হ্যামিল্টন নাকি

দক্ষিণ আফ্রিকার কার্ডিয়াক সার্জন

হ্যামিল্টন নাকি (২৬ জুন ১৯২৬ – ২৯ মে ২০০৫) ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার কার্ডিয়াক সার্জন ক্রিস্টিয়ান বার্নার্ডের ল্যাবরেটরি সহকারী। তিনি কোনও আনুষ্ঠানিক চিকিৎসা শিক্ষা না পাওয়া সত্ত্বেও তার অস্ত্রোপচার দক্ষতা এবং মেডিকেল ছাত্র ও চিকিৎসকদের এই ধরনের দক্ষতা শেখানোর ক্ষমতার জন্য স্বীকৃত। তিনি প্রাণীদের উপর অঙ্গ প্রতিস্থাপন গবেষণায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন করেন।[২]

হ্যামিল্টন নাকি
জন্ম(১৯২৬-০৬-২৬)২৬ জুন ১৯২৬
এনজিসিংওয়ানে, দুতিয়া, ট্রান্সকেই
মৃত্যু২৯ মে ২০০৫(2005-05-29) (বয়স ৭৮)
মৃত্যুর কারণহার্ট অ্যাটাক
জাতীয়তাদক্ষিণ আফ্রিকা
সন্তান
পুরস্কারব্রোঞ্জ অর্ডার অব মাপুনগুবওয়ে[১]
বৈজ্ঞানিক কর্মজীবন
কর্মক্ষেত্রঅঙ্গ প্রতিস্থাপন
প্রতিষ্ঠানসমূহকেপ টাউন বিশ্ববিদ্যালয়

তার মৃত্যুর পর একটি বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল এবং অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস সহ পাঁচটি সাময়িকী তাদের নাকির স্মৃতিতে রচিত বিবৃতি কিছু অংশ প্রত্যাহার করে নেয়, যেখানে দাবি করা হয়েছিল যে ১৯৬৭ সালে তিনি বিশ্বের প্রথম মানব থেকে মানব হার্ট প্রতিস্থাপনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ঘটনাটিকে সংবাদ মাধ্যম কর্তৃক অপর্যাপ্ত তথ্য পরীক্ষা এবং ত্রুটিসংশোধনের বিলম্বের একটি উদাহরণ হিসেবে উদ্ধৃত করা হয়েছে।[৩][৪]

প্রাথমিক জীবন সম্পাদনা

নাকি দক্ষিণ আফ্রিকার পূর্ব কেপ প্রদেশের সেন্টানি গ্রামের এনজিসিংওয়ানে একটি দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।[৫] তিনি ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত মাত্র ছয় বছর শিক্ষা লাভ করেন। এরপর তিনি কেপটাউনে চলে যান। ১৯৪০ সাল থেকে তিনি কেপ টাউনের লাঙ্গায় থেকে কেপ টাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে মালি হিসেবে কাজ করতে আসতেন।[৫][৬] বিশেষ করে তিনি টেনিস কোর্টের ঘাসের পরিচর্যা করতেন।[৭]

চিকিৎসা পেশা ও অবসর সম্পাদনা

১৯৫৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্ত্রোপচার অনুষদের রবার্ট গোয়েটজ নাকিকে প্রাণীদের গবেষণাগারে তাকে সাহায্য করতে বলেন। সেখানে নাকির প্রাথমিক দায়িত্ব খাঁচা পরিষ্কার করা হলেও পরে তিনি অ্যানাস্থেশিয়া করার দায়িত্ব পান। গোয়েৎজের অধীনে নাকির দায়িত্ব ছিল মূলত কুকুরের অ্যানাস্থেশিয়া করা, কিন্তু তিনি একটি জিরাফের উপর অপারেশন করার সময় "জিরাফ কেন পানি পান করার সময় অজ্ঞান হয় না তা নির্ধারণ করার জন্য জুগুলার ভেনাস ভাল্ব আলাদা করতে" সাহায্য করেছিলেন।

