ব্যবহারকারী:Farhadmt/সারিন গ্যাস

বিষাক্ত নার্ভ গ্যাস হচ্ছে সারিন সম্পাদনা

সাংঘাতিক বিষাক্ত নার্ভ গ্যাস হচ্ছে সারিন। এ গ্যাস স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রমণ করে অকার্যকর করে দেয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে সারিন গ্যাসের কার্যকারিতা প্রাণঘাতী সায়ানাইডের চেয়েও ২৬ গুণ বেশি। এক ঘনমিটার আয়তনের একটি প্রকোষ্ঠে কাউকে রেখে মাত্র ১০০ মিলিগ্রাম সারিন গ্যাস প্রয়োগ করা হলে মিনিটের মধ্যে তার মৃত্যু হবে। এ গ্যাস ও বর্ণ গন্ধহীন হওয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আগেই গ্যাসের উপস্থিতি বোঝা যায় না। বাতাসের চেয়ে ভারী হওয়ায় কোথাও এ গ্যাস ছেড়ে দিলে ছয় ঘণ্টা পর্যন্ত স্থিতিশীল থাকতে পারে।

আবিষ্কার সম্পাদনা

১৯৩৮ সালে অধিকমাত্রায় কার্যকর কীটনাশক তৈরি করতে গিয়ে জার্মানি বিজ্ঞানীরা কাকতালীয়ভাবে সারিন গ্যাস তৈরি করে ফেলেন। পরে জার্মান সরকার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানে এ গ্যাস ব্যবহার করে। কিন্তু জার্মানির সেনাবহিনী একে ১৯৩৯ সালে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের উদ্যোগ নেয়। পরবর্তীতে প্রাণঘাতী এ গ্যাস ছড়িয়ে পড়ে দেশ হতে মহাদেশে। প্রাণঘাতী এ গ্যাসটি বর্ণ ও গন্ধহীন। এ গ্যাস ছাড়া হলে দেখা যাবে না বা গন্ধকে আগে থেকে ধরা যাবে না। যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিশ্বের অনেক পরাশক্তিই সারিন গ্যাসের মজুদ গড়ে তুলেছিল। তবে এখন সারিন গ্যাসের ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। গত শতাব্দীর শেষ দিকে জাপানের একটি ধর্মীয় গোষ্ঠী সারিন গ্যাস ব্যবহার করে ফের আলোচনায় এসেছিল। ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের শাসনামালে কুর্দি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে এ গ্যাস ব্যবহার করা হয়েছিল। ইরানের সৈন্যদের বিরুদ্ধেও ইরাক সারিন গ্যাস ব্যবহার করেছিল। সে সময় ইরানের সৈন্যদের অবস্থানের তথ্য স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সংগ্রহ করে সরবরাহ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। সাম্প্রতিক সারিন গ্যাসের ব্যবহার ঘটেছে সিরিয়ায়। এ ঘটনায় সিরিয়ায় নারী শিশুসহ কমপক্ষে দেড় হাজার লোক প্রাণ হারায়।

অধিকারী দেশসমূহ সম্পাদনা

বর্তমানে সারিন গ্যাস মজুদ রয়েছে কমপক্ষে এমন পাঁচটি দেশ এ কথা ঘোষণা করেছে। পাঁচটি দেশ হলোÑ যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, লিবিয়া, ইরাক এবং জাপান। তবে চীন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তাদের কাছে মজুদ সারিন গ্যাস ধবংসের কথা স্বীকার করলেও তা ছিল খুবই মন্থরগতিতে। সবশেষ জুলাই ২০১৩ এ জানা যায় চীনে বর্তমানে ১৩ হাজার টন রাসায়নিক গ্যাস বিদ্যমান রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা মনে করছে সিরিয়া, ইরান ও উ. কোরিয়ায় এ রাসায়নিক গ্যাস রয়েছে। বিশেষ করে সিরিয়ায় ভিএক্স, সারিন, মাস্টার্ডসহ বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক গ্যাস মজুদ রয়েছে। এ ছাড়াও আরো কিছু দেশ রয়েছে যাদের সারিন গ্যাস উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে কিন্তু জনসমক্ষে তারা এটা প্রকাশ করছে না। সম্ভাব্য এ দেশগুলো হচ্ছে- ভারত, পাকিস্তান, মিসর, সার্বিয়া সুদান, তাইওয়ান এবং ভিযেতনাম। ভারত ১৯৯৭ সালে তাদের কাছে রাসায়নিক গ্যাস সারিন আছে বলে ঘোষণা করে।

যেভাবে কাজ করে সম্পাদনা

সারিন গ্যাস এমনই বিষাক্ত যে, ঘনীভূত অবস্থায় তার একটি কণাই মানুষের মুত্যু ঘটাতে পারে – যদিও সারিন সাধারণত তরল অবস্থাতেই জমা থাকে৷ সেই তরল সারিন জলের মতো স্বচ্ছ এবং সেটা যখন বাতাসে উবে যায়, তখন তা-তে কোনো গন্ধ থাকে না৷ এমনকি তার হদিশ পাবারও কোনো উপায় থাকে না৷ সেই কারণেই গত আগস্টে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের উপকণ্ঠে যে মানুষরা উল্টে পড়ে গিয়ে, নিঃশ্বাস না নিতে পেরে প্রাণ হারিয়েছে, তারা বুঝতেও পারেনি কেন, অথবা কোন বিষে তাদের মৃত্যু ঘটছে৷

সারিন প্রধানত শরীরের স্বয়ম্ভর স্নায়ু প্রণালীকে প্রভাবিত করে – যে অনিচ্ছাচালিত পেশিগুলি হজমশক্তি, শ্বাস গ্রহণ কিংবা হাত-পা নাড়াচাড়ার মতো শারীরিক কর্মগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে৷ যেমন নিঃশ্বাস নেওয়ার সংকেতটি আসে স্নায়ুকোষগুলির কাছ থেকে পেশির কোষগুলির কাছে৷যে রাসায়নিক দূতেরা এই বার্তা বহণ করে আনে তাদের বলা হয় ‘নিউরোট্রান্সমিটার্স'৷ বার্তাটি দেওয়া হয়ে গেলেই অ্যাসেটিলকোলাইন নিউরোট্রান্সমিটারটির কাজ শেষ – এর পর এনজাইমরা সেটিকে ভেঙে ফেলে; যা পড়ে থাকে, তা হলো কোলাইন, যা শরীরে রিসাইকল্ড হয়, এবং অ্যাসেটিক অ্যাসিড, যা জলের সঙ্গে মিশে ভিনিগার হয়ে পরে প্রস্রাবের সঙ্গে বেরিয়ে যায়৷

প্যাক-ম্যান সম্পাদনা

যে এনজাইমটি এই গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে সেটিকে বলা হয় ‘প্যাক-ম্যান মলিকিউল'৷ এই প্যাক-ম্যান মলিকিউলকে যদি তার কাজ করতে না দেওয়া হয় – সারিন গ্যাস ঠিক যে প্রভাব ফেলে – তাহলে পেশি আর স্নায়ুর জংশনে বিপুল পরিমাণ নিউরোট্রান্সমিটার জমে যায়, যেন পেশিটির সুইচ স্থায়ীভাবে ‘অন' করে দেওয়া হয়েছে৷ ফলে একটানা পেশির সংকোচন চলতে থাকে৷ অর্থাৎ মস্তিষ্ক সেই পেশিকে অন্য কিছু করার সংকেত পাঠালেও সেই সংকেত পৌঁছায় না৷ এভাবেই, সারিনের প্রভাবে চোখ থেকে জল পড়াও থামবে না, যেমন পেশির কাঁপুনিও থামে না৷এই স্থায়ীভাবে ‘অন' করে রাখা সুইচ যখন ফুসফুসের ডায়াফ্রামকে প্রভাবিত করে, তখনই সারিন মারাত্মক হয়ে ওঠে৷স্নায়ুকোষগুলি অ্যাসেটিলকোলাইনের বার্তা পাঠাতে থাকে যে, পেশির কোষগুলির শুধুই নিঃশ্বাস নেবে, প্রশ্বাস ছাড়বে না – যার ফলে দম আটকে মৃত্যু ঘটতে পারে৷ সারিন যে শুধু নিঃশ্বাসের সঙ্গেই শরীরে ঢোকে, এমন নয়৷ গায়ের ত্বক এবং চোখের মাধ্যমেও সারিন শরীরে প্রবেশ করতে পারে৷

প্রতিষেধক সম্পাদনা

এক্সপোজার কম হলে সারিনের প্রভাব থেকে প্রাণে রক্ষা পাওয়া সম্ভব৷ একটি অ্যান্টিডোটের নাম হলো প্রালিডক্সাইম, যা প্যাক-ম্যান এনজাইমগুলো থেকে সারিনকে বিচ্ছিন্ন করে৷ এর ফলে এনজাইমটি পুনরায় সক্রিয় হয়ে অ্যাসেটিলকোলাইনকে ভেঙে ফেলার কাজ শুরু করতে পারে৷ অ্যান্টিডোট হাতের কাছে না থাকলে, এক গ্লাস জলে এক চামচ বেকিং সোডা গুলে, সেই জলে একটি তোয়ালে ভিজিয়ে, সেই তোয়ালের ভিতর দিয়ে রোগীকে নিঃশ্বাস নেওয়ানো যেতে পারে৷ এই অ্যালকালাইন সলিউশনটির ফলে সারিনের প্রকোপের প্রশমন হয়৷ সারিনের বিধ্বংসী ক্ষমতা আবহাওয়ার উপরেও নির্ভর করে৷ তাপমাত্রা বিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে, সারিন বাতাসে থাকে দুই থেকে বিশ দিন পর্যন্ত৷ ২৫ ডিগ্রি গরম হলে সেটাই কমে এক থেকে দশ দিন হয়ে যায়৷ খুব ঠান্ডা হলে – যেমন শূন্য ডিগ্রিতে – সারিন অথবা অন্যান্য স্নায়ুর গ্যাস এক বছর পর্যন্ত বাতাসে থাকতে পারে৷

নিষ্ক্রিয়করণ সম্পাদনা

রাসায়নিক অস্ত্র ধ্বংস করতে নানা কৌশল ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তবে অধিকাংশ পদ্ধতিই হয় ভস্মীভূত। রাসায়নিক দ্রব্যর বিষাক্ততা নষ্ট করতে এগুলো উচ্চতাপে পুড়িয়ে ফেলা হয়। বিস্ফোরকযুক্ত রাসায়নিক অস্ত্র ধ্বংস করার ক্ষেত্রে থাকে বাড়তি ঝুঁকি। এ ক্ষেত্রে একটি সমাধান হচ্ছে, ভ্রাম্যমাণ ইউনিট ব্যবহার করা। ধ্বংসের কাজে এ ধরনের ইউনিট ব্যবহার করা গেলে অপেক্ষাকৃত দ্রুত এক স্থান থেকে অন্যত্র সরে যাওয়া যায়। মার্কিন সামরিক বাহিনী এ ধরনের একটি ভ্রাম্যমাণ ইউনিট তৈরি করেছে, যার নাম এক্সপ্লোসিভ ডেস্ট্রাকশন সিস্টেম (ইডিএম) বিস্ফোরক নিস্ক্রিয়করণ পদ্ধতি। এটি বিষাক্ত গ্যাস নিস্ক্রিয় করতে রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে। ২০০১ সালের পর থেকে এক হাজার ৭০০টি রাসায়নিক অস্ত্র ধ্বংসে এটি ব্যবহার করা হয়ছে। সিরিয়ায় কথিত ‘হট- ডেটোনেশন টেকনোলজি’ নামের আরেকটি পদ্ধতি ব্যবহার করা হতে পারে। এ পদ্ধতিতে রাসায়নিক অস্ত্রগুলোকে একটি চেম্বারের ভেতরে নিয়ে ৫৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা সৃষ্টি করা হয়। এ মাত্রার তাপ রাসায়নিক অস্ত্র ও এর উপাদানগুলো ধ্বংসের জন্য যথেষ্ট। যুদ্ধাস্ত্রের ভেতরে ভরা হয়নি, এমন রাসায়নিক অস্ত্র ধ্বংস করা অনেকটা সহজ। উচ্চতাপের মাধ্যমে রাসায়নিক গ্যাসগুলোকে কম ক্ষতিকর দ্রব্যে রূপান্তরিত করা যায়। তখন এগুলো রাসায়নিক বর্জ্যের মতো নষ্ট করা যায়। তবে পরিবেশ দূষণ নিয়ে উদ্বেগ থাকায় রাসায়নিক অস্ত্র ভস্মীভূত করার চেয়ে নিষ্ক্রিয় করাই বেশি জনপ্রিয় পদ্ধতি। নিষ্ক্রিয় করতে রাসায়নিক অস্ত্র একটি ট্যাংকে ভরা হয়। সেখানে পানি ও কস্টিক সোডা মিশিয়ে এর বিষাক্ততা কমানো হয়। এরপর সেগুলো হয় ক্ষতিকারক বর্জ্যরে মতো করে নষ্ট অথবা দ্বিতীয় একটি ট্যাংকে নিয়ে ভস্মীভূত করা হয়। [১]


[২]

  1. http://www.kishorkanthabd.com/2013/12/%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A7%9F%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%95-%E0%A6%85%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0-%E0%A6%95%E0%A7%80-%E0%A6%93-%E0%A6%95%E0%A7%87%E0%A6%A8/
  2. http://www.dw.com/bn/%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%A8-%E0%A6%97%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%B8-%E0%A6%8F%E0%A6%95-%E0%A6%85%E0%A6%A6%E0%A7%83%E0%A6%B6%E0%A7%8D%E0%A6%AF-%E0%A6%93-%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%9A%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%B9%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%80/a-17137046