লাইকা

মহাকাশে প্রেরণ করা কুকুর
(Laika থেকে পুনর্নির্দেশিত)

লাইকা ([Лайка, আক্ষরিক অর্থ - যে ঘেউঘেউ করে] ত্রুটি: {{Lang-xx}}: text has italic markup (সাহায্য)) (১৯৫৪ - ১৯৫৭) একটি রুশ মহাকাশ কুকুর যা পৃথিবীর প্রথম জীব হিসেবে পৃথিবীর কক্ষপথ পরিক্রমণের সৌভাগ্য অর্জন করেছিল। ১৯৫৭ সালের ৩রা নভেম্বর উৎক্ষেপণ করা সোভিয়েত নভোযান স্পুটনিক ২ এ চড়ে এটি মহাকাশ ভ্রমণ করেছিল। লাইকার পাশাপাশি আরও দুইটি কুকুরকে এই মহা অভিযানের জন্য প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল, শেষ পর্যন্ত লাইকাই নির্বাচিত হয়। লাইকার মূল নাম "কুদরিয়াভকা" এবং সে একটি মেয়ে কুকুর।

১৯৫৭ সালে লাইকা। অভিযানের পোশাক পরিহিত অবস্থায় দেখা যাচ্ছে।

অত্যধিক চাপ এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে উৎক্ষেপণের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই লাইকা মারা গিয়েছিল। তাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় কোন সমস্যা হওয়ার কারণে এমনটি হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। এই মহাকাশ অভিযানের কয়েক দশক পর লাইকা মৃত্যুর প্রকৃত কারণ মানুষকে জানানো হয়েছিল।

লাইকা পুরো ভ্রমণের সময় বেঁচে না থাকলেও এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছিল যে, পৃথিবীর কক্ষপথে উৎক্ষেপিত মহাকাশযানে ওজনহীন থাকা সত্ত্বেও যাত্রীর পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব। এর মাধ্যমে মনুষ্যবাহী নভোযান প্রকল্প শুরু হতে পেরেছিল। কোন জীবের উপর মহাকাশের পরিবেশের প্রভাব কিরকম হয় তাও লাইকার মাধ্যমে জানা গিয়েছিল।

২০০৮ সালের ১১ই এপ্রিল রুশ কর্মকর্তারা লাইকার সম্মানে একটি স্মৃতিসৌধ স্থাপন করেছে। মস্কোর একটি সামরিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কাছে এই ছোট্ট স্মৃতিসৌধটি অবস্থিত। এই প্রতিষ্ঠানটিই মহাকাশে লাইকার অভিযানের সবকিছু প্রস্তুত করেছিল। রকেটের উপর একটি কুকুর দাড়িয়ে আছে, এটাই সৌধের নকশা। লাইকার অভিযান যখন উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল তখন জীবের উপর মহাকাশের প্রভাব খুব বেশি জানা যায়নি। এ কারণে অনেকেই বলেছিলেন, কোন জীবের পক্ষে মহাকাশে গিয়ে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু, তখন থেকেই রুশ প্রকৌশলীরা কুকুর প্রেরণকে মনুষ্যবাহী মহাকাশ অভিযানের পূর্বসূরী হিসেবে দেখে এসেছেন।

স্পুটনিক ২ সম্পাদনা

 
রোমানিয়ার ডাকটিকিটে লাইকা
 
রাশিয়ার একটি পোস্ট স্ট্যাম্প।

স্পুতনিক ১ এর সফল অভিযানের পর রুশ নেতা Nikita Khrushchev ৭ই নভেম্বর বলশেভিক বিপ্লবের ৪০তম বর্ষপূর্তীতে দ্বিতীয় আরেকটি মহাকাশ অভিযান প্রেরণের ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। আগেরটির চেয়ে অনেক সূক্ষ্ণ একটি উপগ্রহের নির্মাণ কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এই উপগ্রহের নির্মাণ কাজ ডিসেম্বরের আগে শেষের সম্ভাবনা না থাকায় এর ভাগ্যে স্পুতনিক ২ জোটেনি। স্পুতনিক ৩ এর মাধ্যমে এই উপগ্রহ কক্ষপথে প্রেরণ করা হয়।

নভেম্বর সময়সীমার মধ্যে শেষ করার জন্য অপেক্ষাকৃত সাধারণ ও নিম্নমানের একটি নকশা বানাতে হয়েছিল। রুশ কর্মকর্তারা জানান, অক্টোবরের ১০ কি ১২ তারিখে এই অভিযানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। অর্থাৎ নভোযান তৈরির জন্য তারা সময় পেয়েছিলেন মাত্র ৪ সপ্তাহ। এ কারণে স্পুতনিক ২ অনেক নিচু মানের এবং অপরীক্ষিত যন্ত্রপাতি দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। এতে করে যেহেতু জীবন্ত একজন যাত্রীকে পাঠাতে হয়েছিল সেহেতু এর সাথে সৌর বিকিরণ এবং মহাজাগতিক রশ্মি পরিমাপের ব্যবস্থা সংযুক্ত করতে হয়েছিল।

নভোযানটিতে জীবন ধারণের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছিল। এতে একটি অক্সিজেন উৎপাদক এবং অক্সিজেনকে বিষাক্ত হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা ও কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ছিল। একটি পাখা ছিল যা কেবিনের তাপমাত্রা ১৫° সেলসিয়াস থেকে বেড়ে গেলেই সক্রিয় হয়ে উঠতো এবং কুকুরের সহনীয় তাপমাত্রা বজায় রাখতো। ৭ দিন বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় খাবার জেলাটিন হিসেবে সরবরাহ করা হয়েছিল। কুকুরটিকে আবর্জনা সংগ্রহের জন্য একটি ব্যাগের সাথে যুক্ত করে দেয়া হয়েছিল। উঠে দাড়ানো, হাটা বা শোয়ার জন্য লাইকা যেন বেশি নড়াচড়া করতে না পারে এজন্য শিকল ছিল। কেবিনটিতে উল্টো ঘোড়ার মত যথেষ্ট জায়গা ছিল না। কুকুরকে ঘোড়ার সাজের মত একটি হার্নেস পরিয়ে দেয়া হয়েছিল। হৃদ্‌যন্ত্রের পাল্‌স নির্ণয়ের জন্য একটি ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাম ছিল। এছাড়া শ্বসন হার, সর্বোচ্চ ধমনী চাপ এবং কুকুরের চলাচল শনাক্ত করার উপযোগী যন্ত্রপাতিও ছিল।

প্রশিক্ষণ ও অভিযান সম্পাদনা

কুকুরটির নাম প্রথমে লাইকা ছিল না। মস্কোর রাস্তা রাস্তায় ভবঘুরের মত ঘুরে বেড়াতো। এই নারী mongrel কুকুরটি যখন পাওয়া গিয়েছিল তখন তার বয়স ছিল প্রায় ৩ এবং ভর ছিল প্রায় ৬ কেজি (১৩ পাউন্ড)। সোভিয়েত কর্মকর্তারা এর বেশ কিছু নাম দিয়েছিল যার মধ্যে রয়েছে: Kudryavka (Little Curly 'র রুশ নাম), Zhuchka (Little Bug'র রুশ নাম) এবং Limonchik (Little Lemon 'র রুশ নাম)। লাইকা নামটিই পৃথিবীর সর্বত্র জনপ্রিয় হয়ে উঠে। কুকুরের বেশ কয়েকটি প্রজাতির রুশ নাম ছিল লাইকা। মার্কিনীরা স্পুতনিকের শব্দ-কৌতুক হিসেবে লাইকার নাম দিয়েছিল মুটনিক। অনেক মার্কিনীই অবশ্য লাইকাকে শুধু কার্লি বলে ডাকতো। লাইকার কুলপরিচয় সঠিকভাবে জানা যায়নি। সাধারণত ধারণা করা হয়, এটি অনেকটা হাস্কির মত এবং এরকম অন্যান্য নর্ডিক প্রজাতি থেকে এসেছে। হাস্কির সাথে টেরিয়ারের কিছুটা সমন্বয় রয়েছে এতে।