গোয়েটজ চলে যাওয়ার কয়েক বছর পর নাকি ক্রিস্টিয়ান বার্নার্ডের সহকারী হিসেবে গবেষণাগারে কাজ শুরু করেন।[৮] বার্নার্ড মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ওপেন-হার্ট সার্জারি কৌশল অধ্যয়ন করেছিলেন এবং সেই কৌশলগুলো দক্ষিণ আফ্রিকায় নিয়ে এসেছিলেন।[৫] নাকি প্রথমে বার্নার্ডের জন্য পশুদের উপর অ্যানাস্থেশিয়া করতেন, কিন্তু তারপর তার অসাধারণ দক্ষতার কারণে তাকে ল্যাবরেটরির প্রধান অস্ত্রোপচার সহকারী হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। বার্নার্ডকে উদ্ধৃত করে বলা হয় যে "যদি হ্যামিলটনের পড়াশোনার সুযোগ থাকত, তাহলে তিনি সম্ভবত একজন প্রতিভাবান শল্যচিকিৎসক হতেন" এবং নাকি ছিলেন "হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে সর্বকালের অন্যতম সেরা গবেষক"।

১৯৬৮ সালে বার্নার্ডের কার্ডিয়াক সার্জিক্যাল রিসার্চ টিম সার্জিক্যাল ল্যাবরেটরি থেকে সরে আসে, এবং নাকি এই টিমে হেটেরোটপিক বা "পিগিব্যাক" হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপন কৌশল বিকাশে সাহায্য করে। ১৯৭০-এর দশকে নাকি বার্নার্ডের দল ত্যাগ করে সার্জিক্যাল ল্যাবরেটরিতে ফিরে আসেন, এবার তিনি লিভার প্রতিস্থাপন নিয়ে কাজ করেন। এই সময়ে তার অবদান নিম্নরূপ:

  • রোজমেরি হিকম্যান, প্রতিস্থাপন শল্য চিকিৎসক, যাকে নাকি গবেষণাগারে সাহায্য করতেন এবং শেখাতেন, এবং যিনি প্রায় ৩০ বছর নাকির সাথে কাজ করেছেন: "তার সীমিত প্রচলিত শিক্ষা সত্ত্বেও, তার শারীরবৃত্তীয় নাম শিখতে এবং অসঙ্গতি চেনার বিস্ময়কর ক্ষমতা ছিল। তার দক্ষতা ছিল সহায়তা থেকে শুরু করে অপারেশন পর্যন্ত এবং তিনি প্রায়ই দাতা পশু প্রস্তুত (কখনও কখনও এককভাবে) করতেন এবং দলের অন্যরা গ্রহীতাকে নিয়ে কাজ করতেন।[৭]
  • গ্রুট শুর হাসপাতালের অঙ্গ প্রতিস্থাপন ইউনিটের প্রধান ডেল খান, যাকে নাকি গবেষণাগারে শিখিয়েছেন। "যুক্তরাষ্ট্রে একটি শূকরের লিভার প্রতিস্থাপনের জন্য দুই বা তিনজন শল্যচিকিৎসকের একটি দল জড়িত থাকে... হ্যামিলটন একাই এসব করতে পারে।[৯]
  • কেপ টাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের লিভার রিসার্চ সেন্টারের প্রধান রালফ কির্শ: "তিনি সেই সব অসাধারণ ব্যক্তিদের একজন ছিলেন যারা সত্যিই দীর্ঘ সময় পরে পৃথিবীতে একবার আসেন। অশিক্ষিত একজন মানুষ হয়েও তিনি সর্বোচ্চ পর্যায়ের অস্ত্রোপচারের কৌশল অবলম্বন করেন এবং সেগুলো তরুণ ডাক্তারদের হাতে তুলে দেন।"[১০]
  • বার্নার্ড: "লিভার প্রতিস্থাপন হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপনের চেয়ে অনেক কঠিন... [নাকির সাথে কাজ করা ডাক্তাররা] আমাকে বলেন যে হ্যামিলটন লিভার প্রতিস্থাপনের বিভিন্ন দিক করতে পারে, যা আমি করতে পারি না। তাই টেকনিক্যালি, সে আমার চেয়ে ভালো শল্যচিকিৎসক।[৯]

নাকি তার কর্মজীবনে অনেক ছাত্র-ছাত্রীকে পড়িয়েছেন। তবে নিউজমিডিয়া সংস্থাগুলো এই সংখ্যাকে হাজার হাজার বলে উল্লেখ করেছে। তবে হিকম্যান বলেছেন যে মনে হচ্ছে এই সংখ্যা অতিরঞ্জিত করে বলা হচ্ছে। নাকি ১৯৯১ সালে অবসর গ্রহণের আগ পর্যন্ত হিকম্যানকে সাহায্য করেছেন। এরপর থেকে তিনি একজন মালী হিসেবে মাসে ৭৬০ র্যান্ড, অথবা মাসে প্রায় ২৭৫ ডলার পেতেন।[১১]

ব্যক্তিগত জীবন, অবসরোত্তর কর্মকাণ্ড, স্বীকৃতি ও মৃত্যু সম্পাদনা

নাকি চার ছেলে ও এক মেয়ে আছে বলে জানা গেছে।[১২] তিনি বিদ্যুৎ বা পানি বিহীন একটি ছোট এক কামরার বাড়িতে বাস করতেন।[৬][১০] তার বেতনের বেশিরভাগই ট্রান্সকেইতে রেখে আসা স্ত্রী ও সন্তানদের জন্য পাঠাতেন। কিন্তু এই অর্থ দিয়ে তিনি তার মাত্র একজন সন্তানকে উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষা শেষ করাতে পেরেছেলিন।[১১] তিনি নিয়মিত গির্জায় যেতেন এবং নিয়মিত বাইবেল পড়তেন।[৭]

অবসরগ্রহণের পর, নাকি কেন্তানি সম্প্রদায়কে কিছু সাহায্য করেন, যেখানে তার পরিবারের কিছু অংশ বাস করতেন। উদাহরণস্বরূপ তার চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগ থেকে অনুদান চাওয়ার মাধ্যমে একটি বিদ্যালয় নির্মাণ এবং একটি ভ্রাম্যমাণ ক্লিনিকের ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি অবসরগ্রহণের পর তার চিকিৎসা কাজের সর্বজনীন স্বীকৃতি লাভ করেন, যার মধ্যে রয়েছে:

  • মেট্রোপলিটন ইস্টার্ন কেপ অ্যাওয়ার্ড, ২০০২।[১৩]
  • মাপুঙ্গুবওয়ে,২০০২ এর ব্রোঞ্জ পদক, রাষ্ট্রপতি থাবো এমবেকি এই পদক প্রদান করেছেন।[১৪][১৫] এটি দক্ষিণ আফ্রিকার সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান, এই পদক "উৎকর্ষ এবং ব্যতিক্রমী অর্জনের জন্য দক্ষিণ আফ্রিকার নাগরিকদের প্রদান করা হয়।[১৬]
  • বিটিডব্লিউএসসি ব্ল্যাক এস/হিরোস অ্যাওয়ার্ড, ২০০৩।[১৭]
  • ২০০৩ সালে ইউনিভার্সিটি অফ কেপ টাউন থেকে সাম্মানিক স্নাতকোত্তর ডিগ্রী, চ্যান্সেলর গ্রাসা মাচেল এটি প্রদান করেন।[১০][১৮] কিছু উৎসে এই সম্মানসূচক ডিগ্রীকে এমমেড (মাস্টার অফ মেডিসিন) এবং অন্য উৎসে একে এমএসসি (মাস্টার অফ সায়েন্স) হিসেবে বর্ণনা করা হয়।[৬][১৮][১৯][২০]
  • ২০০৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার সংসদের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে "সিনিয়র সিভিল গার্ড অফ অনার" প্রাপ্ত হন।[২১]
  • ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে কেপটাউনের খ্রিস্টান বার্নার্ড হাসপাতালের উল্টো দিকের সমভূমির নাম পরিবর্তন করে সালাজার প্লেইন থেকে হ্যামিল্টন নাকি স্কোয়ার রাখা হয়।[২২]

