উইলিয়াম মন্টগোমারি ওয়াট

স্কটিশ ইতিহাসবিদ
(Montgomery Watt থেকে পুনর্নির্দেশিত)

উইলিয়াম মন্টগোমারি ওয়াট (১৪ মার্চ ১৯০৯ – ২৪ অক্টোবর ২০০৬) একজন স্কটিশ ইতিহাসবিদ ও প্রাচ্যবিদ ছিলেন। তিনি আঙ্গলিক যাজক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং ১৯৬৪ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি ভাষাইসলামী অধ্যয়নের অধ্যাপক হিসেবে শিক্ষকতা করেন। তিনি কুরআন গবেষণা ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।


ডব্লিউ. মন্টগোমারি ওয়াট
ওয়াট (ডানে), আলি আকবর আবদোর রাশিদি কর্তৃক সাক্ষাৎকার প্রদানকালে।
জন্ম
উইলিয়াম মন্টগোমারি ওয়াট

(১৯০৯-০৩-১৪)১৪ মার্চ ১৯০৯
সিরিজ, ফাইফ, স্কটল্যান্ড
মৃত্যু২৪ অক্টোবর ২০০৬(2006-10-24) (বয়স ৯৭)
এডিনবরা, স্কটল্যান্ড
জাতীয়তাস্কটিশ
উপাধিআরবি ও ইসলামি অধ্যয়নের অধ্যাপক
উচ্চশিক্ষায়তনিক কর্ম
বিষয়প্রাচ্যবিদ্যা এবং ধর্মীয় অধ্যয়ন
উপ-বিষয়আরবি
ইসলামের ইতিহাস
মুহাম্মদ
ইসলামী দর্শন
ইসলামী ধর্মতত্ত্ব
প্রতিষ্ঠানআঙ্গলিক জেরুজালেম ধর্মপ্রদেশ
এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়
উল্লেখযোগ্য কাজMuhammad at Mecca (১৯৫৩)
Muhammad at Medina (১৯৫৬)

ওয়াট পশ্চিমা বিশ্বের অন্যতম বিশিষ্ট অমুসলিম ইসলাম-বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ইসলামের নবী হজরত মুহাম্মদ-এর জীবনী নিয়ে তাঁর রচিত দুই খণ্ডের গ্রন্থ মুহাম্মদ এট মক্কা (১৯৫৩) এবং মুহাম্মদ এট মদিনা (১৯৫৬) ইসলাম বিষয়ক গবেষণায় কালজয়ী রচনার মর্যাদা পেয়েছে।

প্রারম্ভিক জীবন ও শিক্ষা

সম্পাদনা

ওয়াট ১৯০৯ সালের ১৪ মার্চ স্কটল্যান্ডের ফাইফ কাউন্টির সিরিজ নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন।[] তাঁর পিতা স্কটল্যান্ড চার্চের একজন যাজক ছিলেন, যিনি ওয়াটের মাত্র ১৪ মাস বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।[][]

পেশাজীবন

সম্পাদনা

যাজকতা

সম্পাদনা

১৯৩৯ সালে ওয়াট স্কটিশ এপিসকোপাল চার্চ-এ ডিকন হিসেবে এবং ১৯৪০ সালে যাজক হিসেবে অভিষিক্ত হন।[] তিনি ১৯৩৯ থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত লন্ডন ডায়োসিসভুক্ত সেন্ট মেরি দ্য বোল্টনস, ওয়েস্ট ব্রম্পটন-এ তাঁর যাজকীয় প্রশিক্ষণ (কারেট) সম্পন্ন করেন।[] দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দ্য ব্লিটজ-এ গির্জাটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে তিনি প্রশিক্ষণের বাকি অংশ সম্পন্ন করতে ওল্ড সেন্ট পলস, এডিনবরা গির্জায় স্থানান্তরিত হন।[] ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত তিনি জেরুজালেমের অ্যাংলিকান বিশপের আরবি ভাষাবিষয়ক বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেন।[]

১৯৪৬ সালে একাডেমিক কর্মজীবনে ফিরে আসার পর তিনি আর পূর্ণকালীন যাজকীয় দায়িত্বে নিযুক্ত হননি। তবে তিনি খণ্ডকালীন ও সম্মানসূচক পদে তাঁর যাজকতা চালিয়ে যান। ১৯৪৬ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত তিনি এডিনবরার ওল্ড সেন্ট পলস গির্জায় একজন সম্মানসূচক কারেট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, যা অ্যাংলো-ক্যাথলিক ধারার একটি গির্জা।[] ১৯৬০ সালে তিনি স্কটল্যান্ডের আইোনা সম্প্রদায়ের সদস্য হন, যা একটি ঐকমত্যভিত্তিক ধর্মীয় গোষ্ঠী[] ১৯৬০ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত তিনি এডিনবরা দুর্গের নিকটস্থ সেন্ট কলম্বা'স বাই দ্য ক্যাসল গির্জায় সম্মানসূচক কারেট ছিলেন।[] অবসর গ্রহণের পর ১৯৮০ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত তিনি ডালকিথ-এর সেন্ট মেরি দ্য ভার্জিন এবং ল্যাসওয়েড-এর সেন্ট লিওনার্ড গির্জায় সম্মানসূচক কারেট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।[]