এর আগে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া কেবল অর্ধ-কক্ষীয় (সাব-অরবিটাল) অভিযানগুলোতেই প্রাণী পাঠাতো। স্পুতনিক ২ এর জন্য তিনটি কুকুরকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল যাদের নাম: আলবিনা, মুশকা এবং লাইকা। রুশ মহাকাশ-জীবন বিজ্ঞানী Oleg Gazenko লাইকাকে নির্বাচন করেন এবং তাকে প্রশিক্ষণ দেন। আলবিনা দুইটি অধিক উচ্চতার পরীক্ষণমূলক রকেট উড্ডয়নে অংশ নিয়েছিল। মুশকাকে যন্ত্রপাতির কর্মক্ষমতা এবং জীবন ধারণের উপযোগী পরিবেশ নিশ্চিতকরণের কাজে ব্যবহার করা হয়েছিল।

স্পুতনিক ২ এর কেবিন খুব ছোট ছিল। এতো ছোট জায়গায় থাকতে কুকুরদেরকে অভ্যস্ত করার জন্য প্রায় ২০ দিন পর্যন্ত তাদেরকে এর থেকেও ছোট কক্ষে রাখা হয়েছিল। এতো ছোট ঘরে আটকে থাকার কারণে তাদের মল-মূত্র ত্যাগ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, বিশ্রামে ব্যঘাত ঘটায় তারদের অবস্থা স্বাভাবিকের তুলনায় খারাপ হয়ে গিয়েছিল। মল নরম করে দেয়ার জন্য ল্যাক্সাটিভ ব্যবহার করেও কোন লাভ হচ্ছিল না। গবেষকরা বুঝতে পারিলেন অনেক দিনের নিয়মিত প্রশিক্ষণ ছাড়া কার্যকর কোন ফল লাভ সম্ভব না। কুকুরদেরকে একটি সেন্ট্রিফিউজে রাখা হয়েছিল যাতে সিম্যুলেশনের মাধ্যমে রকেট উৎক্ষেপণের সময়কার ত্বরিত পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। এছাড়া নভোযানের শব্দের সিম্যুলেশন করা একটি যন্ত্রের মাধ্যমেও তাদেরকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল। এতে তাদের হৃদ্‌কম্পনের হার দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছিল এবং চাপ ৩০-৬৫ টর পর্যন্ত বেড়ে গিয়েছিল। তাদের এক ধরনের পুষ্টিকর জেল খাওয়ানো হতো। মহাকাশে এই জেলকেই তাদের খাদ্য হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছিল।

উৎক্ষেপণ মঞ্চে নিয়ে যাওয়ার আগে এক বিজ্ঞানী লাইকাকে তার সঙ্গে করে নিজের বাসায় নিয়ে গিয়েছিলেন। সোভিয়েত মহাকাশ চিকিৎসা বিষয়ে লেখা একটি কালপঞ্জিমূলক গ্রন্থে ডঃ ভ্লাদিমির ইয়াজদোভ্‌স্কি লিখেছেন, "আমি তার জন্য সুন্দর কিছু করতে চেয়েছিলাম: কারণ তার আয়ু আর বেশি দিন ছিল না।"

নাসার একটি দলিলে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৫৭ সালের ৩১শে অক্টোবর অর্থাৎ উৎক্ষেপণের ৩ দিন আগেই লাইকাকে কৃত্রিম উপগ্রহটির ভেতর স্থাপন করা হয়েছিল। উৎক্ষেপণের দিন সেখানে প্রচণ্ড শীত ছিল। এ কারণে একটি নমনীয় নলের ভেতর দিয়ে গরম জল প্রবাহিত করার মাধ্যমে লাইকার ধারকটিকে গরম রাখা হচ্ছিল। উৎক্ষেপণের ঠিক আগে লাইকাকে সার্বক্ষণিক চোখে চোখে রাখতে দুই জন সহকারী নিয়োগ করা হয়েছিল।

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা