মণিপুরি নৃত্য
মণিপুরি নৃত্য[১] বা জাগই[২] নামেও পরিচিত, নৃত্যশেলীর একটি প্রাচীন ধারা। এর উৎপত্তি মণিপুরে।[৩] মণিপুরের সাঙ্গীতিক ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। এই নৃত্যকে মণিপুরের সুপ্রাচীন নৃত্যধারা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটি মূলত একটি নৃত্য-উৎসব হিসেবে মণিপুরে পালিত হয়। এটি ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যের একটি অন্যতম প্রধান ধারা।[৪]
মণিপুরি লাই শব্দের অর্থ হলো− দেবতা, হারাউবা' শব্দের অর্থ হলো− আনন্দ-নৃত্য।[৫] মণিপুরে বৈষ্ণব ধর্ম প্রাধান্যলাভের আগে, শৈবমতের ব্যাপক প্রভাব ছিল। দেবতা শিবের প্রতীক হিসেবে 'লাই' ছিল শিবলিঙ্গের প্রতীক। ১৭০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে মণিপুর শৈব এবং বৈষ্ণব ধর্মের সহাবস্থানে একটি শান্তির জনপদে পরিণত হয়েছিল।
১৭০৮ খ্রিষ্টাব্দের দিকে পামহৈবা মণিপুরের রাজত্ব লাভের পর বৈষ্ণবদের আধিপত্য প্রবলতর হয়ে মণিপুরকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। কারণ, রামানন্দীর ভাবদর্শের বিশ্বাসী বৈষ্ণব সাধক শান্তি দাস অধিকারীর অনুপ্রেরণায় রাজা পামহৈবা বৈষ্ণব মত গ্রহণ করেন। এরপর তিনি তার মতকে একরকম জোর করেই মণিপুরে প্রতিষ্ঠা করেন। ফলে এই অঞ্চলে শৈবমতাদর্শের লোকের একরকম কোণঠাসা হয়ে পড়ে। এই সময় রাজা পামহৈবা অন্যান্য মতের গ্রন্থাদি ও নিদর্শন ধ্বংস করে দেয়। এর ফলে মণিপুরের ইতিহাসও ধ্বংস হয়ে যায়।
মণিপুরের বৈষ্ণবরাও দেবতা হিসাবে শিবকে শ্রদ্ধা এবং পূজা করতো। ফলে প্রবল বৈষ্ণব আধিপত্যের যুগেও শিব-পার্বতীর লীলা ভিত্তিক গীত ও নৃত্য বিলুপ্ত হয়ে যায় নি। ফলে 'লাইহারাউবা'- নৃত্য মর্যাদা হারাতে হারাতে প্রায় বিলুপ্তির পথে চলে যায়। রাজা চন্দ্রকীর্তি সিংহাসনে ১৮৪৪ খ্রিষ্টাব্দে সিংহাসনে বাসার পর তিনি এই নাচকে আবার প্রচলন করেন।
বর্তমানে লাইহারাউবা নৃত্য দুই ভাবধারায় পরিবেশিত হয়। এই ভাবধারা দুটি হলো মৈরাঙ লাইহারাউবা ও উমঙ লাইহারাউবা। এই দুটি ধারাতেই পরিবশিত হয় নানা ধরনের কাহিনি নির্ভর নৃত্যগীত। এর ভিতরে খাম্বাথৈবী, নঙ্পক্নিঙ্থুপানথেবী, থনজিঙ লাইরেম্বী উল্লেখযোগ্য। এই নাচে তাণ্ডব ও লাস্য উভয় ধারাই ব্যবহৃত হয়। এই নৃত্য শৈব নৃত্যধারার হলেও, এতে পরবর্তী সময়ে রাসনৃত্যের ভঙ্গীপারেঙ-এর প্রভাব পড়ে ব্যাপকভাবে[৬]।
এই নৃত্যধারার সাথে জড়িয়ে আছে, মণিপুরের সনাতন ধর্মে বর্ণিত সৃষ্টিতত্ত্ব। মণিপুরের লোক পুরাণ মতে- নয়জন লাইবুঙথ (দেবতা) এবং সাতজন লাইনুরা (দেবী) পৃথিবী সৃষ্টি করেছিলেন। আদিতে পৃথিবী জলমগ্ন ছিল, আর সেই জলের উপর সাতজন লাইনুরা নৃত্য করছিলেন। এই দৃশ্য দেখে নয়জন লাইবুঙথ স্বর্গ থেকে লাইনুরাদের লক্ষ্য করে মাটি নিক্ষেপ করতে থাকেন। নৃত্যরতা সাতজন লাইনুরা সেই ছুঁড়ে দেওয়া মাটির উপর নেচে নেচে পৃথিবীর স্থলভাগ তৈরি করেন। এই ভাবনা থেকে লাইহারাউবা নৃত্যের সূচনা হয় 'লাইএকাউবা'। এই নৃত্যে অংশগ্রহণ করেন কিছু দেবদাস এবং দেবদাসী। উল্লেখ্য, মণিপুরে দেবতাদের সেবায় যে পুরুষরা সারাজীবন নিজেদেরকে উৎসর্গ করেন, তাদের বলা হয় মৈবা (দেবদাস)। একইভাবে যে নারীরা দেবতাদের সেবায় সারাজীবন নিজেদেরকে উৎসর্গ করেন, তাদের বলা হয় মৈবী (দেবদাসী)।
ভারতের প্ৰসিদ্ধ মণিপুরী নৃত্যশিল্পী
সম্পাদনাতথ্য সূত্র
সম্পাদনা- ↑ "লাইহারাউবা নৃত্য, মণিপুরি নৃত্য"। www.onushilon.org। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-১১-১৬।
- ↑ Massey, Reginald (২০০৪)। India's Dances: Their History, Technique, and Repertoire (ইংরেজি ভাষায়)। Abhinav Publications। পৃষ্ঠা ১৭৭। আইএসবিএন 978-81-7017-434-9।
- ↑ Ph.D, James G. Lochtefeld (২০০১-১২-১৫)। The Illustrated Encyclopedia of Hinduism, Volume 1 (ইংরেজি ভাষায়)। The Rosen Publishing Group, Inc। পৃষ্ঠা ৩৭৬। আইএসবিএন 978-0-8239-3179-8।
- ↑ উইলিয়ামস ২০০৪, পৃ. ৮৩-৮৪, অন্য ধারাগুলো হচ্ছে কত্থক, ভরতনট্যম, কুচিপুড়ি, মণিপুরী, ওড়িশি, চাউ, সাত্রিয়া, যগসগ্ন, ও ভগবত মেলা।।
- ↑ Parratt, Saroj Nalini (১৯৯৭)। The Pleasing of the Gods: Meitei Lai Haraoba (ইংরেজি ভাষায়)। Vikas Publishing House।
- ↑ "ভারতের খাজুরাহ নৃত্য উৎসবে মণিপুরি নাচ"। জাগো নিউজ (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-১১-১৬।
বহিঃসংযোগ
সম্পাদনা- মনিপুরি নৃত্য, অনুশীলন
- মনিপুরি নাচ, জাগো নিউজ