ

প্রকার পাঞ্জা বা করতালু
উদ্ভাবনকারী ভারতীয় উপমহাদেশ

ইতিহাস সম্পাদনা

বাঘনখের প্রচলন ঠিক কোন সময়ে হয়েছিলো তা নিয়ে একাধিক বিতর্ক ও মতানৈক্য রয়েছে৷ রাজপুত জাতি গুপ্তহত্যার জন্য বিষাক্ত করা বাঘনখের ব্যবহার করতো৷ এই অস্ত্রটির জনপ্রিয়ভাবে মারাঠা সম্রাট ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ ব্যবহার করেছিলেন, যা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখিত৷ তিনি বিজাপুরের সেনাধ্যক্ষ আফজল খানকে বিছুয়া ছোরা প্রকৃৃতির বাঘনখ দিয়ে হত্যা করেন৷ এটি নিহঙ্গ শিখদের খুবই জনপ্রিয় একটা অস্ত্র৷ তারা সাধারণত একটি বাঘনখ তাদের দীর্ঘায়িত পাগড়িতে ও একটি তাদের বাম হাতে রাখে এবং কোনো সংঘর্ষের কালে বা আপৎকালীন পরিস্থিতিতে ডান হাতে তরোয়াল ব্যবহার করে৷ নিহঙ্গ শিখ মহিলারা বাইরে কোনো বিপদজনক জায়গা দিয়ে গেলে আগে থেকে তাদের সঙ্গে বাঘনখ রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়৷

চোর এবং গুপ্ত ঘাতকদের হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য এটির বহুল ব্যবহার রয়েছে৷ মুষ্টিযুদ্ধ বা কুস্তির সময়ে যোদ্ধাদের কাছে, মল্লযুদ্ধের সময়ে মল্লযোদ্ধাদের নিজের মুষ্টিতে বাঘনখ ব্যবহার করার বিবরণও রয়েছে৷ ১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকালে এম. রৌসেলেট তার বরোদা পরিদর্শনে সময়কালে লেখা বইতে বরোদার রাজার পছন্দের মুষ্টিযুদ্ধ এবং তাতে বাঘনখের ব্যবহার বিস্তারিত করেন৷ তিনি তার লেখা বইতে এটিকে "নাকি-কা-কৌস্তি" বলে উল্লেখ করেন৷

"দ্য উইপন্স, ফিটেজ ইনটু আ কাইণ্ড অব হ্যাণ্ডেল, ওয়্যার ফাস্টেন্ড বাই থংস টু দ্য ক্লোজড রাইট হ্যাণ্ড৷ দ্য মেন, ড্যাঙ্ক উইথ "ভাঙ" অর ইণ্ডিয়ান হেম্প, রাশ্ড আপন ইচ আদার এণ্ড টোর লাইক টাইগার্স এট ফেস এণ্ড বডি; ফোরহেড-স্কিন্স উড হ্যাং লাইক শ্রেড্স, নেক্স এণ্ড রিব্স ওয়্যার লেইড ওপেন, এণ্ড নট ইনফ্রিকোয়েন্টলি ওয়ান অর বোথ উড ব্লীড টু ডেথ৷ দ্য রুলার্স এক্সাইটমেন্ট অন দীজ অকেশন্স অফেন গ্রিউ টু সাচ এ পিচ দ্যাট হি কুড স্কের্সলি রেস্ট্রেন হিমসেল্ফ ফ্রম ইমিটেটিং দ্য মুমেন্টস অব দ্য ডুয়েলিস্টস৷"

অনুবাদ - যে সকল অস্ত্র হাতলের মতো আটকে যেতে পারে সেগুলো ডান হাতের মুঠির মধ্যে চপ্পলের মতো লাগানো হয়৷ ভাঙ বা তার মতো ভারতীয় নেশাকর বস্তু সেবন করে নেশাড়ুরা নিজেদের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে ও বাঘের মতো মুখে দেহে মাথায় চামড়ায় আঁচড়ের মতো দাগ বসায়, কখনো ঘাড় বা পাঁজর ফালা করে দেয় ফলে কোনো একজন বা উভয়ই রক্তক্ষরণ হয়ে আচমকা মৃত্যুমুখে পতিত হতে পারে৷ এই অনুষ্ঠানগুলিকে কেন্দ্র করে শাসকবর্গের উচ্ছাস এতটাই বৃৃদ্ধি পেত যে তারাও খুব কমক্ষেত্রে এই দ্বন্দ্বযুদ্ধে নিজেদের অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখতো৷

১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতায় সাম্প্রদায়িক ছেচল্লিশের দাঙ্গার পরে বাঙালি হিন্দু মেয়েরা আত্মরক্ষার তাগিদে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া অবধি একধরনের ধারালো অস্ত্র নিয়ে বিদ্যালয় বা অন্যকোনো কার্যালয়ে যেতো, যা বাঘনখেরই মতো দেখতে ছিলো৷[২]

প্রকারভেদ সম্পাদনা

বিভিন্ন প্রকারে বাঘনখ পাওয়া যায়৷ একটি প্রকারে একটি দুটি অঙ্গুলিপর্বের একটিতে একটি পাত থাকে এবং বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের জন্য থাবাটিতে আলাদা একটি জায়গা থাকে৷ প্রাপ্ত সবচেয়ে প্রাচীন বাঘনখে আঙলের জন্য আলাদা করে ঘাট ছিলো না বরং মাঝের পাতে মুঠ করে বলয়াকার ছিদ্রে আঙুল ঢোকাতে হতো৷ বিভিন্ন ধরনের বাঘনখে প্রতিটি আঙুলের পর্বে বলয়াকার ছিদ্রের বাইরের দিকে একটি করে ধারালো ফলা থাকতো৷ এই ধরনের বাঘনখটি বিছুয়া বাঘনখ নামে পরিচিত ছিলো কারণ এর ধারালো ফলাগুলি কাঁকড়াবিছার দংশক হাতের ধারালো অংশের মতো কাজ করতো৷

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Almanac, British (১৮৬৪)। The India Museum and Department of the Reporter on the Products of India। London: Knight। পৃষ্ঠা 8। 
  2. Bandyopadhyay, Sandip (২০১০)। ইতিহাসের দিকে ফিরে ছেচল্লিশের দাঙ্গা (Itihasher Dike Fire Chhechallisher Danga)। Kolkata: Radical। পৃষ্ঠা 73।