তিনি ২৯ মে, ২০০৫ তারিখে ৭৮ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে লাঙ্গায় মৃত্যুবরণ করেন।[৬]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Zühlke, Liesl; Mayosi, Bongani M. (ডিসেম্বর ২০১৭)। "The life and the legacy of Hamilton Naki: Experimental heart transplant surgeon and teacher"। The Journal of Heart and Lung Transplantation36 (12): 1309–1310। ডিওআই:10.1016/j.healun.2017.10.006পিএমআইডি 29173393 
  2. Alistair Leithead (৯ মে ২০০৩)। "Gardener behind Africa's heart pioneer"। BBC News। সংগ্রহের তারিখ ৪ সেপ্টেম্বর ২০১১ 
  3. For instance, in:
  4. Silverman, Craig (২০০৯)। "Too Incredible Not to Report"Regret the Error: How Media Mistakes Pollute the Press and Imperil Free Speech। পৃষ্ঠা 219–224। আইএসবিএন 978-1-4027-6564-3 
  5. Carroll R. "Two men transplanted the first human heart. One ended up rich and famous – the other had to pretend to be a gardener. Until now."। Archived from the original on ২৫ এপ্রিল ২০০৩। সংগ্রহের তারিখ ২০১৭-০৩-২৮  The Guardian 25 April 2003. Retrieved 11 August 2010.
  6. Fox M. Hamilton Naki, 78, self-taught surgeon, dies. New York Times 11 June 2005. Retrieved 11 August 2010.
  7. Hickman, Rosemary (১ এপ্রিল ১৯৯৯)। "From Tennis Courts to Transplants"। Archives of Surgery134 (4): 451–2। ডিওআই:10.1001/archsurg.134.4.451পিএমআইডি 10199323 
  8. Wines M. Accounts of South African's career now seen as overstated. New York Times 27 August 2005. Retrieved 11 August 2010.
  9. উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; Venter1993 নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি
  10. Kapp, Clare (জুলাই ২০০৫)। "Hamilton Naki"। The Lancet366 (9479): 22। এসটুসিআইডি 43044772ডিওআই:10.1016/S0140-6736(05)66811-0পিএমআইডি 16127806 
  11. Hamilton Naki, an unrecognised surgical pioneer, died on May 29th, aged 78. The Economist 9 June 2005. Retrieved 11 August 2010.
  12. Richmond C. Hamilton Naki. Surgical assistant to Christiaan Barnard. ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৬ এপ্রিল ২০১১ তারিখে The Independent 11 June 2005. Retrieved 11 August 2010.
  13. Salayedwa A. Macozoma laments loss of skilled youth. ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৭ অক্টোবর ২০০৮ তারিখে Daily Dispatch (South Africa) 30 September 2002. Retrieved 11 August 2010.
  14. The Presidency of the Republic of South Africa. The Order of Mapungubwe. List of recipients.[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ] Retrieved 11 August 2010.
  15. South African Press Association. Mbeki first recipient of new national orders. ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২০ নভেম্বর ২০০৩ তারিখে Daily Dispatch (South Africa) 10 December 2002. Retrieved 11 August 2010.
  16. The Presidency of the Republic of South Africa. National Orders. The Order of Mapungubwe. ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৫ সেপ্টেম্বর ২০০৮ তারিখে Retrieved 11 August 2010.
  17. Mbakwe T. Hamilton Naki, the unsung hero. New African January 2004:30–32. Retrieved 11 August 2010.
  18. Munnion C. 'Gardener' honoured with degree in medicine. The Telegraph (London) 23 June 2003. Retrieved 11 August 2010.
  19. Dent, David M (৩ সেপ্টেম্বর ২০০৫)। "Obituary of Hamilton Naki: Obituary was historically inaccurate"BMJ331 (7515): 517.1। ডিওআই:10.1136/bmj.331.7515.517পিএমসি 1199042  
  20. "Hamilton Naki"। BMJ330 (7506): 1511। ২৫ জুন ২০০৫। এসটুসিআইডি 220095602ডিওআই:10.1136/bmj.330.7506.1511 
  21. Adams S. VIPs for Mbeki's guard of honour. IOL (Independent Online) News (South Africa) 20 May 2004. Retrieved 11 August 2010.
  22. "City of Cape Town renames square on Foreshore after Hamilton Naki"। ২৯ আগস্ট ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৩ জানুয়ারি ২০২১