১৯৭৪ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাত ছাত্র খুন

১৯৭৪ সালের ৪ এপ্রিল বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসিন হলে সাত জন ছাত্রকে গুলি করে হত্যা করা হয় যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাত খুন নামে পরিচিত। এই খুনের অভিযোগে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় তাদেরকে মৃত্যদন্ড দেওয়া হলে পরবর্তীতে তা কার্যকর করা হয়নি।

বর্ণনা সম্পাদনা

উক্ত রাতে ১০-১৫ জন সশস্ত্র ছাত্রলীগ কর্মী সূর্যসেন হলের ৬৩৫ ও ৬৪৮ নম্বর কক্ষের সাতজন ছাত্রকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে অস্ত্রের মুখে তাদেরকে মুহসীন হলে নিয়ে যায়। তাদেরকে হাত পা বেঁধে হলের টিভি রুমে দাঁড় করানো হয়। নাজমুল হক কোহিনুর নামক ছাত্র ব্যাপারটি বুঝতে পেরে প্রাণে না মারার জন্যে কাকুতি মিনতি করে। সূর্যসেন হলের পাঁচতলা থেকে তাদেরকে নামিয়ে আনার পথে ২১৫ নম্বর কক্ষে আরো একজন ছাত্রের খোঁজ করে। উক্ত ছাত্র ঘটনা আঁচ করতে পেরে জানালা ভেঙে দোতলা থেকে লাফিয়ে পড়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। আক্রমণকারী ছাত্রলীগ কর্মীরা রাত ২টা ১১ মিনিটে সাত ছাত্রের উপরে স্টেনগান দিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে রাত ২ টা ২৫ মিনিটে তারা ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। ভোর ৪টা ৫৫ মিনিটে আড়াই ঘণ্টা বাদে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। নিহত ছাত্ররা শেখ ফজলুল হক মনির লোক বলে পরিচিত ছিলেন।

তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান সেসময়ে চিকিৎসার জন্য মস্কোতে ছিলেন। খুনিদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার ও বিচার দাবি করে শফিউল আলম প্রধানের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে মিছিল হয়।[১]

হত্যাকান্ডের তিনদিন পর পুলিশ তৎকালীন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম প্রধান, কামরুজ্জামান ওরফে কামরুল এবং মাহমুদুর রহমান ওরফে বাচ্চুকে গ্রেফতার করে। তদন্তে শফিউল আলমের সরাসরি সম্পৃক্ততা পাওয়া যায় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এই খুন সংঘটিত হয় বলে উল্লেখ করা হয়।[২] তৎকালীন ছাত্রলীগের সভাপতি মনিরুল হক চৌধুরী সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন ছাত্রদের একজনের বান্ধবী বা দুটো গ্রুপের কোনো এক গ্রুপের সদস্যের গার্লফ্রেন্ডকে টিজ করার ঘটনা ঘটেছিল।[৩] শফিউল আলম প্রধানের গ্রেফতারের প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মিছিল বের হয় এবং সেই মিছিলেঅজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিরা গ্রেনেড ছুড়ে মারে।[৪]

শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলেই এই খুনের বিচার হয় এবং অভিযুক্তদের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হয়। কিন্তু ১৯৭৫-এর পর এই সকল মৃত্যুদণ্ড আর কার্যকর হয়নি। বছর দুয়েক পর আব্দুর রাজ্জাক ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামী আব্বাসউদ্দিন আফসারিকে দেখতে পেয়ে ভৎর্সনা করে বলেছিলেন, হলের ভেতরে মারতে গেলি কেন? ওদের ডেমরা-টেমরা নিয়ে ফেলে দিয়ে আসলেই তো হতো?[৫]

এই ঘটনার আগে ১৯৭৩ সালের ৬ সেপ্টেম্বর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে উপদলীয় কোন্দলের জের ধরে ছাত্রলীগের চার কর্মী আসাদ, শহীদ, মিন্টু ও মোশতাক কে হত্যা করা হয়। এরা কেউই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন না। এ ঘটনায় চারজন মারা গেলেও ইদ্রিস নামে একজন আহত অবস্থায় বেঁচে যায়।

খুন হওয়া ৭ জনের পরিচয় সম্পাদনা

১। বসির উদ্দীন আহমেদ, পিতা মৃত মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দীন ভূঁইয়া, ২৯ ডিস্টিলারি রোড, ঢাকা। প্রথম বর্ষ এমকম;

২। সৈয়দ মাসুদ মাহমুদ (বাব্বন), পিতা সৈয়দ নাসির উদ্দীন মাহমুদ, ৩৪ ঠাকুরদাস লেন, বানিয়ানগর, ঢাকা। বিএ অনার্স দ্বিতীয় বর্ষ, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ;

৩। আবুল হোসেন, পিতা আবদুস সামাদ অ্যাডভোকেট, পাইকপাড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা। বিএ অনার্স প্রথম বর্ষ, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ;

৪। এম এ ইদ্রিস, পিতা মৃত মোহাম্মদ সিদ্দিক, ১১৫ চক মোগলটুলী, ঢাকা। এমকম প্রথম বর্ষ, ম্যানেজমেন্ট বিভাগ;

৫। মোহাম্মদ নামজুল হক (কোহিনুর), পিতা নুরুদ্দীন আহমদ, চাষাঢ়া, নারায়ণগঞ্জ। এমএ ফাইনাল পার্ট, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ;

৬। সৈয়দ রিজওয়ানুর রব (সোহেল), পিতা ফজলে রব, ৩৯/২ পাঁচ বাই ষাট লেন, নারিন্দা, ঢাকা। বিএ অনার্স প্রথম বর্ষ, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ;

৭। এবাদ খান, পিতা ইব্রাহিম খান, পাইকপাড়া, ধামরাই, ঢাকা। বিএ অনার্স, প্রথম বর্ষ, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ।[৩]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

উদ্বৃতি
  1. আহমদ ২০১৪, পৃ. ১৩৫।
  2. বাংলাদেশ প্রতিদিন, বৃহস্পতিবার, ২১ মে ২০১৫, চাঞ্চল্যকর সেসব খুন (১৪) মুহসীন হলের রোমহর্ষক সেই সেভেন মার্ডার।
  3. ৫০ বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭ খুন, প্রথম আলো, ৬ এপ্রিল ২০২৪
  4. পারভেজ ২০১৫, পৃ. ৩২৪।
  5. আহমদ ২০১৪, পৃ. ১৩৭।
গ্রন্থপঞ্জি