একাডেমিক জীবন

সম্পাদনা

ওয়াট ১৯৬৪ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি ও ইসলামি অধ্যয়নের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

তাঁকে "শেষ প্রাচ্যবিদ" (The Last Orientalist) বলেও অভিহিত করা হয়েছে।[]

তিনি টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ দে ফ্রঁস এবং জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়-এ অতিথি অধ্যাপক হিসেবে পাঠদান করেছেন।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

পরবর্তী জীবন

সম্পাদনা

ওয়াট ২০০৬ সালের ২৪ অক্টোবর এডিনবরায় ৯৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।[] তাঁর স্ত্রী জিনের সঙ্গে তাঁর চার কন্যা এবং এক পুত্র ছিল। তাঁদের পরিবার স্কটল্যান্ডের ক্রেইল গ্রামে ছুটির সময় কাটাতেন। ওয়াটের মৃত্যুর পর লেখক রিচার্ড হোলোওয়ে মন্তব্য করেন যে, "তিনি সারাজীবন অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন"।[]

সম্মাননা

সম্পাদনা

ওয়াট আমেরিকার জর্জিও লেভি ডেলা ভিদা পদক লাভ করেন এবং ব্রিটিশ সোসাইটি ফর মিডল ইস্টার্ন স্টাডিজ-এর 'সেরা পাণ্ডিত্যপূর্ণ গবেষণার' জন্য প্রদত্ত পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রথম ব্যক্তি ছিলেন।[]

তিনি অ্যাবারডিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন।[]

মূল্যায়ন ও উত্তরাধিকার

সম্পাদনা

ওয়াটের রচনাগুলো আধুনিক পাশ্চাত্য ইসলাম অধ্যয়নের ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ ক্লাসিক হিসেবে বিবেচিত হয়।[] তিনি বিশ্বাস করতেন যে কুরআন ঐশিকভাবে অনুপ্রাণিত, তবে তা অব্যর্থ নয়।[]

একবিংশ শতাব্দীর একজন অমুসলিম ইসলাম-গবেষক মার্টিন ফরোয়ার্ড বলেন:

তাঁর রচনাগুলো নবীর সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতিশ্রুতি তুলে ধরেছে; ওয়াট তাঁকে পুরাতন নিয়মের একজন নবীর সঙ্গে তুলনা করেছেন, যিনি আরবদের মধ্যে ন্যায্যতা ও একেশ্বরবাদের ধারণা পুনরুদ্ধারে এসেছিলেন, যেগুলো তাঁদের জন্য তখন গুরুত্বহীন হয়ে উঠেছিল। যদিও অধিকাংশ মুসলিমের জন্য এটি যথেষ্ট নয়, তবে এটিই একটি সূচনা। খোলামেলাভাবে বললে, খ্রিষ্টানদের পক্ষে ইসলাম সম্পর্কে ইতিবাচক মন্তব্য করা কঠিন, কারণ তারা বিশ্বাস করে যে তাদের ধর্মেই পরিত্রাণের সবকিছু রয়েছে। আর মুসলিমদের জন্যও এটি সহজ নয় যে, খ্রিষ্টানরা ইসলামকে ‘চূড়ান্ত ধর্ম’ হিসেবে মেনে নেয় না।"[]

এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস বিষয়ক অধ্যাপক ক্যারোল হিলেনব্র্যান্ড বলেন:[]

তিনি তীব্রভাবে বিতর্কিত কিছু ধর্মতাত্ত্বিক মত প্রকাশে দ্বিধা করতেন না – যা অনেক খ্রিস্টান গির্জা ব্যবস্থায় বিতর্কের জন্ম দেয়। প্রায়ই তিনি ভাবতেন, ইসলামের অধ্যয়ন তাঁর নিজের খ্রিস্টান বিশ্বাসে কী প্রভাব ফেলেছে। এর প্রত্যক্ষ ফল হিসেবে তিনি বলেন যে, ইসলামে আল্লাহর একত্ববাদের উপর যে জোর দেওয়া হয়েছে, তা তাঁকে খ্রিস্টীয় ত্রিত্ববাদ সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে, যাকে কুরআনে কঠোরভাবে একেশ্বরবাদ বিরোধী বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ইসলামের প্রভাব এবং আল্লাহর ৯৯ নামের ধারণা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি লাতিন শব্দ "persona" অর্থাৎ 'মুখ' বা 'আবরণ' – যেটি আধুনিক ইংরেজিতে 'ব্যক্তি' বোঝাতে ব্যবহৃত হয় – পুনর্বিবেচনা করে বলেন যে, খ্রিস্টীয় ত্রিত্ববাদে 'তিন ব্যক্তি' নয় বরং একই ঈশ্বরের তিনটি ভিন্ন 'রূপ' বা 'মুখ' বোঝানো হয়েছে।

ক্যারোল হিলেনব্র্যান্ডের মতে, তিনি ছিলেন "ইসলাম অধ্যয়ন ক্ষেত্রে এক বিশাল প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব এবং বিশ্বের বহু মুসলিমের কাছে শ্রদ্ধেয় এক নাম"। তবে ইসলামের উত্স ও বিকাশ নিয়ে ওয়াটের বিশ্লেষণ অন্যান্য গবেষকদের, যেমন জন ওয়ান্সব্রো (লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচ্য ও আফ্রিকা অধ্যয়ন বিদ্যালয়) এবং প্যাট্রিসিয়া ক্রোনেমাইকেল কুক-এর সমালোচনার মুখে পড়ে। তাঁদের বই হাজারিজম: দ্য মেকিং অব দ্য ইসলামিক ওয়ার্ল্ড (১৯৭৭) এবং ক্রোনের মক্কার বাণিজ্য ও ইসলামের উত্থান-এ এই সমালোচনার বহিঃপ্রকাশ ঘটে।[] তবে পরবর্তীতে প্যাট্রিসিয়া ক্রোনেমাইকেল কুক স্বীকার করেন যে হাজারিজম বইয়ের মূল তত্ত্বটি ভুল ছিল, কারণ তত্ত্বের পক্ষে যথাযথ ও অভ্যন্তরীণভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রমাণ ছিল না।[]

পাকিস্তানি গবেষক জাফর আলী কুরেশি তাঁর বই Prophet Muhammad and His Western Critics: A Critique of W. Montgomery Watt and Others-এ ওয়াটের কাজকে সমালোচনা করে বলেন যে, তিনি নবী মুহাম্মদের জীবনকে ভুলভাবে উপস্থাপন করেছেন। এই বইয়ের প্রশংসা করেন তুর্কি গবেষক ইব্রাহিম কালিন[১০]

ফরাসি বিচারপতি জর্জ-হেনরি বুসক্য ওয়াটের বই Muhammad at Mecca সম্পর্কে কটাক্ষ করে বলেন, এটি "একজন এপিসকোপাল যাজকের দৃষ্টিকোণ থেকে ইসলামের উত্সের একটি মার্ক্সবাদী ব্যাখ্যা"।[১১][১২] ডেনিশ ইতিহাসবিদ প্যাট্রিসিয়া ক্রোনে ওয়াটের পদ্ধতির সমালোচনা করেন, যেখানে তিনি অলৌকিক অংশ বাদ দিয়ে কাহিনিগুলি থেকে "ঐতিহাসিক" তথ্য আহরণের চেষ্টা করেন।[১৩]

নির্বাচিত গ্রন্থসমূহ

সম্পাদনা

আরও দেখুন

সম্পাদনা

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. Holloway, Richard (১৪ নভেম্বর ২০০৬)। "William Montgomery Watt"The Guardian। সংগ্রহের তারিখ ১ জুন ২০১৬ 
  2. Hillenbrand, Carole (৮ নভেম্বর ২০০৬)। "Professor W. Montgomery Watt"The Independent। সংগ্রহের তারিখ ১ জুন ২০১৬ 
  3. টেমপ্লেট:Crockford
  4. "Interview with Profs. William Montgomery Watt"www.alastairmcintosh.com 
  5. The Herald, The Scotsman, The Times, 27 October 2006
  6. "Lecture by Professor Carole Hillenbrand in event: Islamic Studies in Scotland: Retrospect and Prospect" (পিডিএফ)University of Edinburgh, Islamic and Middle Eastern Studies। ২০১৬-১২-১৩। সংগ্রহের তারিখ ২০১৭-০৩-২৫ 
  7. "The Prophet Muhammad: A mercy to mankind"। ৪ সেপ্টেম্বর ২০০৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। 
  8. Patricia Crone, Meccan Trade and the Rise of Islam, Princeton University Press. 1987 [১]
  9. Khan, Ali (২০০৫)। "Hagarism: The Story of a Book Written by Infidels for Infidels"SSRN Electronic Journalআইএসএসএন 1556-5068ডিওআই:10.2139/ssrn.944295 
  10. Ibrahim Kalin, Prophet Muhammad and His Western Critics: A Critique of W. Montgomery Watt and Others 
  11. Fred M. Donner, The Study of Islam's Origins since W. Montgomery Watt's Publications (পিডিএফ), পৃষ্ঠা 4 
  12. Jacques Waardenburg (১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১২), Muslims as Actors, Walter de Gruyter GmbH & Co. KG, আইএসবিএন 978-3-11-019142-4 
  13. Roggema, Barbara (২০০৯)। The Legend of Sergius Baḥīrā: Eastern Christian Apologetics and Apocalyptic in Response to Islam (ইংরেজি ভাষায়)। Brill। পৃষ্ঠা 52। আইএসবিএন 978-90-04-16730-8 

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা