ক্রিশ্চিয়ান বার্নার্ড

দক্ষিণ আফ্রিকার কার্ডিওথোরাসিক সার্জন

ডাঃক্রিশ্চিয়ান ('ক্রিস') বার্নার্ড (৮ নভেম্বর ১৯২২ - ২ সেপ্টেম্বর ২০০১ ) বা ক্রিশ্চিয়ান নিথলিং বার্নার্ড ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার একজন কার্ডিওথোরাসিক সার্জন। তিনি বিশ্বের প্রথম মানব হৃদয়ের ট্রান্সপ্লান্ট সার্জারি করেন। [১][২] ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দের ৩ ডিসেম্বর বার্নার্ড দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত ডেনিস ডারভালের হৃৎপিণ্ড ৫৪ বৎসর বয়সী লুই ওয়াশকানস্কির বুকে প্রতিস্থাপন করেন। অস্ত্রোপচারের পর লুই ওয়াশকানস্কি আঠারো দিন বেঁচে ছিলেন। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাসের কারণে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার আগে তিনি তার স্ত্রীর সাথে সহজেই কথা বলতে সক্ষম হন। ক্রিস বার্নার্ড অস্ত্রোপচারের আগে তাদের বলছিলেন যে, অস্ত্রোপচার আশি শতাংশ সফল হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। [৩][৪][৫][৬] পরে বার্নার্ড দ্বিতীয় বার ফিলিপ ব্লিবার্গ এর হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট করেছিলেন, তিনি অবশ্য দেড় বছর বেঁচে ছিলেন। [৫][৭]

ক্রিস্টিয়ান বার্নার্ড

ডক্টর
১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে ক্রিস্টিয়ান বার্নার্ড
জন্ম
ক্রিশ্চিয়ান নিথলিং বার্নার্ড

(১৯২২-১১-০৮)৮ নভেম্বর ১৯২২
মৃত্যু২ সেপ্টেম্বর ২০০১(2001-09-02) (বয়স ৭৮)
মৃত্যুর কারণহাঁপানি
জাতীয়তাদক্ষিণ আফ্রিকান
নাগরিকত্বদক্ষিণ আফ্রিকান
শিক্ষামিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয় , কেপ টাউন বিশ্ববিদ্যালয়
পেশাকার্ডিওথোরাসিক সার্জন
কর্মজীবন১৯৫০ - ২০০১
পরিচিতির কারণবিশ্বে প্রথম মানব হৃদপিণ্ড প্রতিস্থাপন (১৯৬৮)
দাম্পত্য সঙ্গীকারিন সেটজকর্ন (বি ১৯৮৮ - বিচ্ছেদ ২০০০), বারবারা জোয়েলনার (বি ১৯৭০ -বিচ্ছেদ ১৯৮২), আলেটা গাট্রুইডা লু (বি ১৯৪৮ -বিচ্ছেদ ১৯৬৯)
আত্মীয়মারিয়াস বার্নার্ড (সার্জন) (ভ্রাতা)
মেডিকেল কর্মজীবন
প্রতিষ্ঠানগ্রুট শুউর হাসপাতাল কেপ টাউন
মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়
বিশেষজ্ঞতাহার্ট ট্রান্সপ্লান্ট সার্জারি

জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবন সম্পাদনা

ক্রিশ্চিয়ান বার্নার্ড দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউন হতে ৩০০ মাইল দূরের কেপ প্রদেশের বিউফোর্ট ওয়েস্টে ১৮২২ খ্রিস্টাব্দের ৮ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। পিতা অ্যাডাম বার্নার্ড ও মাতা মারিয়া এলিসাবেথ বার্নার্ড (ডি সোয়ার্ড) (১৮৮৪ - ১৯২৭) - এর চার সন্তানের মধ্যে ক্রিশ্চিয়ান বার্নার্ড ছিলেন তৃতীয়। স্থানীয় হাই স্কুলে পড়ার পর ক্রিস বার্নার্ড কেপ টাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাক্তারী পড়তে ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে প্রবেশিকা পরীক্ষায় বৃত্তিসহ ভালো ফল করেন। কেপ টাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল স্কুল থেকে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে এমবি সিএইচবি পাশ করেন। ডিগ্রি লাভের পর তিনি কেপ টাউনের গ্রুট শুউর হাসপাতালে ইন্টার্ন ও রেসিডেন্ট ডাক্তার হিসাবে কাজ করার পর কেপ প্রদেশের 'সেরেস' নামক এক গ্রামীণ এলাকায় 'জেনারেল ফিজিশিয়ান' ছিলেন। ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে কেপ টাউনের সিটি হাসপাতালে সিনিয়র রেসিডেন্ট মেডিকেল অফিসার  এবং গ্রুট শুউর হাসপাতালের রেজিস্টার হন। ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে কেপ টাউন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যুগপৎ মেডিসিনে স্নাতকোত্তর, এমডি ডিগ্রী লাভ করেন। [৮]

কর্মজীবন সম্পাদনা

চিকিৎসাশাস্ত্রে বিশেষজ্ঞতা অর্জনের পর ক্রিশ্চিয়ান বার্নার্ড অন্ত্রের অ্যাট্রেসিয়া বিষয় নিয়ে কুকুরের উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। তিনি প্রথম দেখান যে, ভ্রুণে শিশুর ক্ষুদ্রান্তে জন্মগত প্রাণঘাতী ত্রুটি গর্ভাবস্থায় ভ্রূণে অপর্যাপ্ত রক্ত ​​সরবরাহের কারণে ঘটে। তিনি অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে অপর্যাপ্ত রক্ত ​​​​সরবরাহ সহ অন্ত্রের টুকরোটি অপসারণ করে অবস্থা নিরাময় করতে সক্ষম হন এবং তিনি এই পদ্ধতিতে কেপ টাউনের দশটি শিশুর প্রাণ বাঁচান। অন্ত্রের অ্যাট্রেসিয়ার অস্ত্রোপচারের জন্য বার্নার্ডের কৌশল ব্রিটেনমার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শল্যচিকিৎসকেরা অবলম্বন করতে শুরু করেন। ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে ক্রিস্টিয়ান বার্নার্ড যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটার মিনিয়াপোলিসে চলে যান এবং প্রথম দিকে দুবছরের স্কলারশিপে মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শল্যচিকিৎসার প্রধান ওয়েন হার্ডিং ওয়ানজেনস্টিন-এর অধীনে গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিতে কাজ করার জন্য নিযুক্ত হন। পরে বার্নার্ড ওপেন হার্ট সার্জারির জনক ড.ওয়াল্টন লিলেহেই সাথেও কাজ করেন। ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি 'দ্য অর্টিক ভালভ - প্রবলেমস্ ইন দ্য ফ্যাব্রিকেশন অ্যান্ড টেস্টিং অফ এ প্রোস্থেটিক ভালব শীর্ষক গবেষণাপত্রের জন্য সার্জারিতে স্নাতকোত্তর এবং ওই বছরেই দ্য এটিওলজি অফ কনজেনিটাল ইনটেসাটিনাল অ্যাটেসিয়া শীর্ষক নিবন্ধের জন্য পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দেই তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় ফিরে আসেন। সেখানে কেপ টাউনের গ্রুট শুউর হাসপাতালে পরীক্ষামূলক সার্জারি বিভাগের প্রধান নিযুক্ত হন। তিনি সিনিয়র কার্ডিওথোরাসিক সার্জন হিসাবে দক্ষিণ আফ্রিকায় ওপেন-হার্ট সার্জারি চালু করেন। কৃত্রিম হার্ট ভালভের জন্য একটি নতুন নকশা তৈরি করেন এবং কুকুরের হার্ট প্রতিস্থাপনের উপর ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন।[৯]

অবশেষে ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দের ৩ ডিসেম্বর ক্রিস বার্নার্ড ২০ জন শল্যচিকিৎসক দলের নেতৃত্ব দিয়ে প্রথম মানব হৃদপিণ্ড প্রতিস্থাপন করেন। দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত ডেনিস ডারভালের হৃদপিণ্ড ৫৪ বৎসর বয়সী লুই ওয়াশকানস্কির বুকে প্রতিস্থাপন করেন।[৯] অস্ত্রোপচারের পর লুই ওয়াশকানস্কি আঠারো দিন বেঁচে ছিলেন। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাসের কারণে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। বার্নার্ডের পরবর্তী দ্বিতীয় ট্রান্সপ্লান্ট অপারেশনের রোগী প্রায় উনিশ মাস ধরে সক্রিয় জীবনযাপন করেন। উল্লেখযোগ্যভাবে, ক্রিশ্চিয়ান বার্নার্ডের পঞ্চম এবং ষষ্ঠ রোগীরা যথাক্রমে প্রায় তের এবং চব্বিশ বছর বেঁচে ছিলেন।

১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে কেপটাউনের গ্রুট শুউর হাসপাতালের কার্ডিওথোরাসিক সার্জারি বিভাগের প্রধান হিসাবে অবসর নেওয়ার পরে ডক্টর বার্নার্ড বিশ্বের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সাহায্যার্থে ক্রিশ্চিয়ান বার্নার্ড ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন।  তিনি বেশ কয়েকটি উপন্যাস এবং দুটি আত্মজীবনী রচনা করেন-

  • ক্রিস্টিয়ান বার্নার্ড: ওয়ান লাইফ (১৯৬৯)
  • দ্য সেকেন্ড লাইফ (১৯৯৩)[৯]

ব্যক্তিগত জীবন সম্পাদনা

ডাঃ বার্নার্ডের প্রথম বিবাহ হয় আলেটা গার্ট্রুইডা লু নামের এক নার্সের সঙ্গে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে সেরেসে অবস্থানকালে। দম্পতির দুটি সন্তান ছিল- ডেইড্রে (জন্ম ১৯৫০) এবং আন্দ্রে (১৯৫১-১৯৮৪)। [৪][১০] আন্তর্জাতিক খ্যাতি তার ব্যক্তিগত জীবনে প্রভাব ফেলে এবং ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে বার্নার্ড এবং তার স্ত্রীর বিবাহবিচ্ছেদ হয়। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে, তিনি তার ছেলের বয়সী উনিশ বৎসরের বারবারা জোয়েলনারকে বিবাহ করেন। তাদের দুটি সন্তান ছিল- ফ্রেডরিক (জন্ম ১৯৭২) ও ক্রিস্টিয়ান জুনিয়র (জন্ম ১৯৭৪)। [১১] ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে জোয়েলনারের সঙ্গে আবার তার বিবাহ বিচ্ছেদ হয় [১১] পরে বার্নার্ড ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে একজন তরুণ মডেল কারিন সেটজকর্নকে তৃতীয়বার বিয়ে করেন। [১১] তাদের দুটি সন্তানও ছিল, আরমিন (জন্ম ১৯৮৯) এবং লারা (জন্ম ১৯৯৭)। শেষের বিবাহটিও ২০০০ খ্রিস্টাব্দে বিবাহবিচ্ছেদে পরিণতি লাভ করে। [১১]

জীবনাবসান সম্পাদনা

 
নেটকেয়ার ক্রিশ্চিয়ান বার্নার্ড মেমোরিয়াল হাসপাতাল, কেপ টাউন

ড. ক্রিস্টিয়ান বার্নার্ড হাঁপানিতে আক্রান্ত হয়ে ২০০১ খ্রিস্টাব্দে ৭৮ বৎসর বয়সে পরলোক গমন করেন যদিও প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল যে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ছিলেন বার্নার্ড।[৮]

আরও দেখুন সম্পাদনা

  • বার্টলে পি. গ্রিফিথ
  • রেনে ফাভালোরো
  • পিয়েরে গ্রোন্ডিন
  • হ্যামিল্টন নাকি
  • জিওফ্রে টোভি

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Organ Donation, GlobalViewpoints, Margaret Haerens editor, Detroit, New York, San Francisco, New Haven, Conn., Waterville, Maine, U.S.; London, England, UK: Greenhaven Press, 2013.
  2. The operation that took medicine into the media age, BBC, Ayesha Nathoo (Centre for Medical History, University of Exeter), 3 December 2017. The photo caption incorrectly states Louis Washkansky was the first heart transplant recipient, when in actuality he was second. Boyd Rush with physician James D. Hardy was the first person to receive a heart transplant in 1964.
  3. S Afr Med J, "A human cardiac transplant: an interim report of a successful operation performed at Groote Schuur Hospital, Cape Town", Barnard CN, 30 December 1967; 41(48): 1271–74.
  4. Every Second Counts: The Race to Transplant the First Human Heart, Donald McRae, New York: Penguin (Berkley/Putnam), 2006. See esp. Ch. 10 "The Wait" and Ch. 11 "Fame and Heartbreak", pages 173–214.
  5. Altman, Lawrence K. (৩ সেপ্টেম্বর ২০০১)। "Christiaan Barnard, 78, Surgeon For First Heart Transplant, Dies"The New York Times। সংগ্রহের তারিখ ৩০ জানুয়ারি ২০১৭ 
  6. Louis Washkansky (1913–1967) ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৪ এপ্রিল ২০১৭ তারিখে, Science Museum. Louis was born in Lithuania in 1913 and moved to South Africa in 1922.
  7. Philip Blaiberg was dying—this time for certain, Chicago Tribune, Mrs. Philip Blaiberg, 12 October 1969, page 68.
  8. "Dr Christiaan Neethlingh Barnard"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-১১-১২ 
  9. "Christiaan Barrnard - Heart Transplant, Medical Innovator &"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-১১-১২ 
  10. "Christiaan Barnard, celebrated pioneer of heart transplant surgery, dies aged 78", The Independent, 3 September 2001. Retrieved 18 September 2010.
  11. "Christiaan Barnard Biography"। ২৩ মে ২০০৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১০ জুন ২০০৯ 

আরও পড়ুন সম্পাদনা

বহিঃসযোগ সম্পাদনা

টেমপ্লেট:Organ transplantation